বিভক্তি
বাক্যস্থিত একটি শব্দের সঙ্গে অন্য শব্দের অন্বয় সাধনের জন্য যে সকল বর্ণ যুক্ত হয়, তাদের বিভক্তি বলে।[1] বিভক্তিগুলো ক্রিয়াপদের সাথে নামপদের সম্পর্ক স্থাপন করে।
বাংলা ব্যাকরণ |
---|
ইতিহাস |
ধ্বনিতত্ত্ব |
|
রূপতত্ত্ব/শব্দতত্ত্ব |
|
বাক্যতত্ত্ব |
|
অর্থতত্ত্ব |
|
ছন্দ ও অলংকার |
|
যেমন: ছাদে বসে মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছেন।
বাক্যটিতে ছাদে (ছাদ + এ বিভক্তি), মা (মা + ০ বিভক্তি), শিশুকে (শিশু + কে বিভক্তি), চাঁদ (চাঁদ + ০ বিভক্তি) ইত্যাদি পদে বিভিন্ন বিভক্তি যুক্ত হয়েছে।
বিভক্তি দুই প্রকার। যথা:- (১) শব্দ বিভক্তি বা নাম বিভক্তি ও (২) ক্রিয়া বিভক্তি।
বিভক্তির প্রয়োজনীয়তা
বাংলায় ক্রিয়াহীন অসংখ্য বাক্য রয়েছে। যেমন: 'মাঠে মাঠে অজস্র ফসল।' 'ছোট ছোট ডিঙি নৌকাগুলো নদীতে ভাসমান।' ইত্যাদি। তাই বলা যায় বাংলা বাক্য কারক-প্রধান নয়। কিন্তু বিভক্তি ছাড়া বাংলা বাক্য ঠিকভাবে গঠিত হতে পারে না এবং বাক্যও অর্থগ্রাহ্য হয় না। ওপরের দুটি বাক্যের বিভক্তি তুলে নিলে বাক্যগুলো যথাযথ অর্থ প্রকাশ করবে না। 'মাঠ মাঠ অজস্র ফসল' কিংবা 'ছোট ছোট ডিঙি নৌকা নদী ভাসমান' বাক্য হিসেবে ত্রুটিপূর্ণ। বাক্যদ্বয়ে বিভক্তির ব্যবহার বাক্যদুটির বিন্যাস ও অর্থ ঠিক করে দিয়েছে। আবার ক্রিয়াপদযুক্ত 'গাছের পাতায় রাতের শিশির লেগে আছে' - বাক্যটিকেও সম্পূর্ণ অর্থগ্রাহ্য করতে বিভক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। নতুবা 'গাছ পাতা রাত শিশির' কোনো বাক্য নয়।
অর্থাৎ, বিভক্তি বাক্যের অন্তর্গত পদগুলোর মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি করে এবং বাক্যের অর্থ নির্দিষ্ট করে। সেজন্যই বাংলা বাক্য বিভক্তি-প্রধান।[2]
বাংলা শব্দ-বিভক্তি
০ (শূণ্য) বিভক্তি (অথবা অ-বিভক্তি), এ (য়), তে (এ), কে, রে, র (এরা) - এ কয়টিই খাঁটি বাংলা শব্দ বিভক্তি। এছাড়া বিভক্তি স্থানীয় কয়েকটি অব্যয় শব্দও কারক-সম্বন্ধ নির্ণয়ের জন্য বাংলায় প্রচলিত রয়েছে। যেমন - দ্বারা, দিয়ে, হতে, থেকে ইত্যাদি।
বাংলা শব্দ বিভক্তি বা নাম বিভক্তি কারক নির্দেশ করে বলে এগুলোকে কারক বিভক্তিও বলা হয়।[2]
বাংলা শব্দ-বিভক্তি সাত প্রকার:
বিভক্তি | একবচন | বহুবচন |
---|---|---|
প্রথমা | ০, অ, এ (য়), তে, এতে। | রা, এরা, গুলি (গুলো), গণ। |
দ্বিতীয়া | ০, অ, কে, রে (এরে), এ, য়, তে। | দিগে, দিগকে, দিগেরে, *দের। |
তৃতীয়া | ০, অ, এ, তে, দ্বারা, দিয়া (দিয়ে), কর্তৃক। | দিগের দিয়া, দের দিয়া, দিগকে দ্বারা, দিগ কর্তৃক, গুলির দ্বারা, গুলিকে দিয়ে, *গুলো দিয়ে, গুলি কর্তৃক, *দের দিয়ে। |
