আবুল কালাম আজাদ (বুদ্ধিজীবী)

আবুল কালাম আজাদ (জন্ম: ১ জানুয়ারি, ১৯৩৩[1] - মৃত্যু: ডিসেম্বর ১৫, ১৯৭১[2] একজন বাংলাদেশী গণিতবিদ ও শিক্ষাবিদ ছিলেন। ষাটের দশকে গণিতজ্ঞ হিসেবে তার নাম দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। লন্ডনের রাজকীয় আবহাওয়াবিজ্ঞান সমিতি, যুক্তরাজ্যের ফলিত গণিত সমিতি ও বোস্টনের আবহাওয়াবিজ্ঞান সমিতির ফেলো ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ দেশীয় দোসরদের একটি দল তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

আবুল কালাম আজাদ
জন্ম(১৯২৮-০১-০১)১ জানুয়ারি ১৯২৮
মৃত্যু১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১(1971-12-15) (বয়স ৪৩)
জাতীয়তাবাংলাদেশী
নাগরিকত্ব বাংলাদেশ
পেশাগণিতবিদ, শিক্ষাবিদ, শহীদ বুদ্ধিজীবী
পুরস্কারএকুশে পদক

প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা

আবুল কালাম আজাদের জন্ম কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রামে। শিক্ষাজীবনে গণিতের ছাত্র ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এমএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। আজাদ ছাত্রজীবনে বরাবরই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে রেকর্ড ভাঙ্গা নম্বর নিয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বর্ণপদক পান।[1]

কর্মজীবন

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আজাদ ফ্লাইং অফিসারের পদমর্যাদা নিয়ে অধ্যাপক হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনী একাডেমীতে যোগ দেন। সেখান থেকে প্রশিক্ষণের জন্য তাকে যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়। বিমান বাহিনীতে তার মেধা এবং কৃতিত্ব অবাঙ্গালীরা ভালো চোখে দেখেনি। এজন্যে তার চাকুরির মেয়াদ তারা হঠাৎ শেষ করে দেয়। নিরুপায় হয়ে তিনি তখন ঢাকায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সভাপতির কাছে চাকুরীর সন্ধান চেয়ে চিঠি লেখেন। চিঠির উত্তরে তিনি সাক্ষাৎকারের সুযোগ পান এবং পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারী মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তরল পদার্থসম্পর্কিত বলবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা, ফলিত গণিতে এমএসসি এবং ম্যাথবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে ১৯৫৮ সালের নভেম্বর মাসে সরকারি কলেজের অঙ্কের লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। পরে সরকারি জগন্নাথ কলেজের গণিত বিভাগে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। জগন্নাথ কলেজে একপর্যায়ে গণিত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হন। ১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি টিচিং-এ যোগ দেন। নিখোঁজ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এখানে অধ্যাপনা করেন। আবুল কালাম আজাদ ছাত্রজীবনে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষকতাকালে (১৯৫৮-৭১) এ দেশের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়েছেন। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে নানা কর্মসূচিতে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অবরুদ্ধ ঢাকায় তিনি পরিবারসহ থেকে যেতে বাধ্য হন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে না পারলেও যখনই পেরেছেন গোপনে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করেছেন।[1]

পারিবারিক জীবন

অবিবাহিত আবুল কালাম আজাদ মা, চার ভাই ও চার বোনসহ থাকতেন ঢাকার আজিমপুরে। ভাইবোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তার বাবা বেঁচে না থাকায় তিনিই ছিলেন তাদের অভিভাবক। অবরুদ্ধ জীবনের মধ্যে তাকে ভাইবোনদের আগলে রাখতে হয়েছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পরিবারের সবাইকে বেঁচে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন।[1]

আবুল কালাম আজাদ নিশ্চিত ছিলেন, এ দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। যুদ্ধের পরিস্থিতি দেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেও এই স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে পারেননি।

মৃত্যু

দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র এক দিন আগে, ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ দেশীয় দোসরদের একটি দল তাকে আটক করে অজ্ঞাত এক স্থানে নিয়ে যায়। বদর বাহিনীর পাঁচটি খুনী ১৫ই ডিসেম্বর সকালে তাদের বাসায় ঢুকে পড়ে। প্রথমে তারা আজাদের সামনে রিভলবার ধরে তাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে অকারণ তল্লাসী চালায়।[1]

তারপর নিরপরাধ আজাদকে বাসি মুখে ধরে নিয়ে যায়। ছোট বোনটি তখন তাদের পায়ে ধরেছিল। মা, বার বার তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, বাবা তোমরা বাঙ্গালী, তোমরাও আমার ছেলে, ওকে তোমরা ছেড়ে দাও। কিন্তু কেউ তার কথা শোনেনি, নরপশুরা এই নারীকে প্রতিবারই প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে।

সেদিন তিন ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন উঠে যায়। স্বাধীনতার পর তার পরিবারের সদস্যরা রায়ের বাজার বধ্যভূমি সহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেন। তখন আজাদের ছোট ভাই ‘ইভনিং পোস্ট’ –এর সম্পাদক হাবিবুল বাশার, বড় ভগ্নিপতি ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সির মালিক গোলাম রসুল আজাদের সন্ধান নেওয়ার জন্যে নানাভাবে চেষ্টা করেন। কিন্তু কোন ফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাকে পাওয়া গেল ১৭ই ডিসেম্বর বিকেলে, ডঃ রাব্বি সহ আরো কয়েকজন জ্ঞানীগুণীর লাশের পাশে।

সম্মাননা

  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে রেকর্ড ভাঙ্গা নম্বর নিয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বর্ণপদক পান। 
  • ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে শিক্ষায় অসামান্য অবদান রাখার জন্য মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে।
  • গণিতশাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের জন্যে তিনি লন্ডনের রাজকীয় আবহাওয়া বিজ্ঞান সমিতি, যুক্তরাজ্যের ফলিত গণিত সমিতি এবং বোস্টনের আবহাওয়া বিজ্ঞান সমিতির ফেলো নির্বাচিত হন।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

  • শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ রশিদ হায়দার সম্পাদিত।
  • শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (প্রথম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯১)।
  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ৮ম খণ্ড ৫০৮-৫০৯ নং পৃষ্ঠা।
  • ১৯৭৩ সালের জাতীয় দিবসে সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিশেষ সংখ্যা।

বহি:সংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.