তিরুমালা ধ্রুব বেরা

তিরুমালা ধ্রুব বেরা হল ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের প্রধান উপাস্য দেবতা বেঙ্কটেশ্বরের মূল বিগ্রহটির নাম। দক্ষিণ ভারতে ধ্রুব বেরা বলতে কোনো মন্দিরের প্রধান উপাস্য দেবতাকে বোঝায়। এই শব্দটির আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘স্থায়ী বিগ্রহ’। মন্দিরের ‘ধ্রুব বেরা’ গর্ভগৃহের বাইরে আনা হয় না। গর্ভগৃহের বাইরে বিশেষ ‘পূজা’ বা ‘সেবা’য় ধ্রুব বেরার প্রতিনিধিত্ব করে অন্যান্য বিগ্রহগুলি। ধ্রুব বেরাকে মূলাবর বা মূল বিরাট (প্রধান দেবতা) ও অচলও (প্রধান) বলা হয়।

তিরুমালা ধ্রব বেরাকে স্বয়ম্ভু মনে করা হয়। ভক্তেরা বিশ্বাস করেন, এই মূর্তিটি মানুষের হাতের তৈরি নয়। শ্রীবেঙ্কটাচল মাহাত্ম্যম্‌ অনুসারে, কলিযুগে ভক্তদের ত্রাণ করতে, এখানে এই বিগ্রহে বেঙ্কটেশ্বর বাস করেন। বিগ্রহটি ‘আগম’ (মূর্তি নির্মাণ শাস্ত্র) অনুসারে নির্মিত নয়। সেই কারণেই এটিকে স্বয়ম্ভু মনে করা হয়।

বিবরণ

ধ্রুব বেরার উচ্চতা ১০ ফুট।[1] এটি ১৮ ইঞ্চির একটি বেদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে। বেদীটি সাধারণ পদ্মের আকৃতি-বিশিষ্ট। এই বেদীতে খোদিত লিপিটি মন্দিরের ‘অর্চক’ বা পুরোহিত ছাড়া কেউই পড়তে পারেন না। বেদীটি সাধারণত তুলসী পাতায় ঢাকা থাকে। শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার বিকেলে এবং শুক্রবারের অভিষেকম্‌ সেবার সময় তুলসী পাতাগুলি সরিয়ে নেওয়া হয়।[2]

বেঙ্কটেশ্বরের বিগ্রহটির সুন্দর কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বিগ্রহের নাকটি চ্যাপ্টাও নয়, আবার স্পষ্টও নয়। চোখদুটি স্পষ্ট এবং ‘পচকর্পূরমে’ (কাচা কর্পূর) নির্মিত ‘নামমে’র (তিলক) তলায় আংশিক ঢাকা। নামমের আকার, আকৃতি ও বিস্তারিত বর্ণনা বৈখানস আগমের কঠোর নিয়ম অনুসারে নির্ধারিত হয়। মূর্তিটির মাথায় একটি স্বয়ম্ভু মুকুট রয়েছে এবং কাঁধের কাছে ‘জটাজুট’ দেখা যায়। বিগ্রহের বক্ষস্থল চওড়ায় ৩৬ থেকে ৪০ ইঞ্চি এবং কোমরটি চওড়ায় ২৪ থেকে ২৭ ইঞ্চি। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কখনও বুক বা কোমর মাপা হয়নি। বিগ্রহের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত হওয়ায় বুকটি স্পষ্ট দেখা যায়। বুকের ডানদিকে উপবিষ্ট শ্রীদেবীর একটি মূর্তি খোদিত রয়েছে। লক্ষ্মীর এই খোদাইচিত্রটির বিগ্রহের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বেঙ্কটেশ্বর বিগ্রহের চারটি হাত রয়েছে। উপরের হাতগুলিতে রয়েছে চক্রম্‌শঙ্খ। এদুটি বিগ্রহের অংশ নয়। সুদর্শন চক্রটি উপরের ডান হাতে এবং পাঞ্চজন্য শঙ্খটি উপরের বাঁ হাতে ধরানো আছে। নিচের ডান হাতটি ‘বরদা হস্ত’ ভঙ্গিতে রয়েছে। এই ভঙ্গিতে হাতের তালুটি দর্শনার্থীর দিকে বরদানকারী ভঙ্গিতে ন্যস্ত। নিচের বাঁ হাতটি রয়েছে ‘কাত্যাবলম্বিত’ ভঙ্গিতে। এই ভঙ্গিতে হাতের তালু বিগ্রহের দিকে বুড়ো আঙুলটি প্রায় কোমরের সমরেখায় ন্যস্ত। বিগ্রহের নিম্নাঙ্গটি ধূতি-পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। দুটি হাঁটুই সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে আছে। এটি ভক্তদের ত্রাণকার্যে বেঙ্কটেশ্বরের ইচ্ছার প্রতীক। কাঁধে ধনুক ও তীর-ভরা তুনীর বহনের দাগ দেখা যায়। যদিও তিরুমালা রাম বিগ্রহের মতো মূর্তিটিতে ‘ত্রিভঙ্গ’ ভঙ্গিমা দেখা যায় না।[2]

