নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা নওয়াব। তিনি অনেকটা নিজের অদম্য ইচ্ছার কারনে শিক্ষিত হন। শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ও সেবাব্রতে তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা ইতিহাসে বিরল ।[1][2]

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী
জন্মফয়জুন্নেসা চৌধুরানী
১৮৩৪
বর্তমান কুমিল্লা জেলার, লাকসাম উপজেলার অন্তর্গত পশ্চিমগাঁ,
(সে সময়ের হোমনাবাদ পরগনা)
মৃত্যু১৯০৩
পেশাজমিদার, সমাজকর্মী, লেখিকা
ভাষাআরবি, ফার্সি, বাংলা ও সংস্কৃত
শিক্ষাপারিবারিক গৃহ শিক্ষকের মাধ্যমে আরবি, ফার্সি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার১৮৮৯ সালে মহারাণী ভিক্টরিয়ার নির্দেশক্রমে 'নওয়াব' উপাধি
সঙ্গীজমিদার সৈয়দ মোহাম্মদ গাজী
সন্তানদুই কন্যা আরশাদুন্নেসা এবং বদরুন্নেসাসহ
আত্মীয়বাবা-জমিদার আহমদ আলী চৌধুরী, মা-আরাফান্নেসা চৌধুরাণী

জন্ম

নওয়াব ফয়জুন্নেসার জন্ম কুমিল্লা জেলার হোমনাবাদ পরগনার (বর্তমানে লাকসামের) অন্তর্গত পশ্চিমগাঁয়ে । তিনি ১৮৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন । তার বাবার নাম আহমেদ আলী চৌধুরী , বাবা জমিদার আর মা-আরাফান্নেসা চৌধুরাণী[3][4][5]

ব্যক্তিগত ও কর্মজীবন

প্রথম জীবন

তিনি তার বাবার প্রথম কন্যাসন্তান।[6] সে সময় জমিদার বংশের সন্তান হিসেবে বেশ আরাম-আয়েশের মধ্য দিয়ে তিনি বেড়ে ওঠেন। মোগল রাজত্বের উত্তরসূরী এই মহীয়সী নারীর দুই ভাই( এয়াকুব আলী চৌধুরী এবং ইউসুফ আলী চৌধুরী) আর দু’বোন (লতিফুন্নেসা চৌধুরাণী এবং আমিরুন্নেসা চৌধুরাণী) ছিল । ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ায় তার প্রচুর আগ্রহ দেখে তার বাবা তার জন্য একজন গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন। তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তিতা পালন করে তার জ্ঞানস্পৃহাকে আরো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তোলেন। গৃহশিক্ষকের সাহায্যে ফয়জুন্নেসা খুব দ্রুতই কয়েকটি ভাষার উপর গভীর জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন । বাংলা, আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত এ চারটি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ সহ ফয়জুন্নেসার এ প্রতিভা স্ফুরণে তার শিক্ষক তাজউদ্দিনের অবদান অতুলনীয়।[7]

বিয়ে

সে সময়ের আরেক স্বনামধন্য জমিদার সৈয়দ মোহাম্মদ গাজীর সাথে ১৮৬০ সালে তার বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন মোহাম্মদ গাজীর দ্বিতীয় স্ত্রী। তার দাম্পত্য জীবন খুব একটা সুখের হয়নি। । এক পর্যায়ে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে । স্বামী বিচ্ছেদের পর তিনি সমাজ সংস্কারগঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কথিত আছে নওয়াব ফয়জুন্নেসা ১৮৭১ সালে বিয়ের সতের বছর পর জানতে পারেন তার স্বামীর আরেকটি স্ত্রী আছে । তাই সতীন থেকে পৃথক থাকার জন্য তিনি তার বিয়ের কাবিনের এক লক্ষ এক টাকা দিয়ে পশ্চিমগাও এ সাড়ে তিন একর জমিতে একটা বাড়ি করেন । এটি নির্মাণ করতে তিন বছরের মত সময় লেগেছিল।[8]