চতুর্থী | দ্বিতীয়ার মতো | দ্বিতীয়ার মতো |
পঞ্চমী | এ (য়ে, য়), হইতে, *থেকে, *চেয়ে, *হতে। | দিগ হইতে, দের হইতে, দিগের চেয়ে, গুলি হইতে, গুলির চেয়ে, *দের হতে, *দের থেকে, *দের চেয়ে। |
ষষ্ঠী | র, এর। | *দিগের, দের, গুলির, গণের, গুলোর |
সপ্তমী | এ (য়), তে, এতে। | দিগে, দিগেতে, গুলিতে, গণে, গুলির মধ্যে, গুলোতে, গুলোর মধ্যে। |
তারকা চিহ্নিত বিভক্তিগুলো এবং বন্ধনীতে লিখিত শব্দ চলিত ভাষায় ব্যবহৃত হয়।
- বিভক্তি চিহ্ন স্পষ্ট না হলে সেখানে শূণ্য বিভক্তি আছে মনে করা হয়।
বিভক্তি যোগের নিয়ম
১. অপ্রাণী বা ইতর প্রাণিবাচক শব্দের বহুবচনে 'রা' যুক্ত হয় না; গুলি, গুলো যুক্ত হয়। যেমন- পাথরগুলো, গরুগুলি।
২. অপ্রাণীবাচক শব্দের উত্তরে 'কে' বা 'রে' বিভক্তি যুক্ত হয় না; শূণ্য বিভক্তি হয়। যেমন- কলম দাও।
৩. স্বরান্ত শব্দের উত্তর 'এ' বিভক্তির রূপ হয় 'য়' বা 'য়ে'। 'এ' স্থানে 'তে' বিভক্তিও যুক্ত হতে পারে। যেমন- মা + এ = মায়ে, ঘোড়া + এ = ঘোড়ায়, পানি + তে = পানিতে।
৪. অ-কারান্ত ও ব্যঞ্জনান্ত শব্দের উত্তর প্রায়ই 'রা' স্থানে 'এরা' হয় এবং ষষ্ঠী বিভক্তির 'র' স্থলে 'এর' যুক্ত হয়। যেমন- লোক + রা = লোকেরা, বিদ্বান (ব্যঞ্জনান্ত) + রা = বিদ্বানেরা, মানুষ + এর = মানুষের। কিন্তু অ-কারান্ত, আ-কারান্ত এবং এ-কারান্ত খাঁটি বাংলা শব্দের ষষ্ঠীর একবচনে সাধারণত 'র' যুক্ত হয়, 'এর' যুক্ত হয় না। যেমন- বড়র, মামার, ছেলের।
বিভিন্ন কারকে বিভিন্ন বিভক্তির ব্যবহার
সকল কারকে প্রথমা বা শূণ্য বিভক্তির ব্যবহার
(ক) | কর্তৃকারক | রহিম বাড়ি যায়। |
(খ) | কর্ম কারক | ডাক্তার ডাক। |
অর্থ অনর্থ ঘটায়। | ||
(গ) | করণ কারক | ঘোড়াকে চাবুক মার। |
(ঘ) | সম্প্রদান কারক | গুরুদক্ষিণা দাও। |
ভিক্ষা দাও দেখিলে ভিক্ষুক। | ||
(ঙ) | অপাদান কারক | গাড়ি স্টেশন ছাড়ে। |
(চ) | অধিকরণ কারক | সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। |
আকাশ মেঘে ঢাকা। |
সকল কারকে দ্বিতীয়া বিভক্তির ব্যবহার
(ক) | কর্তৃকারক | বশিরকে যেতে হবে। |
(খ) | কর্ম কারক | তাকে বল। |
তাকে আমি চিনি। | ||
ধোপাকে কাপড় দাও। | ||
'আমারে তুমি করিবে ত্রাণ, এ নহে মোর প্রার্থনা।' | ||
(গ) | করণ কারক | |
(ঘ) | সম্প্রদান কারক | (সম্প্রদান কারকে চতুর্থী বিভক্তি হয়।) |
(ঙ) | অপাদান কারক | বাবাকে বড্ড ভয় পাই। |
(চ) | অধিকরণ কারক | 'মন আমার নাচে রে আজিকে।' |
সকল কারকে তৃতীয়া বিভক্তির ব্যবহার
(ক) | কর্তৃকারক | ফেরদৌসী কর্তৃক শাহনামা রচিত হয়েছে। |
