কারক

বাক্যস্থিত ক্রিয়াপদের সঙ্গে নামপদের যে সম্পর্ক, তাকে কারক বলে।[1]

কারক শব্দটির অর্থ হলো- যা ক্রিয়া সম্পাদন করে।

কারক ছয় প্রকার:
১. কর্তৃকারক
২. কর্ম কারক
৩. করণ কারক
৪. সম্প্রদান কারক
৫. অপাদান কারক এবং
৬. অধিকরণ কারক

বিভক্তি

বাক্যস্থিত একটি শব্দের সঙ্গে অন্য শব্দের অন্বয় সাধনের জন্য যে সকল বর্ণ যুক্ত হয়, তাদের বিভক্তি বলে। বিভক্তিগুলো ক্রিয়াপদের সাথে নামপদের সম্পর্ক স্থাপন করে।

যেমন: ছাদে বসে মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছেন।

বাক্যটিতে ছাদে (ছাদ + এ বিভক্তি), মা (মা + ০ বিভক্তি), শিশুকে (শিশু + কে বিভক্তি), চাঁদ (চাঁদ + ০ বিভক্তি) ইত্যাদি পদে বিভিন্ন বিভক্তি যুক্ত হয়েছে।

বাংলা শব্দ-বিভক্তি

০ (শূণ্য) বিভক্তি (অথবা অ-বিভক্তি), এ (য়), তে (এ), কে, রে, র (এরা) - এ কয়টিই খাঁটি বাংলা শব্দ বিভক্তি। এছাড়া বিভক্তি স্থানীয় কয়েকটি অব্যয় শব্দও কারক-সম্বন্ধ নির্ণয়ের জন্য বাংলায় প্রচলিত রয়েছে। যেমন - দ্বারা, দিয়ে, হতে, থেকে ইত্যাদি।

বাংলা শব্দ-বিভক্তি সাত প্রকার:

বিভক্তি একবচন বহুবচন
প্রথমা ০, অ, এ (য়), তে, এতে। রা, এরা, গুলি (গুলো), গণ।
দ্বিতীয়া ০, অ, কে, রে (এরে), এ, য়, তে। দিগে, দিগকে, দিগেরে, *দের।
তৃতীয়া ০, অ, এ, তে, দ্বারা, দিয়া (দিয়ে), কর্তৃক। দিগের দিয়া, দের দিয়া, দিগকে দ্বারা, দিগ কর্তৃক, গুলির দ্বারা, গুলিকে দিয়ে, *গুলো দিয়ে, গুলি কর্তৃক, *দের দিয়ে।
চতুর্থী দ্বিতীয়ার মতো দ্বিতীয়ার মতো
পঞ্চমী এ (য়ে, য়), হইতে, *থেকে, *চেয়ে, *হতে। দিগ হইতে, দের হইতে, দিগের চেয়ে, গুলি হইতে, গুলির চেয়ে, *দের হতে, *দের থেকে, *দের চেয়ে।
ষষ্ঠী র, এর। *দিগের, দের, গুলির, গণের, গুলোর
সপ্তমী এ (য়), তে, এতে। দিগে, দিগেতে, গুলিতে, গণে, গুলির মধ্যে, গুলোতে, গুলোর মধ্যে।

তারকা চিহ্নিত বিভক্তিগুলো এবং বন্ধনীতে লিখিত শব্দ চলিত ভাষায় ব্যবহৃত হয়।

  • বিভক্তি চিহ্ন স্পষ্ট না হলে সেখানে শূণ্য বিভক্তি আছে মনে করা হয়।

কর্তৃকারক

বাক্যস্থিত যে বিশেষ্য বা সর্বনাম পদ ক্রিয়া সম্পন্ন করে তাকে ক্রিয়ার কর্তা বা কর্তৃকারক বলে।

ক্রিয়ার সঙ্গে 'কে' বা 'কারা' যোগ করে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায়, তা-ই কর্তৃকারক। যেমন- খোকা বই পড়ে। (কে পড়ে? খোকা - কর্তৃকারক)। মেয়েরা ফুল তোলে। (কারা তোলে? মেয়েরা - কর্তৃকারক)।

কর্ম কারক

যাকে আশ্রয় করে কর্তা ক্রিয়া সম্পন্ন করে, তাকে কর্ম কারক বলে।

ক্রিয়ার সঙ্গে 'কী' বা 'কাকে' দ্বারা প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায়, তা-ই কর্ম কারক।