জমিদারি লাভ

তিনি জমিদারি পরিচালনার প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন । তাছাড়া বুদ্ধির দীপ্ততা, বিচক্ষণতা আর কর্মদক্ষতায় তিনি অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন । তাই ১৮৭৩ সালে তার বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি পশ্চিমগাঁও-এর জমিদারি লাভ করেন এবং ১৮৮৫ সালে মায়ের মৃত্যুর পর তিনি মাতুল সম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হন।

জমিদারি পরিচালনা

ফয়জুন্নেসা ছিলেন হোমনাবাদ পরগনার জমিদার। তিনি তার চিন্তা কাজ কর্মে ছিলেন সে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক। সেকালের সমাজ ব্যবস্থার সবরকম বাঁধা পেরিয়ে তিনি সম্পূর্ণ কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠনে মনযোগ দিয়েছিলেন । তাই একজন নারী হয়েও সে সময়ে জমিদারির কঠোর দায়িত্ব তিনি সফলভাবে পালন করতে পেরেছেন । তিনি নির্ভীকভাবে শাসনকাজ পরিচালনা করেন। তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে ওয়ারিশদের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেন আর নিজ জমিদারিটি পরিণত করেন 'ওয়াকফ' সম্পত্তি হিসেবে।[9]

জমিদার ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণীর অবদান

সমাজ সংস্কার

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা নওয়াব। তিনি সমাজ সংস্কারের অংশ হিসেবে মেয়েদের শিক্ষার প্রতি জোর প্রচেষ্টা করেন । ১৮৭৩ সালে ('বেগম রোকেয়া'র জন্মের সাত বছর পূর্বেই) নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে তিনি মেয়েদের জন্য কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। উপমহাদেশের বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রাচীন স্কুলগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।

শিক্ষা প্রচার

দেশে বিদেশে শিক্ষার প্রচারে তার অবদান অনস্বীকার্য। নওয়াব ফয়জুন্নেসা (পশ্চিমগাঁয়ে) একটি অবৈতনিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসার ছাত্রদের অন্য একটি ছাত্রাবাসও ছিল।মাদ্রাসার ভালো ফলাফলে উৎসাহিত হয়ে পরবর্তিকালে তার (ফয়জুন্নেসার) বংশধরগণ ১৯৪৩ খ্রীঃ এটিকে উচ্চ মাধ্যমিক ইসলামিক কলেজে রূপান্তরিত করেন। ১৯৬৫ খ্রীঃ কলেজটি একটি ডিগ্রী কলেজে রূপান্তরিত হয়ে নওয়াব ফয়জুন্নেসা ডিগ্রী কলেজ নামে আখ্যায়িত হয়। ১৯৮২ খ্রীঃ এ কলেজটির সরকারিকরণ হয় এবং নাম হয় নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ । তাছাড়া তিনি আর তার কন্যা বদরুন্নেসা পশ্চিমগাঁওয়ে নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। মেয়েদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য তিনি সব সময় উৎসাহিত করতেন। তিনি মেয়েদের জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার জমিদারির আয় থেকে মেয়েদের জন্য নির্মিত এ হোস্টেলের সব খরচ বহন করা হতো। মেয়েদের জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন । তিনি পবিত্র মক্কা শরিফে 'মাদ্রাসা-ই-সওলাতিয়া ও ফোরকানিয়া সহ বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে প্রচুর পরিমানে সহায়তা করেন।

বিবিধ

শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেয়েদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও সুচিকিৎসারও ব্যবস্থা করেন । ১৮৯৩ সালে কুমিল্লা শহরে প্রতিষ্ঠা করেন 'ফয়জুন্নেসা জানানা হাসপাতাল'। ১৮৯৩ সালে নওয়াব বাড়ির কাছেই তিনি মেয়েদের জন্য একটি স্বতন্ত্র হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন । তিনি ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অনেকগুলো দাতব্য প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এতিমখানাএবং সড়ক নিমার্ণ করে তার মানবতাবাদী ও সমাজ সংস্কারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি নওয়াব বাড়ীর সদর দরজায় একটি দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৪ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করার সময় তিনি মক্কায় হাজীদের জন্য একটি 'মুসাফিরখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের এদেশে তখন বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বিদ্যমান ছিল । নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারী জনহিতকর কাজেও প্রচুর অর্থ দান করতেন ।

