বেঙ্গল প্যাক্ট

বেঙ্গল প্যাক্ট একটি চুক্তি যা ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক পার্থক্যজনিত সমস্যা সমাধানকল্পে সম্পাদিত হয়েছিল। চুক্তির উদ্যোক্তা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মুসলিমদের সাথে হিন্দুদের রাজনৈতিক অংশীদারত্বের পক্ষপাতী ছিলেন।[1] এই চুক্তিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী‌র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

পটভূমি=

অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের একটি অংশ আইন সভায় যোগদানের পক্ষে অবস্থান নেন। চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহরু এদের মধ্যে প্রভাবশালী ছিলেন।[1] ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে গয়ায় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন হয়। এতে চিত্তরঞ্জন দাশ সভাপতিত্ব করেন।[2] তিনি অধিবেশনে কাউন্সিল এন্ট্রি প্রোগ্রাম পেশ করেন।[2] কংগ্রেসে তার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। চিত্তরঞ্জন দাশ কংগ্রেসের সভাপতির পদ ত্যাগ করেন[1] এবং পরের পছর ১৯২৩ সালের জানুয়ারিতে স্বরাজ্য দল গঠন করেন।[2] এতে তিনি ডাঃ আনসারী, হাকিম আজমল খান, বিঠলভাই প্যাটেল, মতিলাল নেহরু, মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদি, ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের সমর্থন পান।[2]

চুক্তি

রাজনৈতিক কর্মসূচির সাফল্যের জন্য চিত্তরঞ্জন দাশ আইন পরিষদের মুসলিম সদস্যবৃন্দের সহায়তা চান। এসময় ১৯২৩ সালের এপ্রিলে স্যার আবদুর রহিম, মৌলভী আবদুল করিম, মৌলভী মুজিবুর রহমান, মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদি প্রমুখ মুসলিম নেতা ও জে এম সেনগুপ্ত, শরত চন্দ্র বসু, জে এম দাশ গুপ্ত, বিধান চন্দ্র রায় প্রমুখ হিন্দু নেতাদের সহায়তায় বেঙ্গল প্যাক্ট চুক্তিটি রচিত হয়।[2] সে বছরের ১৬ ডিসেম্বর স্বরাজ্য দল এবং ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি এই চুক্তি অনুমোদন করে।[1][2] প্রদেশে স্বনিয়ন্ত্রিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে চুক্তি কার্যকর হবে বলে ঘোষণা করা হয়।[1]

চুক্তির কতিপয় ধারা ছিল:[1]

  1. বঙ্গীয় আইন সভায় প্রতিনিধিত্ব পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর মাধ্যমে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।
  2. স্থানীয় পরিষদসমূহে প্রতিনিধিত্বের অনুপাত হবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শতকরা ৬০ ভাগ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শতকরা ৪০ ভাগ।
  3. সরকারি চাকরির ৫৫% পদ পাবে মুসলিমরা। যতদিন ঐ অনুপাতে না পৌছানো যায় ততদিন মুসলিমরা পাবে ৮০% এবং হিন্দুরা পাবে ২০%। সরকারি চাকরি ছাড়াও কলকাতা কর্পোরেশন, জেলা ও স্থানীয় বোর্ড তথা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে মুসলিমরা ঐ হারে চাকরি পাবে।[2]
  4. কোনো সম্প্রদায়ের স্বার্থের পরিপন্থি কোনো আইন বা সিদ্ধান্ত ঐ সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ৭৫% এর সম্মতি ছাড়া উপস্থাপন করা যাবে না।
  5. মসজিদের সামনে বাদ্য সহকারে শোভাযাত্রা করা যাবে না।
  6. খাদ্যের জন্য গরু জবাই নিয়ে আইন সভায় কোনো আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া যাবে না। আইন সভার বাইরে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা আনার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। গরু জবাই করার সময় যাতে তা হিন্দুদের দৃষ্টিতে পড়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করে তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ধর্মীয় কারণে গরু জবাইয়ের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না।

