লালমাথা কুচকুচি

লালমাথা কুচকুচি (Harpactes erythrocephalus) (ইংরেজি: Red-headed Trogon), কুচকুচিয়া, লাল ট্রোগন বা বাংলাদেশী ট্রোগন Trogonidae (ট্রোগনিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Harpactes (হার্পাক্টিস) গণের সুন্দর, আগুনরঙা এক পাখি।[1][2] লালমাথা কুচকুচির বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ রাঙামাথার ফলচোর (গ্রিক: harpactes = ফলচোর; eruthro = লাল; kephalos = মাথা)।[2] সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এদের আবাস, প্রায় ২৫ লাখ ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার।[3] আবাসস্থল এত বিশাল হলেও পুরো এলাকাটির মাত্র অল্পসংখ্যক এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে এদের বিস্তৃতি রয়েছে। আবার বিগত কয়েক দশকে এদের সংখ্যা ক্রমাগতহারে হ্রাস পেয়েছে। তবে এদের মোট সংখ্যা এখনও আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেনি। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে Least concern বা ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে।[4] লালমাথা কুচকুচি বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।[2]

লালমাথা কুচকুচি
Harpactes erythrocephalus
লালমাথা কুচকুচি, পুরুষ
লালমাথা কুচকুচি, স্ত্রী

ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত  (আইইউসিএন ৩.১)
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: প্রাণী জগৎ
পর্ব: কর্ডাটা
শ্রেণী: পক্ষী
বর্গ: Trogoniformes
পরিবার: Trogonidae
গণ: Harpactes
প্রজাতি: H. erythrocephalus
দ্বিপদী নাম
Harpactes erythrocephalus
(Gould, 1834)
প্রতিশব্দ

Trogon erythrocephalus

সমগ্র পৃথিবীতে আনুমানিক ১০ হাজারেরও কম পূর্ণবয়স্ক লালমাথা কুচকুচি রয়েছে।[3]

বিস্তৃতি

বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াচীনের গহীন চিরসবুজ বনাঞ্চলে লালমাথা কুচকুচির আবাস।[4] এর বঙ্গীয় উপভাষিক নাম কুচকুচিয়া বা কুচকুইচ্যা থেকে ধারণা করা হয় যে বাংলাদেশে একসময় এরা সুলভ ও বেশ সুপরিচিত ছিল। তার কারণ হচ্ছে, যে পাখি সচরাচর জনসাধারণের চোখে পড়ে না, সেই পাখির সাধারণত কোন বাংলা নাম পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয় যে কাঠুরিয়ারা এককালে প্রায়ই পাখিটি দেখতে পেতেন।[5] কিন্তু বাংলাদেশের বনভূমির ব্যাপক ধ্বংসের ফলে পাখিটি বর্তমানে দুর্লভ ও বিপন্ন বলে বিবেচিত। সেদেশে কেবল লাউয়াছড়াকাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে পাখিটি কদাচিৎ দেখা যায়।

উপপ্রজাতি

এ পর্যন্ত লালমাথা কুচকুচির মোট দশটি উপপ্রজাতি সনাক্ত করা গেছে।[6] উপপ্রজাতিগুলো হল:

  • H. e. erythrocephalus (Gould, 1834) - হিমালয়ের পাদদেশে নেপাল থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ হয়ে মায়ানমার ও পশ্চিম থাইল্যান্ড পর্যন্ত এর বিস্তৃতি
  • H. e. helenae (Mayr, 1941) - মায়ানমারের উত্তরাংশ ও দক্ষিণ চীন (পশ্চিম ইউনান প্রদেশ) জুড়ে এর বিস্তৃতি
  • H. e. yamakanensis (Rickett, 1899) - এর মূল আবাস দক্ষিণ-পূর্ব চীন (দক্ষিণ-পূর্ব সিচুয়ান প্রদেশ থেকে ফুজিয়ান প্রদেশ পর্যন্ত)
  • H. e. rosa (Stresemann, 1929) - গুয়াংজি প্রদেশ
  • H. e. intermedius (Kinnear, 1925) - দক্ষিণ-পূর্ব ইউনান, টংকিং, উত্তর আন্নাম ও উত্তর লাওস জুড়ে এর বিস্তৃতি
  • H. e. hainanus Ogilvie-Grant, 1900) - এর মূল আবাস হাইনান দ্বীপে
  • H. e. annamensis (Robinson & Kloss, 1919) - এর মূল আবাস উত্তর-পূর্ব থাইল্যান্ড, দক্ষিণ লাওস ও দক্ষিণ আন্নাম
  • H. e.klossi (Robinson, 1915) - পশ্চিম কম্বোডিয়া, দক্ষিণ ও পূর্ব থাইল্যান্ডে এদের দেখতে পাওয়া যায়
  • H. e. chaseni (Riley, 1934) - মালয় উপদ্বীপ
  • H. e. flagrans (S. Müller, 1835) - ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা

বিবরণ

খুব কাছ থেকে পুরুষ লালমাথা কুচকুচির মাথা; চোখের চারপাশে নীলাভ-বেগুনি বৃত্ত ও ঠোঁটের নীলচে পাটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে

পাখিদের জগতে কেবল ছোট ছোট পাখিরাই রঙচঙে ও উজ্জ্বলতার দিক থেকে প্রথম। লালমাথা কুচকুচি সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। এর আকার প্রায় পাতিকাকের সমান হলেও উজ্জ্বলতার দিক থেকে এটি অন্যসব রঙিন ছোট পাখিদেরও হার মানায়। এদের দৈর্ঘ্য ৩৫ সেন্টিমিটার, ডানা ১৪.৫ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ২.২ সেন্টিমিটার, পা ১.৯ সেন্টিমিটার, লেজ ১৯.২ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৭৫ গ্রাম।[2] পুরুষ কুচকুচির চেহারা স্ত্রী কুচকুচির থেকে কিছুটা আলাদা। পুরুষ কুচকুচির মাথা, ঘাড়, গলা ও বুক সিঁদুরে লাল। পেটের দিকের বাকি অংশ উজ্জ্বল গোলাপি। বুকের লাল ও গোলাপির মাঝখানে একটি সাদা অর্ধবলয় থাকে। লেজ ক্রমান্বয়ে ছোট থেকে বড় পালকে গড়া, অর্থাৎ থরে থরে সাজানো। পিঠ থেকে লেজ হালকা দারুচিনি বা মরচে-বাদামি রঙের। ডানার ঢাকনি-পালক খুবই মিহি সাদা ও ধূসর রেখা খচিত। ডানা মূলত কালো এবং পালকের মাঝবরাবর কিছুটা অংশ সাদাটে। লম্বা লেজের কিনারা কালো ও ডগা কালো বলয়যুক্ত। কিন্তু বাইরের দিকের প্রতিটি পালকের ডগা সাদা যার ফলে লেজের কিনারা ঢেউখেলানো মনে হয়। চোখের তারা সিঁদুরে-লাল, এর চারপাশের চামড়া নীলাভ-বেগুনি। চোখের গোলকের ত্বক বেগুনি-নীল। ঠোঁটের কোণা, পা ও পায়ের পাতা বেগুনি। ঠোঁটের উপরের পাটি বেগুনি-নীল ও নিচের পাটি কালো বর্ণের। স্ত্রী কুচকুচির সারা শরীর দারুচিনি রঙের। আর এমনিতে শরীরের অন্যান্য অংশের গঠন ও রঙ একরকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির বুক, বগল ও তলপেট পীতাভ-সাদা।[1][2]

স্বভাব

লালমাথা কুচকুচি শান্ত ও লাজুক পাখি। ঘন প্রশস্ত পাতার চিরসবুজ বন ও মিশ্র বাঁশবনে বিচরণ করে। মানুষের হাতে পরিবর্তিত হয়নি এমন পাহাড়ি বনভূমিতেই এরা বাস করে; তবে দুই হাজার মিটারের বেশি উঁচু পর্বতে থাকে না এরা। খুব বেশি স্থানিক এবং একই এলাকায় বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়। সাধারণত একা বা জোড়ায় থাকতে দেখা যায়। বনের ৪-৬ মিটার উঁচু আলোআঁধারি ভরা ডালে নীরবে অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকে। বনের ঘন ছাউনির নিচে উড়ে উড়ে এরা উড়ন্ত প্রজাপতি ও মথ শিকার করে এবং শুঁয়োপোকা ধরার জন্য পাতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পোকামাকড়ের অভাব হলে মাটিতে নেমে বুনো রসালো ফল ও বাঁশের কচি পাতা খায়। এ কারণেই এর দ্বিপদ নাম "ফলচোর"।[5] গাছের আবডালে বসে এরা নম্র-মধুর সুরে কিউ...কিউ... ডাকে। মাঝে মধ্যে গান গায়: টিয়াউপ্......টিয়াউপ্[2] গলা সুরেলা হলেও এরা আসলে গায়ক পাখি নয়। এর কারণ লালমাথা কুচকুচির ভয়েস বক্স থাকে না। মজার ব্যাপার হল, কোকিলেরও ভয়েস বক্স বা সুর বাক্স নেই। সে কারণে পক্ষীবিজ্ঞানের ভাষায় এরা গায়ক পাখি নয়। পক্ষীবিজ্ঞানের ভাষায় কাক আসলে গায়ক পাখি, কারণ এর ভয়েস বক্স রয়েছে।

জন গুল্ড কর্তৃক অঙ্কিত ১৮৬১-১৮৬৫ সালের মধ্যে অঙ্কিত লালমাথা কুচকুচির চিত্র

প্রজনন

এপ্রিল থেকে জুলাই এদের প্রজননকাল। এ সময় ঘন বনে বৃক্ষের প্রাকৃতিক কোটরে কিংবা কাঠঠোকরার শুন্য গর্তে বাসা করে। বাসায় ৩-৪টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো পীতাভ এবং ডিমের মাপ ২.৮ × ২.৪ সেন্টিমিটার।[2] কত দিনে ডিম ফোটে, কত দিনে ছানারা বাসা ছাড়ে, কী হারে ছানা মারা যায় ইত্যাদি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। উন্নয়নশীল ১০-১২টি দেশের মধ্যেই পাখিটির বিস্তৃতি সীমিত বলে এ বিষয়ে গবেষণার কাজ এখনো পর্যাপ্ত নয়।[5]

তথ্যসূত্র

  1. রেজা খান, বাংলাদেশের পাখি (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০৮), পৃ. ৩৪৩-৪৪।
  2. জিয়া উদ্দিন আহমেদ (সম্পা.), বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ: পাখি, খণ্ড: ২৬ (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯), পৃ. ৬৭।
  3. Harpactes erythrocephalus, BirdLife International এ লালমাথা কুচকুচি বিষয়ক পাতা।
  4. Harpactes erythrocephalus, The IUCN Red List of Threatened Species এ লালমাথা কুচকুচি বিষয়ক পাতা।
  5. লালমাথা কুচকুচি, ইনাম আল হক, তারিখ: ২৬-০৮-২০১০, দৈনিক প্রথম আলো।
  6. Red-headed Trogon, The Internet Bird Collection এ লালমাথা কুচকুচি বিষয়ক পাতা।

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.