জলবিদ্যুৎ
জলবিদ্যুৎ পড়ন্ত বা স্রোত আছে এমন নদীর পানির চাপকে ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এটি নবায়নযোগ্য শক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। একবার যদি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব হয়, খুব কম শক্তি ব্যয়ের মাধ্যমে এটি চালানো যায়। এবং এটা জীবাশ্ম জ্বালানী, যেমন: তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদিচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় খুব কম পরিমাণে গ্রীনহাউস গ্যাস কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন করে। পানিবিদ্যুৎ পৃথিবীর মোট বিদ্যুতের ২০% এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ৮৮%।[1]

ইতিহাস
== বিদ্যুৎ উৎপাদন ==থেকে
সুবিধা

অর্থনৈতিক সুবিধা
জলবিদ্যুতের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল অন্যান্য বিদ্যুতের তুলনায় এটি অনেক সস্তা। তাছাড়া জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র জ্বালানী-নির্ভর বিদ্যুৎ থেকে অনেক দীর্ঘস্থায়ী। এখনো কিছু জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে যা ৫০-১০০ বছর আগে তৈরি হয়েছিলো।[2] যেহেতু এটা স্বযংক্রীয়, তাই শ্রমিক খরচও কম পড়ে। তাছাড়া এর নির্মাণ ব্যয়ও কম। যেমন: হিসাব করে দেখা গেছে যে, থ্রি জর্জেস বাঁধ হতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রি করে ৫-৮ বছরের মধ্যেই এর নির্মাণ ব্যয় তুলে ফেলা যায়।
স্বল্প গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন
যেহেতু জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কোনো ধরনের জ্বালানী পোড়ানো হয় না, তাই এখান থেকে সরাসরি কোনো কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হয় না। যদিও সামান্য কিছু কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বানাতে অর্থাৎ যন্ত্রপাতি তৈরি করতে। ফলে এর গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনকারী জ্বালানীনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় খুবই কম। ইউরোপিয়ান কমিশনের অর্থায়নে শক্তির উৎসগুলোর গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনের হারের পরীক্ষা চালানো হয় ExternE প্রজেক্টে। গবেষণা অনুযায়ী জলবিদ্যুৎ অন্য যেকোনো বিদ্যুৎ-উৎস থেকে কম গ্রীনহাউজ গ্যাস উৎপন্ন করে।[3] এ তালিকায় দ্বিতীয় হলো বায়ু শক্তি, তৃতীয় পারমাণবিক শক্তি এবং চতুর্থ সৌরশক্তি।[3] সবচেয়ে বেশি পরিমাণ গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন হয় অধিক তাপমাত্রায়। কারণ তাপ বাড়লে পানির প্রসারণ ঘটে এবং আয়তন বাড়ে। ফলে পানির চাপ বাড়ে, আর চাপই হলো জলবিদ্যুতের চালনশক্তি।
অন্যান্য
জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, জলক্রীড়া আয়োজন করার মাধ্যমে পর্যটনশিল্পেও ভূমিকা রাখে। ফসলের জমিতে অবিচ্ছিন্ন সেচ দিতে বাঁধের মাধ্যমে পানি নিয়ন্ত্রন করা হয়। বড় বাঁধগুলোর সাহায্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
অসুবিধা
বাঁধ ধ্বসে পড়া
বাঁধ ধ্বসে পড়া মানবসৃষ্ট সবচেয়ে বড় দুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। এমনকি ভালো নকশা দ্বারা প্রস্তুতকৃত বাঁধও শতভাগ নিরাপদ নয়। যেমন: বাঙ্কিয়াও বাঁধ ধ্বসে পড়ে দক্ষিণ চীনে তাৎক্ষণিকভাবে ২৬,০০০ মানুষ মারা যায়। লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হয়। ভুল জায়গায় বাঁধ স্থাপনের কারণে, বাঁধ অনেক ভয়ানক দুর্যোগও বয়ে আনতে পারে, যেমন ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইতালিতে ভেয়ন্ট বাঁধ-এর কারণে ২,০০০ মানুষ মারা যায়।
বিভিন্ন আকারের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র
বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র
