সন্ধি
সন্ধি বাংলা ব্যাকরণে শব্দগঠনের একটি মাধ্যম। এর অর্থ মিলন। অর্থাত্ দুটি শব্দ মিলিয়ে একটি শব্দে পরিণত হওয়াকে বা পরস্পর সন্নিহিত দু' বর্ণের মিলনকে সন্ধি বলে। সন্ধি তিন প্রকার; যথাঃ ১)স্বরসন্ধি, ২)ব্যঞ্জন সন্ধি এবং ৩)বিসর্গ সন্ধি। সন্ধি ব্যাকরণের ধ্বনিতত্ব অংশে আলোচিত হয়। ধ্বনিগত মাধুর্য এবং স্বাভাবিক উচ্চারণে সহজপ্রবণতা সন্ধির উদ্দেশ্য।সন্ধি নতুন শব্দ তৈরির একটি কৌশল। সন্ধির দ্বারা দুটি শব্দকে মিলিয়ে একটি নতুন শব্দ তৈরির করা হয় ।যেমন-'দেব'- শব্দ এর অর্থ দেবতা,আর 'আলয়' শব্দের অর্থ গৃহ।এই দুটি শব্দ মিলে তৈরী হয় 'দেবালয়'। যার অর্থ 'দেবতা' বা 'গৃহ' নয়,দেবতার একটি অন্যতম থাকার জায়গা বা গৃহ 'মন্দির'।নতুন শব্দ তৈরিতে সন্ধির অবদান অনস্বীকার্য ।
বাংলা ব্যাকরণ |
---|
ইতিহাস |
ধ্বনিতত্ত্ব |
|
রূপতত্ত্ব/শব্দতত্ত্ব |
|
বাক্যতত্ত্ব |
|
অর্থতত্ত্ব |
|
ছন্দ ও অলংকার |
|
ধারণা
সন্ধি শব্দটির বিশ্লেষিত রূপ সম+√ধি+ই।১[1] অর্থাত্ সমদিকে ধাবিত হওয়া বা মিলিত হওয়া।বাংলা ব্যাকরণমতে দুটি শব্দের মধ্যে প্রথম শব্দের শেষ অক্ষর এবং দ্বিতীয় শব্দের প্রথম অক্ষর যদি একইভাবে উচ্চারিত হয় বা তাদের উচ্চারণ প্রায় কাছাকাছি হয় তবে অক্ষরদ্বয় পরস্পর সংযুক্ত হওয়া অর্থাত্ শব্দ দুটি মিলিত হয়ে এক শব্দে পরিণত হওয়াকে সন্ধি বলে।[2] এক কথায়,সন্নিহিত দুটি বর্ণের মিলনকে সন্ধি বলে যেমনঃবিদ্যা+আলয়=বিদ্যালয় এখানে বিদ্যা ও আলয় শব্দদ্বয় মিলিত হয়ে বিদ্যালয় শব্দটি গঠন করেছে।২
সন্ধির উদ্দ্যেশ্য
সন্ধির উদ্দ্যেশ্য হলঃ
- বাক্যকে সুন্দর,প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য করা।
- নতুন শব্দ তৈরী করা।
- শব্দকে সংক্ষেপ করা।
- বাক্যকে সংক্ষিপ্ত করা।
- উচ্চারণে স্বাচ্ছন্দ্য আসে।
- ধ্বনিগত মাধুর্য রক্ষা করা।
প্রকারভেদ
সন্ধি প্রধানত দুই প্রকার। যথা:
- বাংলাসন্ধি
এবং
- তৎসমসন্ধি
