ঢাকা নবাব পরিবার
ঢাকার নবাব ছিলো ব্রিটিশ বাংলার সবচেয়ে বড় মুসলিম জমিদার পরিবার।সিপাহী বিপ্লবের সময় ব্রিটিশদের প্রতি বিশ্বস্ততার জন্য ব্রিটিশ রাজ এই পরিবারকে নবাব উপাধিতে ভূষিত করে।[1]

পরিবারটি স্বাধীন না হলেও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেতে অনেক প্রভাব ছিলো।পরিবারটির বাসস্থান ছিলো আহসান মঞ্জিলে।পরিবার ও জমিদারির প্রধানকে নবাব বলা হতো।ব্রিটিশ রাজ দ্বারা ভূষিত ঢাকার প্রথম নবাব ছিলেন খাজা আলিমুল্লাহ।
পারিবারিক বিবাদের কারণে জমিদারিত্বের পতন ঘটতে থাকে।১৯৫২ পূর্ব পাকিস্তান জমিদারি এক্ট অনুযায়ী তা লুপ্ত করা হয়।খাজা হাবিবুল্লাহ ছিলেন শেষ জমিদার।
ইতিহাস
.jpg)
মৌলভী খাজা হাফিজুল্লাহ কাশ্মীরি এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা।আর্মেনীয় ও গ্রিক বাণিজ্যিকদের সাথে চামড়া,স্বর্ণ,লবণ ও মরিচের ব্যবসা করে তিনি প্রচুর অর্থের মালিক হন।চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় তিনি বাংলায় জমিদারীর জায়গা ক্রয় করেন।
হাফিজুল্লাহ ১৮০৬ সালে ৪০,০০০ টাকার বিনিময়ে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার আতিয়া পরগানার(বর্তমান টাঙ্গাইল) চার আনা(চার ভাগের এক ভাগ) ক্রয় করেন।[2] এই জায়গাগুলো থেকে মুনাফা তাকে আরো জায়গা ক্রয় করতে উৎসাহিত করে।[3] ১৮১২ সালের ৭ মে বরিশালের বুজুর্গ উমেদপুর পরগণায় আয়লা টিয়ারখালি ও ফুুলঝুরি মৌজা দুইটি নিলামে উঠলে খাজা হাফিজুল্লাহ ১,৪১,০০০ বিঘা(১৮০ মি২) আয়তনের বিশাল পরগনা দুটি ৩৭২ টাকার রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে মাত্র ২১,০০১/- টাকার বিনিময়ে কিনে নেন।১৮৭০ এর দিকে এই জায়গার ভাড়া থেকে আয় হতো প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার ৫০২ টাকা।
হাফিজুল্লাহর কোনো ছেলে সন্তান না থাকায় জমিদারিরর দায়িত্ব পায় তার বড় ভাই খাজা আহসানুল্লাহের ছেলে খাজা আলিমুল্লাহ।তিনি জমিদারি ও তালুকদারিকে একত্রিকরণ করেন।আরো জমি-সম্পত্তি ক্রয় করে নিজেদের সীমানা বিস্তৃত করেন।১৮৫৪ সালে তিনি একটি ওয়াকফনামা করেন যেখানে দায়িত্ব একজন মোতোয়ালির কাছে থাকবে বলে উল্লেখ করেন।তিনি আহসান মঞ্জিল ক্রয় করেন যা আগে ফরাসি বাণিজ্যকুঠি ছিলো।তিনি ইংরেজি শিখেন ও পরিবারকে শিখতে উৎসাহিত করেন।যার ফলে ব্রিটিশদের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়।তিনি ব্রিটিশদের সাহায্যে রমনা রেসকোর্স ও জিমখানা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন।[4] ১৮৫২ সালে একটি সরকারী নিলাম থেকে দারিয়ায় নুর নামক একটি বিখ্যাত হীরা ক্রয় করেন।বর্তমানে হীরাটি ঢাকা সোনালি ব্যাংকের একটি ভল্টে আছে।[5]