যদিও ঠিক কতটুকু ক্ষমতার অধিকারী হলে একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে 'বড়' বলা যাবে তার সীমা নেই, তারপরও কয়েকশ' মেগাওয়াট থেকে ১০ গিগাওয়াটেরও বেশি ক্ষমতার পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকেই সাধারণত 'বড়' বলা হয়। বর্তমানে শুধুমাত্র তিনটি কেন্দ্র আছে যা ১০ গিগাওয়াটের থেকেও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম; সেগুলো হলো: ত্রি জর্জেস ড্যাম (২২.৫ গিগাওয়াট), ইটাপু ড্যাম (১৪ গিগাওয়াট), গুরি ড্যাম (১০.২ গিগাওয়াট)। বড় পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোই সাধারণত সবচেয়ে বেশি শক্তির উৎস হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এমন কিছু পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে যা বর্তমানের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর দ্বিগুণের চেয়েও বেশি শক্তি উৎপাদন করে থাকে।
ছোট জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র
যদিও বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকেই অধিকাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছোট কেন্দ্রেরও প্রয়োজন আছে। ১০ মেগাওয়াট বা তার কম ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকেই সাধারণত ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বলা হয়। অবশ্য উত্তর আমেরিকার প্রজেক্টে এর সীমা ৩০ মেগাওয়াট পর্যন্ত। একটি ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি বিদ্যুৎ বিতরণ গ্রীডের সাথে যুক্ত থাকতে পারে, থাকতে পারে শুধুমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন এলাকার সাথে অথবা শুধুমাত্র কোনো একটি বাসার সাথে। ছোট কেন্দ্রে সাধারণত অর্থ, প্রযুক্তি এবং পরিবেশগত সুযোগ সুবিধা জরিপ করে দেখতে হয় না, যেখানে বড় প্রকল্পে এসবে যথেষ্ট সময় এবং গুরুত্ব দিতে হয়। তাই প্রায়ই এইসব ছোট প্রকল্প খুব দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করা যায়। এইসব ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ এবং অন্যান্য প্রকল্পের সাথেও তৈরি করা হয়। এর ফলে সেসব প্রকল্পের খরচ কমে যাবার সাথে সাথে সেগুলোর বাস্তবায়নও সহজতর হয়।
ছোট জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র চীনে বেশ জনপ্রিয়। সেখানেই বিশ্বের ৫০% ছোট জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র অবস্থিত।
শক্তির পরিমাপ
একটি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সম্ভাব্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের সহজ সূত্র হলো: P = ρhrgk, যেখানে
- P হল ক্ষমতা (ওয়াট),
- ρ হলো পানির ঘনত্ব (~১০০০ কিঃগ্রাঃ/মিঃ২),
- h হলো উচ্চতা (মিটার)
- r হলো ফ্লু রেট (কিউবিক মিটার/সেকেন্ড)
- g হলো অভিকর্ষজ ত্বরণ (৯.৮ মি./সেকেন্ড২)
- k হলো সমানুপাতিক ধ্রুবক
সর্বোচ্চ জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশসমূহ
ব্রাজিল, কানাডা, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড এবং ভেনেজুয়েলা হলো একমাত্র দেশ যেখানে পানিবিদ্যুৎ, শক্তির প্রধান উৎস। প্যারাগুয়ে হচ্ছে এমন একটি দেশ যেখানে শুধুমাত্র শক্তির ১০০% উৎসই জলবিদ্যুৎ নয়, বরং তাদের মোট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ৯০%ই অন্যান্য দেশে (ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনায়) রপ্তানি করা হয়। নরওয়ের মোট বিদ্যুতের ৯৮-৯৯% আসে পানিবিদ্যুৎ থেকে।[4]
দেশ | বার্ষিক জলবিদ্যুৎ উৎপাদন(TWh) | উৎপাদন ক্ষমতা(GW) | ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর | দেশের মোট বিদ্যুতের শতকরা অংশ |
---|---|---|---|---|
চীন | ৫৮৫.২ | ১৯৬.৭৯ | ০.৩৭ | ২২.২৫ |
কানাডা | ৩৬৯.৫ | ৮৮.৯৭৪ | ০.৫৯ | ৬১.১২ |
ব্রাজিল | ৩৬৩.৮ | ৬৯.০৮০ | ০.৫৬ | ৮৫.৫৬ |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র | ২৫০.৬ | ৭৯.৫১১ | ০.৪২ | ৫.৭৪ |
রাশিয়া | ১৬৭.০ | ৪৫.০০০ | ০.৪২ | ১৭.৬৪ |
নরওয়ে | ১৪০.৫ | ২৭.৫২৮ | ০.৪৯ | ৯৮.২৫ |
ভারত | ১১৫.৬ | ৩৩.৬০০ | ০.৪৩ | ১৫.৮০ |
ভেনেজুয়েলা | ৮৬.৮ | _ | _ | ৬৭.১৭ |