যেমন: ডাক্তার ডাক। তাকে বলো। ইত্যাদি।

করণ কারক

'করণ' শব্দটির অর্থ - যন্ত্র, সহায়ক বা উপায়।

ক্রিয়া সম্পাদনের যন্ত্র, উপকরণ বা সহায়ককেই করণ কারক বলে।

বাক্যস্থিত ক্রিয়াপদের সঙ্গে 'কিসের দ্বারা' বা 'কী দ্বারা' প্রশ্ন করলে যে উত্তরটি পাওয়া যায়, তা-ই করণ কারক। যেমন-
নীরা কলম দিয়ে লেখে। (উপকরণ- কলম)
'জগতে কীর্তিমান হয় সাধনায়।' (উপায়- সাধনা)

নিমিত্ত কারক

যাকে স্বত্ব ত্যাগ করে দান, অর্চনা, সাহায্য ইত্যাদি করা হয়, তাকে ব্যাকরণ অনুযায়ী নিমিত্ত কারক বলে।আগে সংস্কৃত ব্যাকরণ এবং বাংলা ব্যাকরণ অনুযায়ী সম্প্রদান কারক থাকলেও বর্তমানে ব্যাকরণ অনুযায়ী সম্প্রদান কারক আর নেই এখন তার বদলে রয়েছে নিমিত্ত কারক

যেমন- ভিখারিকে ভিক্ষা দাও। (স্বত্বত্যাগ না করে দিলে কর্ম কারক হবে। যেমন- ধোপাকে কাপড় দাও।) এ ক্ষেত্রে যেহেতু ব্যক্তিটি ধোপাকে ধোয়ার জন্য জামা কাপড় দিয়ে দিয়েছিল পরে ব্যক্তি জামাকাপড় নিয়ে নেবে অর্থাৎ এখানে নিঃশর্তে দান করা হলো না.তাই সম্প্রদান কারকের জায়গায় নিমিত্ত কারক তা বলাই শ্রেয়

অপাদান কারক

যা থেকে কিছু বিচ্যুত, গৃহীত, জাত, বিরত, আরম্ভ, দূরীভূত ও রক্ষিত হয় এবং যা দেখে কেউ ভীত হয়, তাকেই অপাদান কারক বলে। অপাদান কারকে সাধারণত পঞ্চমী বিভক্তি হয়।

যেমন- গাছ থেকে পাতা পড়ে। সুক্তি থেকে মুক্তো মেলে। ইত্যাদি।

অধিকরণ কারক

ক্রিয়া সম্পাদনের কাল (সময়) এবং আধারকে অধিকরণ কারক বলে। অধিকরণ কারকে সাধারণত সপ্তমী অর্থাৎ এ, য়, তে ইত্যাদি বিভক্তি যুক্ত হয়।

যেমন- বাড়িতে কেউ নেই। (আধারাধিকরণ)
বসন্তে কোকিল ডাকে। (কালাধিকরণ)
সূর্যোদয়ে অন্ধকার দূরীভূত হয়। (ভাবাধিকরণ)

সম্বন্ধ পদ

ক্রিয়াপদের সাথে সম্পর্ক না রেখে যে নামপদ বাক্যস্থিত অন্য পদের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়, তাকে সম্বন্ধ পদ বলে। যেমন: মতিনের ভাই বাড়ি যাবে। এখানে 'মতিনের' সঙ্গে 'ভাই'-এর সম্পর্ক আছে; কিন্তু 'যাবে' ক্রিয়ার সাথে সম্বন্ধ নেই। ক্রিয়ার সঙ্গে সম্বন্ধ পদের সম্বন্ধ নেই বলে সম্বন্ধ পদকে কারক বলা হয় না।

সম্বন্ধ পদের বিভক্তি

(ক) সম্বন্ধ পদে 'র' বা 'এর' বিভক্তি (ষষ্ঠী বিভক্তি) যুক্ত হয়ে থাকে। যথা: আমি + র = আমার (ভাই), খালিদ + এর = খালিদের (বই) ইত্যাদি।
(খ) সময়বাচক অর্থে সম্বন্ধ পদে কার> কের বিভক্তি যুক্ত হয়। যথা-
আজি + কার = আজিকার > আজকের (কাগজ)।
পূর্বে + কার = পূর্বেকার (ঘটনা)।
কালি + কার = কালিকার > কালকার > কালকের।
কিন্তু 'কাল' শব্দের উত্তর শুধু 'এর' বিভক্তিই যুক্ত হয়। যেমন- কাল + এর = কালের। উদাহরণ- সে কত কালের কথা।