১৮৪৬ সালে তিনি তার দ্বিতীয় সন্তান খাজা আবদুল গণিকে মোতোয়ালি হিসেবে ঘোষণা করেন।এর মাধ্যমে পরিবারের সর্বেসর্বা হন মোতোয়ালি প্রাপ্ত ব্যক্তিটি।তার ফলে উত্তরসূরিদের মধ্যে সম্পদভাগ হবে না।মূলত এটাই ঢাকা নবাব পরিবারে সফলতার এটাই মূল কারণ ছিলো।সুন্নি হলেও তিনি শিয়াদের মুহাররমের অনুষ্ঠানে অর্থ দান করতেন।১৮৫৪ সালে তিনি মারা যান।তাকে বেগম বাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আলিমুল্লাহের মৃত্যুর পর তার ও জিনাত বেগমের সন্তান খাজা আবদুল গণি নবাব হন।তার আমলে জমিদারি বাকেরগঞ্জ,ত্রিপুরা,ময়মনসিংহ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।ব্যবস্থাপনার জন্য যাকে ২৬টি ভাগে ভাগ করা হয়।তা নিয়ন্ত্রনের জন্য কাছরির (কার্যালয়) প্রধান একজন নায়েব ও কিছু আমলা(কর্মকর্তা) থাকতো।১৮৫৭ এর সিপাহী বিপ্লবের সময় তিনি ব্রিটিশদদের সাহায্য করেন।যার কারণে তাকে ১৮৭৫ সালে নবাব উপাধি দেওয়া হয়।১৮৭৭ সালে যা বংশগত করা হয়।[6] তার আমলেই প্রথম নবাব পরিবার রাজনীতিতে জড়ায়।তিনি অনেক দানশীল কাজ করে গিয়েছেন।তার কাজগুলো বাংলার বাইরে এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরেও উল্লেখ্যযোগ্য ছিলো।তার সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য কাজটি হলো ঢাকার পানি ব্যবস্থাপনা।পানি পরিশোধন করে বিনামূল্যে জনগণকে দিতেন।তিনি কিছু স্কুল ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।তিনি ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল,কলকাতা মেডিকেল হাসপাতাল,আলিগড় কলেজে অনেকে টাকা দান করেন।রক্ষণশীল সমাজের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি মহিলাদের মঞ্চনাটকে অভিনয়ে সাহায্য করেন।তিনি বাকল্যানড বাঁধ তৈরি ও এর তত্ত্বাবধায়ন করেন।

১১ সেপ্টেম্বর ১৮৬৮ সালে তিনি তার বড় ছেলে খাজা আহসানুল্লাহকে জমিদারির দায়িত্ব দেন।তবে ২৪ আগস্ট ১৮৯৬ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জমিদারি দেখেন।১৮৪৬ সালে আহসানুল্লাহ ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন।আহসানুল্লাহ একজন উর্দু কবি ছিলেন।তিনি শাহীন নাম ব্যবহার করতেন।তার কিছু নির্বাচিত কবিতা,কুলিয়াত-ই-শাহীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে।তার বই তাওয়ারিক-ই-খানদান-ই-কাশ্মীরিয়া পাকিস্তানি ইতিহাস ও সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নবাব আহসানুল্লাহ আহসানুল্লাহ স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং (বর্তমান বুয়েট) প্রতিষ্ঠা করেন।[7]
তারপর তার দ্বিতীয় সন্তান নবাব স্যার সলিমুল্লাহ জমিদারিত্বের দায়িত্ব পান।তবে পারিবারিক অন্তঃদ্বন্দের কারণে তার কার্যে ব্যাঘাত ঘটতে থাকে।রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশ সরকার স্যার সলিমুল্লাহকে সাহায্য করতে থাকেন।১৯১২ সালে সরকার তাকে ব্যক্তিগত ঋন পরিশোধের জন্য লোন দেন।১৯০৬ সালে তিনি মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন।তিনি বঙ্গভঙ্গের পক্ষে স্বদেশী আন্দোলনের বিরোধিতা করেন।কারণ বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলিমরা অনেক সুবিধা পেতে থাকে।পূর্ব বাংলার মুসলিমদের স্কুলে গমনের হার ৩৫ ভাগ বেড়ে যায়।অনেক ব্যবসার সুযোগ শুরু হয়।যার ফলে অর্থনীতি সচ্ছল হতে থাকে।এই পরিবার ও কলকাতার ইস্পাহানী পরিবারের মুসলিম ছাত্রদের উপর অনেক প্রভাব ছিলো।১৯৩৮ সালে সর্ব ভারত মুসলিম ছাত্র পরিষদের বাংলা অঞ্চলের নাম পরিবর্তন করে সর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্র পরিষদ করা হয়।[8][9]