জাপান | ৬৯.২ | ২৭.২২৯ | ০.৩৭ | ৭.২১ |
সুইডেন | ৬৫.৫ | ১৬.২০৯ | ০.৪৬ | ৪৪.৩৪ |
বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র
দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশে ১৯০৬ সালে সর্বপ্রথম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এদেশের একমাত্র পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র কাপ্তাইয়ে অবস্থিত। কর্ণফুলী নদীর উপর বাঁধ দিয়ে রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় কাপ্তাই বাঁধ তৈরি করা হয়। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে ৪৬ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিট নিয়ে কেন্দ্রটির যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীকালে ৫০ মেগাওয়াট করে আরো তিনটি ইউনিট স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে তিন নম্বর ইউনিটটি ১৯৮২, এবং ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিট চালু হয় ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে। এর মধ্যে প্রথম তিনটি বসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিতে। পরের দুটি স্থাপন করে জাপানের টোকিও ইলেক্ট্রিক পাওয়ার সার্ভিসেস কোম্পানি (টেপ্সকো)। এ দুটি স্থাপনের সময়ই আরো দুটি ইউনিট স্থাপনের জন্য আনুষঙ্গিক সুবিধা রেখে দেয়া হয়। জাপানী এই প্রতিষ্ঠানটিই ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে সেখানে আরো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব কিনা সে বিষয়ে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই করে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে তারা জানায়, বর্তমান অবকাঠামো এবং এই পানি দিয়েই কাপ্তাই হ্রদে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আরো দুটি ইউনিট বসানো সম্ভব। তাতে কাপ্তাইয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ আরো কমে আসবে। বর্তমানে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় বিশ পয়সা।
তথ্যসূত্র
- "Renewables Global Status Report 2006 Update, REN21, published 2007, accessed 2007-05-16; see Table 4, p. 20." (PDF)। ২০১১-০৭-১৮ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৩-২৪।
- "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি" (PDF)। ২৮ মে ২০০৮ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০১০।
- http://gabe.web.psi.ch/projects/externe_pol/index.html
- http://www.economist.com/displaystory.cfm?story_id=12970769
বহিঃসংযোগ
- আন্তর্জাতিক জলশক্তি সংস্থা (International Hydropower Association)
- কার্লি-এ জলবিদ্যুৎ (ইংরেজি)
- ইউটিউবে Mechanicville Hydroelectric Station Tour
- National Hydropower Association, USA
- Hydropower Reform Coalition, USA
- ইউটিউবে Lecture - 10 Hydroelectric Power and ইউটিউবে Lecture - 11 Hydroelectric Power
- Interactive site that demonstrates dams' effects on rivers
- Center of expertise on hydropower impacts on fish and fish habitat, Canada
- Hydro-Québec
- CBC Digital Archives – Hydroelectricity: The Power of Water
- University of Washington Libraries – Seattle Power and Water Supply Collection
- International Rivers
- United States Federal Energy Regulatory Commission (FERC)
- European Small Hydropower Association
- Power at Niagara Falls Niagara Falls Public Library (Ont.)
- Milford Hydroelectric Station Restoration Tour Built by Henry Ford in 1939
- 60,000,000 Horsepower Ready to be Harnessed for Work: when these giants are set in action, the real age of electricity will begin and our dreams will become realities, Popular Science monthly, February 1919, page 46-47, Scanned by Google Books: books.google.com