পুণ্য শুক্রবার
পুণ্য শুক্রবার (গুড ফ্রাইডে নামেও পরিচিত) মূলত খ্রিষ্টানদের দ্বারা পালিত একটি ধর্মীয় ছুটির দিন। এই উৎসবের অপর নাম "পবিত্র শুক্রবার", "কালো শুক্রবার", "মহান শুক্রবার"। গলগথায় যিশু খ্রিষ্টের ক্রুসবিদ্ধকরণ, মৃত্যু ও সমাধিমন্দির থেকে তার পুনরুজ্জীবনের স্মরণে এই উৎসবটি পালিত হয়। পবিত্র সপ্তাহে ইস্টার রবিবারের পূর্ববর্তী শুক্রবারে প্যাস্কাল ট্রিডামের অংশ হিসেবে এই উৎসব পালিত হয়। প্রায়শই পুণ্য শুক্রবার ইহুদিদের উৎসব পাসওভারের সঙ্গে একই দিনে উদযাপিত হয়ে থাকে।
পুণ্য শুক্রবার | |
---|---|
![]() ক্রুসবহনরত যিশু | |
ধরন | খ্রিষ্টান |
তাৎপর্য | যিশু খ্রিষ্টের ক্রুসবিদ্ধকরণ স্মরণে পালিত |
উদযাপন | কোনো প্রথাগত উদযাপন নেই |
পালন | প্রার্থনা ও রাত্রিজাগরণ, উপবাস ও ভিক্ষাপ্রদান |
তারিখ | ইস্টার রবিবারের পূর্ববর্তী শুক্রবার |
সম্পর্কিত | ইস্টারের পূর্বে পালিত পাসওভার, বড়দিন (যিশুর জন্মদিন উদযাপন), সেপ্টুয়াগেসিমা, কুইনকাগেসিমা, স্রোভ টিউসডে, অ্যাশ ওয়েডনেসডে, লেন্ট, পাম সানডে, মন্ডি থার্সডে ও হোলি স্যাটারডে; এবং ইস্টারের পরে পালিত ইস্টার সানডে (প্রাথমিকভাবে), স্বর্গারোহণ, পেন্টেকস্ট, হুইট মানডে, ট্রিনিটি সানডে, ও করপাস ক্রিস্টি |
যিশুর বিচারের শাস্ত্রীয় বিবরণীগুলি থেকে অনুমিত হয় যে তাকে সম্ভবত শুক্রবারে ক্রুসবিদ্ধ করা হয়েছিল। দুটি ভিন্ন গোষ্ঠীর মতে পুণ্য শুক্রবারর বছরটি হল ৩৩ খ্রিষ্টাব্দ। আইজ্যাক নিউটন বাইবেলীয় ও জুলিয়ান ক্যালেন্ডার এবং অমাবস্যার তিথি বিচার করে পুণ্য শুক্রবারর যে প্রকৃত সালটি নিরুপণ করেছেন, সেটি হল ৩৪ খ্রিষ্টাব্দ।[1][2][3][4][5][6] ক্রুসিফিকেশন ডার্কনেস অ্যান্ড একলিপস পদ্ধতি (প্রেরিতদের কার্য; ২:২০-এ প্রেরিত পিতর কর্তৃক বর্ণিত "রক্ত চন্দ্র"-এর উল্লেখ অনুসারে) নামে একটি তৃতীয় পদ্ধতিতে হিসেব করে পুণ্য শুক্রবারর তারিখ নিরুপণ করা হয়েছে ৩ এপ্রিল, ৩৩ খ্রিষ্টাব্দ।[7][8]
বাইবেলের বিবরণ

সুসমাচার অনুযায়ী, যিশুর শিষ্য যিহুদা ইসকারিয়োতের সহায়তায় মন্দিরের রক্ষীদল গেৎশিমানি উদ্যানে যিশুকে গ্রেফতার করে। যিশুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার পুরস্কার স্বরূপ যিহুদাকে ৩০টি রৌপ্যমুদ্রা (Matthew 26:14-16) দেওয়া হয়েছিল। যিহুদা রক্ষীদলকে বলে রেখেছিলেন যে তিনি যাঁকে চুম্বন করবেন তিনিই হবেন যিশু। যিশুকে হাননের প্রাসাদে নিয়ে আসা হল। হানন ছিলেন সেই বছরের জন্য নিযুক্ত প্রধান পুরোহিত কায়াফারের শ্বশুর। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বিশেষ ফল না হওয়ায় তাকে প্রধান পুরোহিত কায়াফারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সানহেড্রিয়ান (প্রাচীন ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃপক্ষ) একত্রিত হয় (John 18:1-24)।