১৯০৭ সালে নড়বড়ে জমিদারি কে বোর্ড অফ ওয়ার্ডের নিয়ন্ত্রনে নেওয়া হয়।যার প্রথম স্টুয়ার্ড ছিলেন এইচ.সি.এফ মেয়ের তারপর যথাক্রমে এল.জি. পিলেন,পি.জে. গ্রিফিথ,পি.ডি. মার্টিন ছিলেন।তিনি বাংলার লেখাপড়ার সুযোগের জন্য অনেক কিছু করেছেন।তিনি সবসময় অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ রাখার চেষ্টা করতেন।বাবার মতো তিনিও লোকহিতৈষী ব্যক্তি ছিলেন,তিনি অনেক গরীব ব্যক্তিকে আর্থিক সহায়তা করেছেন।তিনি সালিমুল্লাহ মুসলিম অনাথাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।যেটি তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে বড় অনাথাশ্রম ছিলো।ঢাকার সলিমুল্লাহ হলটি তিনি দান করেন।যেটা ছাত্রদের জন্য তৎকালীন এশিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় আবাসিক হল ছিলো।বাংলার মুসলিমদের হিন্দুদের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করতে বঙ্গভঙ্গের জন্য চেষ্টা করেন।১৬ অক্টোবর ১৯০৬ সালে তিনি সফল হন।১৯১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।বর্তমানে এটি পূর্ব বাংলার সবচেয়ে যুগান্তকারী ও উপকারী কাজ হিসেবে মানা হয়।তার দাদা ও বাবা রাজনীতির দিকে এগুলেও তিনিই সবচেয়ে বেশি সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেন। ১৬ জানুয়ারি ১৯১৬ সালে কলকাতায় তিনি রহস্যজনকভাবে মারা যান।ধারণা করা হয় তাকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো।কফিনে ঢাকায় আনার পর কাউকে তার মুখ দেখানো হয়নি। তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
১৯৫০ সালে জমিদারিত্ব রদ করা হয়।শুধু খাস কিছু সম্পত্তি ও আহসান মঞ্জিল বাদে বাকি সব জব্দ করা হয়। তবে এগুলোর প্রতি অনেকের দাবি থাকায় বোর্ড অফ ওয়ার্ডই এগুলোর দেখাশোনা করতে থাকে।এখনো বোর্ড অফ ওয়ার্ডের উত্তরসূরি জমি সংস্কার বোর্ড পরিবারের পক্ষ থেকে সম্পত্তির দেখাশোনা করছে।
বংশপ্রবাহ
![]() | ![]() | ![]() | ||||
---|---|---|---|---|---|---|
খাজা হাফিজুল্লাহ | খাজা আলিমুল্লাহ | আবদুল গনি | খাজা আহসানুল্লাহ | খাজা সলিমুল্লাহ | খাজা হাবিবুল্লাহ | খাজা হাসান আসকারি |
নবাব পদবি পাওয়ার পূর্বের জমিদারি ও পরিবারের প্রধানগণ
- খাজা আবদুল কাদের কাশ্মিরি: (? – ?) পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা
- খাজা আবদুল্লাহ: (? – ১৭৯৬) ঢাকায় বসবাস শুরু করেন।
- খাজা হাফিজুল্লাহ: (১৭৩৫ – ১৮১৫)
ঢাকার নবাবগণ
- নবাব খাজা আলিমুল্লাহ: (? – ১৮৫৪) নবাব পদবি গ্রহণ করা প্রথম ব্যক্তি।
- নবাব স্যার খাজা আবদুল গনি: (১৮১৩–১৮৯৬) বংশগতভাবে প্রাপ্ত দ্বিতীয় নবাব।
- নবাব স্যার আহসানুল্লাহ: (১৮৪৬–১৯০১) পরিবারের তৃতীয় নবাব.
