বৈসাবি উৎসব

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধাণ ৩টি আদিবাসী সমাজের বর্ষ বরণ উৎসব। এটি তাদের প্রধাণ সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর একটি। এ উৎসবটি ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুব, বৈসু বা বাইসু , মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমাতঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত। বৈসাবী নামকরনও করা হয়েছে এই তিনটি উৎসবের এর প্রথম অক্ষর গুলো নিয়ে। বৈ শব্দটি ত্রিপুরাদের বৈসু থেকে, সা শব্দটি মারমাদের সাংগ্রাই থেকে এবং বি শব্দটি চাকমাদের বিজু থেকে। এই তিন শব্দের সম্মিলিত রূপ হলো 'বৈসাবি'।[1][2]

বিজু

চাকমাতঞ্চঙ্গ্যাগণ এ উৎসবটি ৩দিন ধরে পালন করেন। এ ৩ দিন হল চৈত্রের শেষ ২দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন। এর মাঝে চৈত্রের শেষ দিনটি এই উৎসবের মূল আকর্ষণ। এ দিন ঘরে ঘরে পাঁচ প্রকারের সবজি সহকারে বিশেষ খাদ্য পাঁচন রাধা হয়। তারা বিশ্বাস করেন এই পাঁচনের দৈব গুণাবলী আগত বছরের অসুস্থতা ও দুর্ভাগ্য দূর করবে। এদিন বিকেলে খেলা হয় ঐতিহ্যবাহী খেলা ঘিলা, বৌচি ইত্যাদি। তরুণীরা পানিতে ফুল ভাসিয়ে দেয়। বিজু উৎসবের এই ৩দিন কেউ কোনো জীবিত প্রাণী বধ করেন না।

সাংগ্রাই

মারমা আদিবাসীরা বর্ষবরণের এই উৎসব কে পালন করেন সাংগ্রাই নামে। এ উৎসব চলে ৪দিন ধরে। মারমাগণ সবাই বুদ্ধএর ছবি সহকারে নদীর তীরে যান এবং দুধ কিংবা চন্দন কাঠের জল দিয়ে এ ছবিটিকে স্নান করান। তারপর আবার এই ছবিটিকে আগের জায়গায় অর্থাৎ মন্দির বা বাসাবাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। মারমা সম্প্রদায় সেই আদিকাল থেকে অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে পুরনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করে আসছে, যা মারমা ভাষায় সাংগ্রাই নামে পরিচিত। মূলত 'সাক্রাই' (সাল) শব্দ থেকেই 'সাংগ্রাই' শব্দ এসেছে বলে ধারণা করা হয়। যা বাংলাই 'সংক্রান্তি' বলে পরিচিত। মারমা সম্প্রদায়ের 'সাংগ্রাই জ্যা'র (মারমা বর্ষপঞ্জি) গঠনের মাধ্যমে সাংগ্রাইয়ের দিন ঠিক করা হয়ে থাকে। মাইংমা ১৩৫৯ খ্রিষ্টাব্দের আগে থেকেই এ 'সাক্রাই' বা সাল গণনা করা হয়, যা 'জ্যা সাক্রই' নামে পরিচিত।

সাংগ্রাইয়ের উৎপত্তি নিয়ে মারমা ভাষায় বিভিন্ন কল্পকাহিনী বিদ্যমান রয়েছে, যা এখনো মারমা বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে মুখে প্রচলিত। কবে থেকে মারমাদের সাংগ্রাই উদ্যাপন শুরু হয় এ ব্যাপারে সঠিক কোনো ইতিহাস এখনো পাওয়া যায়নি। সাংগ্রাই উৎসবটি মারমারা তিন দিনব্যাপী উদ্যাপন করে। সাংগ্রাইয়ের প্রথম দিনকে মারমা ভাষায় 'সাংগ্রাই আক্যা' বা 'পাইং দোয়াক' (সাংগ্রাইয়ের প্রথম দিন পুষ্প আহরণ)। দ্বিতীয় দিনকে 'সাংগ্রাই বাক্' (সাংগ্রাইয়ের দিন) এবং তৃতীয় দিনকে 'সাংগ্রাই আপ্যাইং' (সাংগ্রাই বিদায়) নামে পরিচিত। এই তিন দিন মারমারা নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে।[1][2]

সাংগ্রাই আক্যা বা পাইং ছোয়ায় (সাংগ্রাইয়ের প্রথম দিন বা পুষ্প আহরণ)

এই দিনে আসন্ন পবিত্র সাংগ্রাইকে সামনে রেখে মারমারা নিজেদের বাড়ি, বাড়ির আঙিনা ও আশপাশের রাস্তা পরিষ্কার করে। এদিন মারমারা সবাই মিলে পবিত্র সূত্রাদি পাঠের মাধ্যমে বিহার পরিষ্কার করে থাকে।[1][2]

