অলাতচক্র
অলাতচক্র বাংলাদেশের অগ্রণী লেখক আহমদ ছফা বিরচিত একটি উপন্যাস। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে রচিত শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলির অন্যতম অলাতচক্র।[1][2] উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে সাপ্তাহিক নিপুণ পত্রিকার ঈদ সংখ্যায়। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে মুক্তধারা থেকে পরিমার্জিত রূপে উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
লেখক | আহমদ ছফা |
---|---|
দেশ | বাংলাদেশ |
ভাষা | বাংলা |
ধরন | মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস |
প্রকাশিত | ১৯৯৩ |
মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত লেখক দানিয়েল ও ক্যান্সারে আক্রান্ত তায়েবার মধ্যকার অস্ফুট ভালবাসা, মানসিক টানাপোড়েন, যুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি চিত্রায়িত হয়েছে অলাতচক্রে।
পটভূমি
আহমদ ছফার ডায়েরি অনুসারে জানা যায় এপ্রিলের মাঝামাঝি কোন একটা সময়ে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতা চলে যান। অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের ইচ্ছা থাকলেও পরে তাকে বোঝানো হয় যুদ্ধ করার অনেক লোক আছে কিন্তু লেখালেখির যুদ্ধের জন্য কিছু লোক দরকার; আহমদ ছফা না হয় সেই কাজ করুক। ছফা কলকাতায় ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংগ্রাম শিবির’ নামে একটি সংগঠন শুরু করেছিলেন। সেখানে সভাপতি ছিলেন অজয় রায় এবং সাধারণ সম্পাদক আহমদ ছফা। কলকাতায় থাকাকালীন সময়ে প্রবীণ সিপিএম নেতা কমরেড মুজাফফর আহমেদের সান্নিধ্যে আসেন। ছফার মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিমালাকে নিজ জবানিতে লিপিবদ্ধ করে অলাতচক্র শিরোনামে প্রথম প্রকাশ করেন ১৯৮৫ সালে সাপ্তাহিক নিপুণ পত্রিকার ইদ সংখ্যায়। পত্রিকায় প্রকাশের পর নানা সমালোচনার সম্মুখীন হলে ১৯৯৩ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার সময় ছফা উপন্যাসের চরিত্রদের নাম পরিবর্তন এবং অন্যান্য পরিবর্তন আনেন।
কাহিনীসংক্ষেপ
লেখক দানিয়েলের জবানিতে লেখা আত্মজীবনী ধাঁচের উপন্যাস অলাতচক্র। কেন্দ্রীয় চরিত্র দানিয়েল বাংলাদেশের রাজনীতি ও লেখালিখির সাথে যুক্ত ছিলেন। সে সুবাদেই গ্রগতিশীল নারী তায়েবার সাথে পরিচয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয় দানিয়েল। দানিয়েল মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে চাইলেও তাকে যুদ্ধে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়। দানিয়েল ক্ষোভের সাথে বলে, ‘আমার যুদ্ধ যাওয়া হয়নি। যুদ্ধকে ভয় করি বলে নয়। আমাদের দেশের যে সকল মানুষের যুদ্ধের দায়দায়িত্ব, তারা আমাকে ট্রেনিং সেন্টারে পাঠাবার উপযুক্ত বিবেচনা করতে পারেনি।’ কলকাতায় কখনো হাসপাতালে ভর্তি তার প্রিয় মানুষ তায়েবার কাছে, কখনো রাজনীতিবিদ, বিপ্লবীদের সাথে, কখনওবা চাকরির আশায় ঘুরে ঘুরে কাটে দানিয়েলের সময়।
উপন্যাসের কাহিনীজুড়ে উঠে এসেছে যুদ্ধ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ, কলকাতায় আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের কষ্ট, তাদের প্রতি কলকাতার মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গি, যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষী নেতাদের কলকাতায় ফুর্তি করা। সেই সাথে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিরা কী করে বেড়িয়েছেন, তার একটা খণ্ডচিত্রও রয়েছে। কেউ কেউ আরামে দিন কাটাচ্ছিল থিয়েটার রোডে। ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা পার করছিল কঠিন সময়।
অন্যদিকে রয়েছে মৃত্যুপথযাত্রী তায়েবার সাথে দানিয়েলের সম্পর্ক নিয়ে নানা ঘটনা। ক্যান্সারে আক্রান্ত তায়েবাকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়া, কথা বলা, আবদারে মসলাযুক্ত খাবার নিয়ে যাওয়া, ডাক্তারের সাথে আলোচনা ও প্রোটোকল ভেঙে অতিরিক্ত সময় হাসপাতালে বসে থাকার স্মৃতিকথা। তায়েরবার চরিত্র যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা অসাধারণ। যুদ্ধকালীন সময়ে বইয়ের কাহিনী আবর্তিত হলেও পরিশেষে লেখকের ব্যক্তিগত জীবনকাহিনী আর মতামতই প্রাধান্য পেয়েছে। রচনার শেষদিকে দেশে ফিরে আকাশে বোমারু বিমান আর পাতালে পাকবাহিনীর বর্ণনাও দেন।
গ্রন্থসমীক্ষা
‘অলাতচক্রে’ আহমদ ছফা মুক্তিযুদ্ধকে তুলে এনেছেন একদম শিকড় থেকে। যুদ্ধকালীন শুভ ও অশুভ শক্তির তৎপরতা এঁকেছেন নিপুণ হাতে এবং এঁকেছেন রণক্ষেত্রের বাহিরে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া আরেকটা মুক্তিযুদ্ধের মানবিক চিত্র।[3] বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, ভাসানী, মোশতাক, ওসমানী সবগুলো চরিত্র হাজির হয় উপন্যাসে, লেখক তুলে আনেন এক রাজনৈতিক মুক্তিযুদ্ধকে। পুরো উপন্যাস জুড়েই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে এক ঠান্ডা মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। উপন্যাসে লেখক আহমেদ ছফা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন।[4]
তথ্যসূত্র
- খান, সলিমুল্লাহ (২০১৩) [প্রথম প্রকাশ ২০১০]। "রাষ্ট্র ও বাসনা"। আহমদ ছফা সঞ্জীবনী। ঢাকা: আগামী প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ২২১–২৩৮। আইএসবিএন 978-984-04-1585-4।
- সাত্তার, সরদার আবদুস (২০১৭)। "মুক্তিযুদ্ধ ও অলাতচক্র"। আহমদ ছফা: আলোকপথের অভিযাত্রী। ঢাকা: সুচয়নী পাবলিশার্স। পৃষ্ঠা ২৯৯–৩২৬।
- মোহন, আবদুল্লাহ আল (১১ নভেম্বর ২০১২)। "আহমদ ছফা: বুদ্ধিবৃত্তির দুঃসাহসী নায়ক"। দৈনিক জনতা। ৬ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ মে ২০১৮।
- হাননান, সুদীপ্ত (২০১৭)। আহমদ ছফার উপন্যাস : বাংলাদেশের উদ্ভব এবং বিকাশের ব্যাকরণ। ঢাকা: পুথিনিলয় প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ৫৩–৬৭। আইএসবিএন 9789849212430।