(খ) | কর্ম কারক | |
(গ) | করণ কারক | লাঙল দ্বারা জমি চাষ করা হয়। |
মন দিয়া কর সবে বিদ্যা উপার্জন। | ||
আমরা কান দ্বারা শুনি। | ||
(ঘ) | সম্প্রদান কারক | |
(ঙ) | অপাদান কারক | তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। |
(চ) | অধিকরণ কারক | খিলিপান (এর ভিতর) দিয়ে ওষুধ খাবে। |
সকল কারকে চতুর্থী বিভক্তির ব্যবহার
(ক) | কর্তৃকারক | (ব্যবহার নেই) |
(খ) | কর্ম কারক | (ব্যবহার নেই) |
(গ) | করণ কারক | (ব্যবহার নেই) |
(ঘ) | সম্প্রদান কারক | ভিখারিকে ভিক্ষা দাও। |
দরিদ্রকে দান কর। | ||
(ঙ) | অপাদান কারক | (ব্যবহার নেই) |
(চ) | অধিকরণ কারক | (ব্যবহার নেই) |
সকল কারকে পঞ্চমী বিভক্তির ব্যবহার
(ক) | কর্তৃকারক | |
(খ) | কর্ম কারক | |
(গ) | করণ কারক | এ সন্তান হতে দেশের মুখ উজ্জ্বল হবে। |
(ঘ) | সম্প্রদান কারক | |
(ঙ) | অপাদান কারক | জেলেরা নদী থেকে মাছ ধরছে। |
গাছ থেকে পাতা পড়ে। | ||
সুক্তি থেকে মুক্তো মেলে। | ||
দুধ থেকে দই হয়। | ||
বিপদ থেকে বাঁচাও। | ||
সোমবার থেকে পরীক্ষা শুরু। | ||
(চ) | অধিকরণ কারক | বাড়ি থেকে নদী দেখা যায়। |
সকল কারকে ষষ্ঠী বিভক্তির ব্যবহার
(ক) | কর্তৃকারক | আমার যাওয়া হয়নি। |
(খ) | কর্ম কারক | তোমার দেখা পেলাম না। |
দেশের সেবা কর। | ||
(গ) | করণ কারক | তার মাথায় লাঠির আঘাত কোরো না। |
ইট-পাথরের বাড়ি শক্ত। | ||
ইটের বাড়ি সহজে ভাঙে না। | ||
(ঘ) | সম্প্রদান কারক | ভিক্ষুকদের ভিক্ষা দাও। |
(ঙ) | অপাদান কারক | যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যে হয়। |
(চ) | অধিকরণ কারক |
সকল কারকে সপ্তমী বা এ বিভক্তির ব্যবহার
(ক) | কর্তৃকারক | লোকে বলে। |
পাগলে কী না বলে। | ||
(খ) | কর্ম কারক | এ অধীনে দায়িত্ব অর্পণ করুন। |
কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে। | ||
(গ) | করণ কারক | এ কলমে লেখা ভালো হয়। |
হাতে না মেরে ভাতে মারো। | ||
(ঘ) | সম্প্রদান কারক | খোদার এ জীবে আহার দিবে কে? |
দীনে দয়া কর। | ||
(ঙ) | অপাদান কারক | 'আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে?' |
মেঘে বৃষ্টি হয়। | ||
(চ) | অধিকরণ কারক | এ দেহে প্রাণ নেই। |
তিলে আছে তেল, কুসুমে সৌরভ। |
তথ্যসূত্র
- বাংলা ভাষার ব্যাকরণ,নবম-দশম শ্রেণি, ২০১৬ শিক্ষাবর্ষ, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, বাংলাদেশ
- বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি, সপ্তম শ্রেণি, শিক্ষাবর্ষ ২০১৬, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, বাংলাদেশ।