- নবাব বাহাদুর স্যার খাজা সলিমুল্লাহ: (১৮৭১–১৯১৫) পরিবারের চতুর্থ নবাব।
- নবাব বাহাদুর খাজা হাবিবুল্লাহ: (১৮৯৫-১৯৫৮) পরিবারের পঞ্চম নবাব।
- নবাব বাহাদুর খাজা হাসান আসকারি: (১৯২০–১৯৮৪) জমিদারি লুপ্ত হওয়ার পর প্রথম প্রধান উত্তরসূরি এবং শেষ নবাব।
পরিবারের অন্য সদস্যগণ
- নবাবজাদা খাজা আতিকুল্লাহ: (১৮৮২–১৯৪৫) খাজা আহসানুল্লাহর তৃতীয় সন্তান
- নবাবজাদি মেহেরবানু খানম: (১৯০২–১৯৫৪) খাজা আহসানুল্লাহের কন্যা।
- খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী।
- খাজা শাহবুদ্দীন-রাজনীতিবিদ
- খাজা ইউসুফ জান, (১৮৫০-১৯২৩): রাজনীতিবিদ ও খান বাহাদুর উপাধিপ্রাপ্ত[10]
- খাজা মো: আজম খান বাহাদুর
- খাজা ইসমাইল জাবিহ খান বাহাদুর
- বেগম শামসুন্নাহার খাজা আহসানউল্লাহ (নবাবজাদা খাজা আহসানুল্লাহের স্ত্রী, সাবেক বিএনপি নেত্রী, সাবেক বিএনপি সংসদ সদস্য ১৯৯১-১৯৯৬,[11] ১৯৯৬,[12] ২০০১-২০০৬)
- খাজা মুহাম্মদ আফজল: (১৮৭৫–?) খাজা ইউসুফ জানের পুত্র এবং কবি।
নবাব পরিবারের বাসস্থান
- আহসান মঞ্জিল
- ইসরাত মঞ্জিল
- নিশাত মঞ্জিল
- শাহবাগ বাগান বাড়ি
- দিলকুশা বাগান বাড়ি
- পরিবাগ বাগান বাড়ি
- বেগুনবাড়ি পার্ক
- কোম্পানি বাগান
- ফরহাদ মঞ্জিল
- হাফিজ মঞ্জিল
- নীলকুঠী মুজিবনগর
- মনসুর দুর্গ
তথ্যসূত্র
- http://www.nawabbari.com/
- "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৩ জানুয়ারি ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ জুলাই ২০১৮।
- http://www.druglibrary.org/schaffer/Library/studies/inhemp/6app1.htm
- http://en.banglapedia.org/index.php?title=Alimullah,_Khwaja
- http://en.banglapedia.org/index.php?title=Daria-i-Noor
- http://en.banglapedia.org/index.php?title=Ghani,_Nawab_Khwaja_Abdul
- http://en.banglapedia.org/index.php?title=Ahsanullah,_Khwaja
- http://en.banglapedia.org/index.php?title=Salimullah,_Khwaja
- http://en.banglapedia.org/index.php?title=Nawab_Family_of_Dhaka
- "Yusuf Jan, Khwaja - Banglapedia"। en.banglapedia.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৯-০৬।
- "List of 5th Parliament Members"। www.parliament.gov.bd। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১২-০২।
- "List of 6th Parliament Members"। www.parliament.gov.bd। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১২-০২।