বাংলা সন্ধি ২ প্রকার।যথা:
- স্বরসন্ধি
- ব্যঞ্জনসন্ধি
তৎসমসন্ধি আবার তিন প্রকার।যথা:
- স্বরসন্ধি
- ব্যঞ্জনসন্ধি
- বিসর্গসন্ধি
উল্লেখ্য বাংলাসন্ধিতে কখনো বির্সগ সন্ধি হয় না।[3]
স্বরসন্ধি
স্বরধ্বনির সাথে স্বরধ্বনির যে সন্ধি হয় তাকে স্বরসন্ধি বলে।
যেমন, সিংহাসন = সিংহ + আসন
সিংহ = স্+ই+ং+হ্+অ ; আসন = আ+স্+অ+ন্+অ
বিদ্যালয় = বিদ্যা + আলয়
হিমালয় = হিম + আলয়,
দেখা যাচ্ছে 'অ' এবং 'আ' মিলে স্বরসন্ধিতে 'আ' হয়।
স্বরসন্ধির সুত্র
১. অ/আ + অ/আ = আ
উদাহরণ: সিংহাসন = সিংহ + আসন (স্+ই+ং+হ্+অ + আ+স্+অ+ন্+অ = স্+ই+ং+হ্+আ+স্+অ+ন্+অ = সিংহাসন)
২. ই/ঈ + ই/ঈ = ঈ
উদাহরণ: সতীশ = সতী + ঈশ (স্+অ+ত্+ঈ + ঈ+শ্+অ = স্+অ+ত্+ঈ+শ্+অ = সতীশ)
৩. উ/ঊ + উ/ঊ = ঊ
উদাহরণ: বধূৎসব = বধূ + উৎসব (ব্+অ+ধ্+ঊ + উ+ত্+স্+অ+ব্+অ = ব্+অ+ধ্+ঊ+ত্+স্+অ+ব্+অ = বধূৎসব)
৪. অ/আ + ই/ঈ = এ
উদাহরণ: মহেশ = মহা + ঈশ (ম্+অ+হ্+আ + ঈ+শ্+অ = ম্+অ+হ্+এ+শ্+অ = মহেশ)
৫. অ/আ + উ/ঊ = ও
উদাহরণ: বঙ্গোপসাগর = বঙ্গ + উপসাগর (ব্+অ+ঙ্+গ্+অ + উ+প্+অ+স্+আ+গ্+অ+র্+অ = ব্+অ+ঙ্+গ্+ও+প্+অ+স্+আ+গ্+অ+র্+অ = বঙ্গোপসাগর)
৬. অ/আ + ঋ = অর্
উদাহরণ: সপ্তর্ষি = সপ্ত + ঋষি (স্+অ+প্+ত্+অ + ঋ+ষ্+ই = স্+অ+প্+ত্+অ+র্+ষ্+ই = সপ্তর্ষি)
৭. অ/আ + এ/ঐ = ঐ
উদাহরণ: জনৈক = জন + এক
৮. অ/আ + ও/ঔ = ঔ
উদাহরণ: পরমৌষধ = পরম + ঔষধ
৯. ই/ঈ + ই/ঈ ছাড়া অন্য স্বরবর্ণ = ্য্
উদাহরণ: ন্যূন = নি + ঊন
১০. উ/ঊ + উ/ঊ ছাড়া অন্য স্বরবর্ণ = ্ব
উদাহরণ: অনু + অয় = অন্বয়
১১. ঋ + ঋ ছাড়া অন্য স্বরবর্ণ = ্র্
উদাহরণ: পিত্রালয় = পিতৃ + আলয়
১২. এ + অন্য স্বরবর্ণ = অয়্
উদাহরণ: নয়ন = নে + অন
১৩. ঐ + অন্য স্বরবর্ণ = আয়্
উদাহরণ: গায়ক = গৈ + অক
১৪. ও + অন্য স্বরবর্ণ = অব্
উদাহরণ: গবেষণা = গো + এষণা
১৫. ঔ + অন্য স্বরবর্ণ = আব্
উদাহরণ: নাবিক = নৌ + ইক
ব্যঞ্জনসন্ধি