সাহিত্য চর্চা

রবীন্দ্রযুগে যে কয়জন বাংলা সাহিত্য সাধনা করে যশ ও খ্যাতি অর্জন করেন, নবাব ফয়জুন্নেসা তাদের মধ্যে অন্যতম।[10] আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে নবাব ফয়জুন্নেসার নাম চিরস্মরণীয়।

তার সাহিত্য সাধনার খুব অল্প সময়ে তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক লেখক। শুধু তাই নয় প্রথম মুসলিম গদ্য-পদ্যে লেখিকা ছিলেন। ১৮৭৬ খ্রীস্টাব্দে ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা গিরিশচন্দ্র মুদ্রণ যন্ত্র থেকে শ্রীমতি নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী রচিত সাহিত্য গ্রন্থ ‘রূপজালাল' প্রকাশিত হয়।

বৃটিশ অপশাসনের ফলে মুসলিম সমাজে কুসংস্কারের বেড়াজালে অবরোধবাসিনী হয়েও ফয়জুন্নেসা সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে একটি গৌরবময় স্থান অধিকার করে আছেন। ‘রূপজালাল' ব্যতীত ফয়জুন্নেসা কর্তৃক দু'খানি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়-‘সঙ্গীত লহরী'‘সঙ্গীত সার' প্রকাশিত হলেও তা এখন দুষ্প্রাপ্য। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না সাহিত্য সাধনায় ফয়জুন্নেসার পথ ধরে বেগম রোকেয়ার আবির্ভাব হয়েছে । বাংলার নারীদের সাহিত্যে অবদানে নওয়াব ফয়জুন্নেসা সর্বাগ্রে।

স্বীকৃতি

ভারতের নিভৃত পল্লীর এ বিদূষী রমণী বেঁচে থাকতে তার কাজের স্বীকৃতি সেভাবে পাননি । মহারাণী ভিক্টরিয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ফয়জুন্নেসাকে বেগম এবং এর পর নওয়াব উপাধি দেন । ১৮৮৯ সালে তার নির্দেশক্রমে ফয়জুন্নেসাকে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে 'নওয়াব' উপাধি দেয়া হয়।

২০০৪ সালে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।

মৃত্যু

১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এ মহীয়সীর জীবনাবসান ঘটে। তাকে তার প্রতিষ্ঠিত দশগুম্বুজ মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. "নওয়াব ফয়জুন্নেসার বাড়ির পলেস্তারা খসে পড়ছে"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯
  2. "লাকসামে নওয়াব ফয়জুন্নেছার বাড়িতে উন্মুক্ত জাদুঘর"Daily Nayadiganta। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯
  3. "নওয়াব ফয়জুন্নেসার বাড়ি ধ্বংসের পথে | বাংলাদেশ প্রতিদিন"Bangladesh Pratidin (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯
  4. "নারী জাগরণের অগ্রদূত নওয়াব ফয়েজুন্নেসা চৌধুরানী"The Daily Sangram। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯
  5. "নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীএশিয়ার মহীয়সী নারী | মহিলা অঙ্গন | The Daily Ittefaq"archive1.ittefaq.com.bd। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯
  6. লাকসামের নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর জীবনী।
  7. "চৌধুরানী, নবাব ফয়জুন্নেসা - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯
  8. "নওয়াব ফয়জুন্নেছার বাড়ি হবে উন্মুক্ত জাদুঘর"সমকাল (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯
  9. "'কুমিল্লাকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলা হবে' | banglatribune.com"Bangla Tribune। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১৯
  10. "নওয়াব ফয়জুন্নেসার সাহিত্য চর্চা"। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ মে ২০১৩
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.