সম্বন্ধ পদের প্রকারভেদ

সম্বন্ধ পদ বহু প্রকারের হতে পারে। যেমন:
(ক) অধিকরণ সম্বন্ধ: রাজার রাজ্য, প্রজার জমি।
(খ) জন্ম-জনক সম্বন্ধ: গাছের ফল, পুকুরের মাছ।
(গ) কার্যকারণ সম্বন্ধ: অগ্নির উত্তাপ, রোগের কষ্ট।
(ঘ) উপাদান সম্পর্ক: রূপার থালা, সোনার বাটি।
(ঙ) গুণ সম্বন্ধ: মধুর মিষ্টতা, নিমের তিক্ততা।
(চ) হেতু সম্বন্ধ: ধনের অহঙ্কার, রূপের দেমাক।
(ছ) ব্যাপ্তি সম্বন্ধ: রোজার ছুটি, শরতের আকাশ।
(জ) ক্রম সম্বন্ধ: পাঁচের পৃষ্ঠা, সাতের ঘর।
(ঝ) অংশ সম্বন্ধ: হাঁতির দাঁত, মাথার চুল।
(ঞ) ব্যবসায় সম্বন্ধ: পাটের গুদাম, আদার ব্যাপারী।
(ট) ভগ্নাংশ সম্বন্ধ: একের তিন, সাতের পাঁচ।
(ঠ) কৃতি সম্বন্ধ: নজরুলের 'অগ্নিবীণা', মাইকেলের 'মেঘনাদবধ কাব্য'।
(ড) আধার-আধেয় সম্বন্ধ: বাটির দুধ, শিশির ওষুধ।
(ঢ) অভেদ সম্বন্ধ: জ্ঞানের আলো, দুঃখের দহন।
(ণ) উপমান-উপমেয় সম্বন্ধ: ননীর পুতুল, লোহার শরীর।
(ত) বিশেষণ সম্বন্ধ: সুখের দিন, যৌবনের চাঞ্চল্য।
(থ) নির্ধারণ সম্বন্ধ: সবার সেরা, সবার ছোট।
(দ) কারক সম্বন্ধ:
(১) কর্তৃ সম্বন্ধ - রাজার হুকুম।
(২) কর্ম সম্বন্ধ: প্রভুর সেবা, সাধুর দর্শন।
(৩) করণ সম্বন্ধ: চোখের দেখা, হাতের লাঠি।
(৪) অপাদান সম্বন্ধ: বাঘের ভয়, বৃষ্টির পানি।
(৫) অধিকরণ সম্বন্ধ: ক্ষেতের ধান, দেশের লোক।

সম্বোধন পদ

'সম্বোধন' শব্দটির অর্থ আহ্বান। যাকে সম্বোধন বা আহ্বান করে কিছু বলা হয়, তাকে সম্বোধন পদ বলে। যেমন- ওহে মাঝি, আমাকে পার করো। সুমন, এখানে এসো।

সম্বোধন পদ বাক্যের অংশ। কিন্তু বাক্যস্থিত ক্রিয়াপদের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ থাকে না বলে, সম্বোধন পদ কারক নয়।

সম্বোধন পদের নিয়মাবলি

  1. অনেক সময় সম্বোধন পদের পূর্বে ওগো, ওরে, হে, অয়ি প্রভৃতি অব্যয়বাচক শব্দ বসে সম্বোধনের সূচনা করে। যেমন: 'ওগো, তোরা জয়ধ্বনি কর।' 'ওরে, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।' 'অয়ি নির্মল ঊষা, কে তোমাকে নিরমিল?'
  2. অনেক সময় সম্বন্ধসূচক অব্যয়টি কেবল সম্বোধন পদের কাজ করে থাকে।
  3. সম্বোধন পদের পরে অনেক সময় বিস্ময়সূচক চিহ্ন দেওয়া হয়। এই ধরনের বিস্ময়সূচক চিহ্নকে সম্বোধন চিহ্ন বলা হয়ে থাকে। কিন্তু আধুনিক বাংলা নিয়মে সম্বোধন চিহ্ন স্থানে কমা (,) চিহ্নের প্রয়োগই বেশি হয়। যেমন - ওরে খোকা, যাবার সময় একটা কথা শুনে যাস্।

ব্যতিক্রম

বাংলায় এমন অনেক বাক্য রয়েছে যেখানে ক্রিয়াপদ নেই। যেমন-
মাঠে মাঠে অজস্র ফসল।
ছোট ছোট ডিঙি নৌকাগুলো নদীতে ভাসমান।
এ জাতীয় ক্রিয়াহীন অনেক বাক্য বাংলায় রয়েছে। ক্রিয়া নেই বলে এই বাক্যগুলোর অন্তর্গত নাম শব্দগুলোর কারকও নেই। সেজন্য বলা হয় বাংলা বাক্য কারক-প্রধান নয়।[2] তবে বিভক্তি ছাড়া বাংলা বাক্য গঠিত হতে পারে না বলে বাংলা বাক্য বিভক্তি-প্রধান।

আরো দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, নবম-দশম শ্রেণি, ২০১৬ শিক্ষাবর্ষ, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, বাংলাদেশ
  2. বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি, সপ্তম শ্রেণি, শিক্ষাবর্ষ ২০১৬, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, বাংলাদেশ
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.