অলংকার

তিরুমালা ধ্রুব বেরার গায়ে একাধিক অলংকার দেখা যায়। বিগ্রহের অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে ‘যজ্ঞোপবীত’ (পৈতে) দেখা যায়। পৈতেটি বাঁ কাঁধ থেকে কোমরের ডান দিক পর্যন্ত লম্বিত রয়েছে। বিগ্রহের গায়ে চার সেট হার দেখা যায়। এছাড়া ধূতির উপর দু-ইঞ্চি পুরু একটি ‘কটিবন্ধম্‌’ (কোমরবন্ধ) দেখা যায়। বাহুতে বাহুবন্ধ এবং পায়ের গোড়ালির কাছেও কয়েকটি অলংকার দেখা যায়। বিগ্রহের কানে দুল দেখা যায়। এছাড়া বেঙ্কটেশ্বরের গায়ে মুদ্রার মালাও দেখা যায়।[2]

সেবা

দৈনিক সেবা

গর্ভগৃহে আয়োজিত প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানের কেন্দ্রে থাকেন তিরুমালা ধ্রুব বেরাম। সুপ্রভাতম্‌ সেবার মাধ্যমে বেঙ্কটেশ্বরকে জাগরণ করানোর পর ‘শুদ্ধি’ করা হয়। শুদ্ধি অনুষ্ঠানে আগের দিনের ফুল বিগ্রহ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। তারপর দৈনিক প্রার্থনার জন্য ‘আকাশগঙ্গা তীর্থম্‌’ থেকে পবিত্র জল আনা হয়।তোমল সেবার সময় পায়ের সোনার ‘কবচম্‌’ খুলে সেটির ‘অভিষেকম্‌’ করা হয়। মন্দিরের ‘কৌতুক বেরাম্‌’ ভোগ শ্রীনিবাস বিগ্রহটিতে ধ্রুব বেরার প্রতিনিধি রূপে রোজ অভিষেকম্‌ করা হয়। তোমল সেবার পর রোজ প্রধান বিগ্রহে সহস্রনামার্চনা বা শ্রীনিবাসের ১০০০ নাম আবৃত্তি আয়োজিত হয়। দিনে তিন বার ‘নৈবেদ্যম্‌’ (নৈবেদ্য) উৎসর্গ করা হয়। নৈবেদ্য উৎসর্গের আগে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা হয়।[3] প্রথম নৈবেদ্যম্‌ (যাকে প্রথম ঘণ্টাও বলা হয়) উৎসর্গের পর প্রবন্ধম্‌ পাঠ করা হয়। দ্বিপ্রহর ও দ্বিতীয় নৈবেদ্যম্‌ (যাকে দ্বিতীয় ঘণ্টাও বলা হয়) উৎসর্গের আগে পাঠ করা হয় ‘অষ্টোত্তরনাম’ (বেঙ্কটেশ্বরের ১০৮ নাম)। এটি একটি ঐকান্তিক সেবা।[4] সন্ধ্যায় মালায়াপ্পা স্বামী বিগ্রহ সহস্র দীপালংকার সেবা থেকে ফেরার পর তোমল সেবা, অর্চনা ও নৈবেদ্যম্‌ উৎসর্গিত হয়। এটিকে ‘নৈশ কৈনকার্যম্‌’ বলা হয়।[5] প্রধান বিগ্রহকে নৈবেদ্যম্‌ নিবেদনের পর অন্যান্য বিগ্রহেও নৈবেদ্য নিবেদিত হয়।

সাপ্তাহিক সেবা

দৈনিক সেবা ছাড়াও প্রতি বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ঘণ্টার পর অষ্টদল পাদপদ্মারাধনা সেবা আয়োজিত হয়। এই অনুষ্ঠানে পুরোহিতেরা বেঙ্কটেশ্বরের ১০৮টি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বিগ্রহের পায়ে একটি একটি করে সোনার পদ্মফুল দেন। বেঙ্কটেশ্বরের পত্নীদের অর্চনার পর দুই ধরনের ‘আরতি’ করা হয়।[6] বৃহস্পতিবার ধ্রুব বেরার তিরুপ্পাবদ সেবা আয়োজিত হয়। এই সেবা হয় গর্ভগৃহের তিরুমামনি মণ্ডপমে। এই সেবার সময় প্রচুর পরিমাণে ‘পুলিহোরা’ (হলুদ-মাখানো ভাত) পিরামিডের আকারে স্তুপীকৃত করে পায়সম্‌, লাড্ডু, জিলিপি ও আপ্পামের সঙ্গে নির্দিষ্ট মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে উৎসর্গ করা হয়।[7] শুক্রবার ‘পঞ্চসূক্তম্‌’ (‘পুরুষসূক্তম্‌’, ‘শ্রীসূক্তম্‌’, ‘নারায়ণসূক্তম্‌’, ‘ভূসূক্তম্‌’ ও ‘নীলসূক্তম্‌’ – এই পাঁচটি সূক্তম্‌) ও প্রবন্ধম্‌ আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে অভিষেকম আয়োজিত হয়।[8]

তথ্যসূত্র

  1. Sri Venkateswara, the lord of the seven hills, Tirupati,Page 17,P.Sitapati, 1968TTD। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-১০
  2. The Tirumala TempleTirumala: Tirumala Tirupati Devasthanams। ১৯৮১। Authors list-এ |প্রথমাংশ1= এর |শেষাংশ1= নেই (সাহায্য)
  3. "First Bell"TTD। ২০০৭-০৫-১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-১০
  4. "Second Bell"TTD। ২০০৭-০৫-১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-১০
  5. "Night Kainkaryams"TTD। ২০০৭-০৫-১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-১০
  6. "Ashtadala Pada Padmaaradhana Seva"TTD। ২০১২-০৪-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-১০
  7. "Tiruppavada Seva"TTD। ২০১২-০৪-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-১০
  8. "Abhishekam"TTD। ২০১২-০৪-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-১০

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.