যিশুর বিচারসভায় বিভিন্ন সাক্ষী পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্যপ্রদান করেছিল। যিশু সেই প্রসঙ্গে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি। অবশেষে প্রধান পুরোহিত নিজে উঠে যিশুকে শপথপূর্বক নিজ বক্তব্য জানাবার আদেশ দিলেন। তিনি বললেন, “জীবনময় ঈশ্বরের দোহাই, আমাদের বল, তুমিই কি ঈশ্বরের পুত্র সেই খ্রিষ্ট?” যিশু উত্তর দিলেন, “আপনি নিজেই তা বললেন। তাছাড়া আমি আপনাদের বলেছি, এখন থেকে আপনারা দেখবেন মানবপুত্র সর্বশক্তিমানের দক্ষিণে উপবিষ্ট। আবার মেঘবাহনেও তাঁকে নেমে আসতে দেখবেন।” প্রধান পুরোহিত এই কথার জন্য যিশুকে ঈশ্বরনিন্দার দায়ে অভিযুক্ত করলেন। যিশুর সানহেড্রিয়ন বিচার শেষ হল তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার মাধ্যমে।(Matthew 26:57-66) এদিকে বিচার চলাকালীন অঙ্গনে অপেক্ষমাণ পিতর বিচার দেখতে আসা জনগণের নিকট তার সঙ্গে যিশুর সম্পর্কের কথা তিন বার অস্বীকার করলেন। যিশু অবশ্য আগে থেকেই জানতেন যে পিতর তাকে তিনবার অস্বীকার করবেন।
পরদিন সকালে সকল সভাসদগণ যিশুকে রোমান রাজ্যপাল পন্টিয়াস পিলাতের নিকট নিয়ে গেল। তার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ, সিজারকে রাজস্বদানে বাধা ও নিজেকে রাজা ঘোষণা করার অভিযোগ আনা হল (Luke 23:1-2)। পিলাত ইহুদি সমাজপতিদের নিজস্ব আইন অনুযায়ী যিশুর বিচার ও শাস্তিদানের অনুমতি দিলেন। কিন্তু ইহুদি সমাজপতিরা জানালেন রোমান আইন অনুযায়ী তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার অনুমতি নেই (John 18:31)।
পিলাত নিজে যিশুকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন ও ইহুদি বিচারকদের জানালেন যে তিনি যিশুকে শাস্তিদানের কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। যিশু গালিলের লোক জেনে তিনি গালিলের শাসক রাজা হেরোদের উপর যিশুর বিচারের ভার ছেড়ে দিলেন। হেরোদ তারণোৎসব ভোজসভা উপলক্ষে সেই সময় জেরুজালেমেই ছিলেন। হেরোদ যিশুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনো উত্তর পেলেন না। তিনি পুনরায় যিশুকে পাঠিয়ে দিলেন পিলাতের কাছে। পিলাত সমাজপতিদের জানালেন যে তিনি বা হেরোদ কেউই যিশুকে দোষী মনে করছেন না। শেষে পিলাত সমস্যা সমাধানের জন্য যিশুকে শুধুমাত্র চাবুক মেরে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব রাখলেন (Luke 23:3-16)।
তারণোৎসব ভোজসভার রীতি অনুযায়ী এই দিন ইহুদিদের অনুরোধক্রমে রোমানরা একজন বন্দীকে ছেড়ে দিতেন। পিলাত জনসাধারণকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তারা কার মুক্তি চাইছে। প্রধান পুরোহিতের অঙ্গুলি হেলনে জনগণ খুনি বারাব্বাসের মুক্তি চাইল। পিলাত যিশুকে নিয়ে কি করা উচিত সেই ব্যাপারে সকলের মতামত চাইলে সকলেই এক বাক্যে বলল "ওকে ক্রুসবিদ্ধ করুন।" (Mark 15:6-14) পিলাতের স্ত্রী পূর্বরাত্রে যিশুকে স্বপ্নে দেখেছিলেন। তিনি পিলাতকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, "এই ধার্মিক মানুষটির ক্ষতি কোরো না।" (Matthew 27:19)
পিলাত যিশুকে কশাঘাত করে তাকে মুক্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে আবার সর্বসমক্ষে নিয়ে এলেন। প্রধান পুরোহিত তখন যিশুর বিরুদ্ধে ঈশ্বরদ্রোহিতার নতুন অভিযোগটি আনলেন। ভয় পেয়ে পিলাত পুনরায় যিশুকে জিজ্ঞাসাবাস করার জন্য ভিতরে নিয়ে গেলেন।(John 19:1-9)

জনতার সম্মুখে এসে পিলাত আবার যিশুকে নিরপরাধ ঘোষণা করলেন। তিনি জলে হাত ধুয়ে জানিয়ে দিলেন, যিশুর বিচারে আর তিনি অংশ নেবেন না। তবে সম্ভাব্য দাঙ্গা রোখার জন্য এবং নিজের চাকরি রাখতে পিলাত যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন। (Matthew 27:24-26) "নাজারেথের যিশু, ইহুদিদের রাজা" লেখা একটি ক্রুস যিশু বয়ে নিয়ে চললেন গলগথা নামক স্থানে। তাকে ক্রুস বহনে সাহায্য করেছিলেন সাইরিনের সিমন। গলগাথায় অপর দুই অপরাধীর সঙ্গে তাকে ক্রুসবিদ্ধ করা হল (John 19:17-22)।