স্বরে আর ব্যঞ্জনে অথবা ব্যঞ্জনে ও ব্যঞ্জনে অথবা ব্যঞ্জনে ও স্বরে যে সন্ধি হয় তাকে ব্যঞ্জন সন্ধি বলে। ব্যঞ্জনসন্ধি মূলত কথ্য রীতিতে সীমাবদ্ধ। প্রকৃত বাংলা ব্যঞ্জন সন্ধি মূলত সমীভবন এর নিয়মে হয়ে থাকে। ব্যঞ্জন সন্ধিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
যেমন, বিপজ্জনক = বিপদ + জনক
বিপদ = ব্+ই+প্+অ+দ্+অ ; জনক = জ্+অ+ন্+অ+ক্+অ
এখানে 'অ' এবং 'জ' মিলে 'জ্জ' হচ্ছে।
ব্যঞ্জনসন্ধির সূত্র
১. বর্গের প্রথম বর্ণ (ক, চ, ট, ত/ৎ, প) + স্বরবর্ণ = বর্গের তৃতীয় বর্ণ (গ, জ, ড/ড়, দ, ব)
ষড়ঋতু = ষট্ + ঋতু
২. বর্গের প্রথম বর্ণ + বর্গের পঞ্চম বর্ণ = বর্গের প্রথম বর্ণ বদলে সেই বর্গেরই পঞ্চম বর্ণ হয়
মৃন্ময় = মৃৎ + ময়
৩. ত/দ + জ/ঝ = জ্জ/জ্ঝ
বিপজ্জনক = বিপদ + জনক
৪. ত/দ + চ/ছ = চ্চ/চ্ছ
উচ্ছেদ = উৎ + ছেদ
৫. ত/দ + ল = ল্ল
তল্লিখিত = তদ্ + লিখিত
৬. ম + স্পর্শবর্ণ (ক-ম) = ম বদলে ং হয়, অথবা যেই বর্গের স্পর্শবর্ণ সেই বর্গেরই পঞ্চম বর্ণ হয়
সংগীত/সঙ্গীত = সম্ + গীত
৭. ম + অন্তঃস্থ বর্ণ (য, র, ল, ব)/ উষ্মবর্ণ (শ, ষ, স, হ) = ম বদলে ং হয়
বশংবদ = বশম্ + বদ
৮. স্বরবর্ণ + ছ = চ্ছ
পরিচ্ছেদ = পরি + ছেদ
৯. ত/দ + হ = দ্ধ
উদ্ধত = উৎ + হত
১০. ত-বর্গীয় বর্ণ (ত, থ, দ, ধ) + শ = চ্ছ
উচ্ছ্বাস = উৎ + শ্বাস
১১. শ/ষ + ত = ষ্ট
দৃষ্টি = দৃশ্ + তি
১২. শ/ষ + থ = ষ্ঠ
ষষ্ঠ = ষষ + থ
বিসর্গসন্ধি
বিসর্গসন্ধি ব্যঞ্জন সন্ধির অন্তর্গত। বিসর্গ সন্ধির প্রকারভেদগুলো হচ্ছেঃ র জাত বিসর্গ এবং স জাত বিসর্গ। বিসর্গসন্ধি র্ ও স্ এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
যেমন, আশীর্বাদ = আশীঃ + বাদ
আশীঃ = আ+শ্+ঈ+ঃ ; বাদ = ব্+আ+দ্+অ
এখানে 'ঃ' এবং 'ব' মিলে 'র্' হচ্ছে।
নিপাতনে সিদ্ধসন্ধি
যেসব সন্ধির নিদিষ্ট কোন নিয়ম নেই তাদেরকে নিপাতনে সিদ্ধসন্ধি বলে
যেমন, পরস্পর = পর + পর।
টীকা
তথ্যসূত্র
আরও দেখুন
- বাংলা ব্যাকরণ
- বাংলা
- সমাস
- স্বরবর্ণ