সাংগ্রাই বাক্ (সাংগ্রাইয়ের দিন)

এই দিনে খুব ভোর থেকে গ্রামে গ্রামে মারমাদের মধ্যে নিজ নিজ উদ্যোগে পুষ্প আহরণের ধুম লাগে। এদিন যে যত বেশি পুষ্প আহরণ করে বুদ্ধের কাছে পুষ্পপূজা করতে পারবে সে তত বেশি পুণ্য অর্জন করবে বলে মারমাদের বিশ্বাস। সাংগ্রাইয়ের তিন দিনকে উপলক্ষ করে অনেকে বিহারে গিয়ে তিন দিনের জন্য অষ্টমশীল পালন করে উপাসনা করেন। আবার অনেকে এদিন খুব ভোরে বিহারে গিয়ে বুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে 'অংরুং ছোইং' (ভিক্ষুদের সবার খাবার) দান করেন। বিহারে অবস্থানরত ভিক্ষুরা এদিন ধর্ম দেশনা দিয়ে থাকেন। দুপুর গড়ালে 'দোয়াইং' (ভিক্ষুদের দুপুরের খাবার)-এর দানানুষ্ঠান শুরু হয়। অতঃপর ভিক্ষুদের দোয়াইং গ্রহণ শেষ হলে বিকেলে 'নাইংসা' (সুগন্ধিকাব বিশেষ)-এর পানি, ডাবের পানি দিয়ে বুদ্ধ স্নান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।[1][2]

সাংগ্রাই আপ্যাইং (সাংগ্রাইয়ের বিদায়)

এই দিনটি মারমাদের কাছে নতুন বছরের শুরু বলে ধারণা করা হয়। এদিনেও পুষ্পপূজা, দোইংতা (আহার দান) করা হয়। এদিনে বিহারে আসা পুণ্যর্থীদের মধ্যে পিঠা বিতরণ করা হয়। গ্রামে গ্রামে প্রতিবেশীদের মধ্যে পিঠা বিনিময় করা হয়। একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। এদিন গ্রামে বয়োজ্যেষ্ঠদেরও পিঠা দান করা হয়।[1][2]

বৈসুক

ত্রিপুরাগণ শিবএর পূজা ও তার কাছে ক্ষমা প্রার্থণার মাধ্যমে এ দিবসটি পালন করেন।

গণত্মক বা পাচন

বৈসাবি উৎসবে রান্না হয় মূলত আদিবাসীদের প্রধান ও জনপ্রিয় খাবার 'গণত্মক বা পাচন' এ খাবার সবার ঘরে রান্না হয়। এর পাশাপাশি নানা ধরনের পিঠা, সেমাই, মুড়ি-চানাচুরসহ বিভিন্ন ধরনের ফলমূল ও ঠাণ্ডা পানীয়র আয়োজন করা হয়। মিশ্র শাকসবজি রান্না হয় মূলত ২৫ থেকে ৩০ ধরনের সবজির সংমিশ্রণে। তবে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বনজঙ্গলের পরিমাণ কমে যাওয়ায় সবজির ধরনের পরিমাণও কমে যাচ্ছে।[1][2]

পানি উৎসব

পানি উৎসবটি প্রতিটি এলাকাতেই কমবেশি জনপ্রিয়। এটিও বৈসাবী উৎসবেরই একটি অংশ। এ উৎসবে আদিবাসীরা সবাই সবার দিকে পানি ছুঁড়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন যেন গত বছরের সকল দুঃখ, পাপ ধুয়ে যায়। এর আগে অনুষ্ঠিত হয় জলপূজা। এর মাধ্যমে পরস্পরের বন্ধন দৃঢ় হয়। তা ছাড়া মারমা যুবকরা তাদের পছন্দের মানুষটির গায়ে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে ভালোবাসা প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে পরস্পরের বন্ধন দৃঢ় হয়। তা ছাড়া মারমা যুবকরা তাদের পছন্দের মানুষটির গায়ে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে ভালোবাসা প্রকাশ করে। ভালোবাসার এমন বর্ণাঢ্য উচ্ছ্বাস, এমন বর্ণাঢ্য অনুভূতি আর কোন 'গান্ধর্ব্য' শুধু বৈসাবিতেই সম্ভব।

তথ্যসূত্র

  1. কালের কণ্ঠ, বৈসাবি উৎসব,সাংগ্রাই
  2. কালের কণ্ঠ, বৈসাবি উৎসব,সাংগ্রাই

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.