ছয় ঘণ্টা যিশু ক্রুসে যন্ত্রণাভোগ করেন। শেষ তিন ঘণ্টায় (দুপুর তিনটে থেকে) অন্ধকারে সমগ্র অঞ্চলটি ঢেকে যায়।[9] চিৎকার করে যিশু প্রাণত্যাগ করেন। ভূমিকম্প হয়, সমাধিপ্রস্তরগুলি ভেঙে যায় এবং প্রধান মন্দিরের পর্দা উপর থেকে নিচ অবধি ছিঁড়ে যায়। যে সেঞ্চুরিয়ন ক্রুসবিদ্ধকরণের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন, "ইনি সত্য সত্যই ঈশ্বরপুত্র ছিলেন।" (Matthew 27:45-54)
সানহেড্রিয়ানের সদস্য তথা যিশুর গোপন অনুগামী আরিমাথিয়ার যোসেফ যিশুর বিচারে সম্মতি দেননি। তিনি পিলাতের নিকট যিশুর দেহ চেয়ে নেন (Luke 23:50-52)। নিকদিম নামে যিশুর আর এক গোপন অনুগামী তথা সানহেড্রিয়ানের সদস্য একশো পাউন্ড ওজনের মশলার মিশ্রণ নিয়ে যিশুর দেহ কাপড়ে মুড়তে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলেন (John 19:39-40)। যিশুর মৃত্যু হয়েছে কিনা তা জানতে পিলাত সেঞ্চুরিয়নকে আদেশ দিলেন (Mark 15:44)। এক সৈনিক যিশুর দেহে বর্শার আঘাত করাতে ক্ষতমুখ দিয়ে রক্ত ও জল নির্গত হল। (John 19:34) সেঞ্চুরিয়ন পিলাতকে যিশুর মৃত্যুসংবাদ দিলেন (Mark 15:45)।
আরিমাথিয়ার যোসেফ যিশুর দেহ পরিষ্কার ক্ষৌমবস্ত্রে মুড়ে ক্রুসবিদ্ধকরণক্ষেত্রের অদূরে একটি বাগানে তার নিজের জন্য নির্মাণ করা প্রস্তরখোদিত সমাধিমন্দিরে রেখে দিলেন (Matthew 27:59-60)। নিকদিম (John 3:1) এলেন সোয়া মণ গন্ধরস মেশানো অগুরু নিয়ে। ইহুদি সৎকার প্রথা অনুযায়ী সেগুলি রেখে দিলেন আচ্ছাদন বস্ত্রে যিশুর দেহের সঙ্গে (John 19:39-40)। একটি বড়ো পাথর দিয়ে তারা সমাধির মুখ রুদ্ধ করে দিলেন (Matthew 27:60)। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে সাব্বাথ শুরু হয়ে যাবে বলে তারা শীঘ্র ঘরে ফিরে এলেন (Luke 23:54-56)। তৃতীয় দিন, রবিবার, যিশু পুনরুজ্জীবিত হলেন।
টীকা
- Isaac Newton, 1733, Of the Times of the Birth and Passion of Christ, in "Observations upon the Prophecies of Daniel and the Apocalypse of St. John" (London: J. Darby and T. Browne).
- Bradley Schaefer, 1990, Lunar Visibility and the Crucifixion Quarterly. Journal of the Royal Astronomical Society 31.
- "Astronomers on the Date of the Crucifixion"। ২৫ এপ্রিল ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ অক্টোবর ২০০৯।
- Astronomers on Date of Christ's Death
- John Pratt Newton's Date For The Crucifixion "Quarterly Journal of Royal Astronomical Society", September 1991.
- Newton's Date For The Crucifixion
- Humphreys, Colin J., and W. G. Waddington, "Dating the Crucifixion," Nature 306 (December 22/29, 1983), pp. 743-46. Nature.com
- Colin J. Humphreys and W. G. Waddington, The Date of the Crucifixion Journal of the American Scientific Affiliation 37 (March 1985) ASA3.org ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৮ এপ্রিল ২০১০ তারিখে
- Matthew 27:45; Mark 15:13; Luke 23:44
বহিঃসংযোগ
টেমপ্লেট:Holy Week টেমপ্লেট:Easter টেমপ্লেট:US Holidays