প্রতিক্রিয়া

হিন্দু প্রতিক্রিয়া

অধিকাংশ হিন্দু নেতা এই চুক্তির প্রতি বিরূপ ছিলেন। চুক্তি বিরোধী হিন্দু নেতৃবৃন্দ বলেন যে স্বরাজ্য দল ও কংগ্রেস কমিটি এই চুক্তি পাস করলেও কংগ্রেসের প্রকাশ্য অধিবেশনে চিত্তরঞ্জন দাশ ব্যর্থ হবেন। শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী,[2] সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী‌ ও বিপিন চন্দ্র পাল এই চুক্তির বিরোধিতা করেন এবং তারা একে একতরফা বলে অভিযোগ করেন। হিন্দু গণমাধ্যমগুলো এর বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু করে।[1] চিত্তরঞ্জন দাশের বিরুদ্ধে লেখক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখালেখি করেন।[2] চিত্তরঞ্জন দাশকে অনেকেই সুবিধাবাদি ও মুসলিমদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ করলেও তিনি তার মতে অটল ছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি হিন্দু মুসলিম ঐক্যে বিশ্বাসী ছিলেন এবং চুক্তির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।[1]

অনেক হিন্দু নেতা চিত্তরঞ্জন দাশের বিরোধিতা করলেও তার সমর্থক হিন্দু নেতৃবৃন্দও ছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, কিরণশংকর রায়, অনিলবরণ রায়, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল ও প্রতাপচন্দ্র গুহ।[1]

মুসলিম প্রতিক্রিয়া

চুক্তির কারণে চিত্তরঞ্জন দাশ মুসলিমদের মধ্যে জনপ্রিয় হন। মুসলিমরা চিত্তরঞ্জন দাশের পরিকল্পনার প্রতি তাদের সমর্থন জানায়। তাদের দৃষ্টিতে চুক্তিটি সাম্প্রাদায়িক দ্বন্দ্বের মূলে আঘাত হানবে।[1] ন্যায্য দাবির প্রতি হিন্দু নেতাদের পদক্ষেপের কারণে মুসলিম গণমাধ্যমগুলো হিন্দু নেতৃবৃন্দের প্রতি ধন্যবাদ প্রকাশ করে।[1]

সিরাজগঞ্জ সম্মেলন

১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কোকোনদ অধিবেশন হয়। এই অধিবেশনে চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করা হয়। তাই চুক্তি পাস করানোর জন্য চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৪ সালের জুনে সিরাজগঞ্জে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলন করেন এবং চুক্তি অনুমোদনের সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ এই অধিবেশনের সভাপতি হন।[2] অধিবেশনে প্রায় পনের হাজার প্রতিনিধি যোগ দেন।[2] প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে চুক্তি অধিবেশনে গৃহিত হয়।[2]

সম্মেলনে চিত্তরঞ্জন দাশ বলেন:

হিন্দুরা যদি মুসলমানের মনে আস্থা সৃষ্টি করিতে না পারে, তবে হিন্দু-মুসলিম-ঐক্য আসিবে না। হিন্দু-মুসলিম-ঐক্য ব্যতীত আমাদের স্বরাজের দাবি চিরকাল কল্পনার বস্তুই থাকিয়া যাবে।[2]

চূড়ান্ত ফলাফল

১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু ফলে চুক্তিটি আর বাস্তবায়িত হয়নি।[1] তার অনেক অনুসারীও তার মৃত্যুর পর এই পথ থেকে সরে আসে।[1]

চুক্তি ব্যর্থ হওয়ায় মুসলিমরা মর্মাহত হয়। মুসলিমদের কাছে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অদূরদর্শী ও অতি স্বার্থপর হিসেবে বিবেচিত হয়। অনেকে কংগ্রেস ও স্বরাজ্য দল থেকে সরে দাঁড়ান। ১৯২৬ সালে মৌলভী আবদুল করিম, মওলানা আব্দুর রউফ, খান বাহাদুর আজিজুল হক, মুহম্মদ আবদুল্লাহিল বাকী, মৌলভী আশরাফউদ্দীন, ড. এ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক প্রমুখ নেতা ইনডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি গঠন করেন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী‌ এর সাময়িক সম্পাদক হন। চুক্তির ব্যর্থতা মুসলিমদের চেতনায় আলোড়ন তোলে এবং ভবিষ্যত রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে পুনর্বিবেচনা দেখা দেয়।[1]

তথ্যসূত্র

  1. http://bn.banglapedia.org/index.php?title=বেঙ্গল_প্যাক্ট,_১৯২৩
  2. আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, লেখক-আবুল মনসুর আহমদ
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.