ভোঁদড়

ভোঁদড় বা উদবিড়াল কয়েক ধরনের আধা জলচর (এবং একটি ক্ষেত্রে জলচর) প্রধাণত মৎস্যভূক স্তন্যপায়ী প্রাণী। ভোঁদড় বলতে মুস্টিলিডি (Mustelidae) গোত্রের লুট্রিনি (Lutrinae) উপগোত্রের প্রাণীগুলোকে বোঝায়, যার মধ্যে আরও আছে উদবিড়াল, নেউল বা বেজি, ব্যাজার ইত্যাদি। বাংলাদেশে ভোঁদড়ের তিনটি প্রজাতি এবং ব্যাজারের একটি প্রজাতি দেখা যায়।[1]

ভোঁদড়
ইউরেশীয় ভোঁদড় (Lutra lutra)
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: Animalia
পর্ব: কর্ডাটা
শ্রেণী: Mammalia
বর্গ: মাংশাশী
পরিবার: Mustelidae
উপপরিবার: Lutrinae
Bonaparte, 1838
গণ

Aonyx
Enhydra
Hydrictis
Lontra
Lutra
Lutrogale
Pteronura
Algarolutra
Cyrnaonyx
Megalenhydris
Sardolutra

চিত্র:Otter ranges.png
Otter ranges

শ্রেণীবিভাগ

ভোঁদড় দু'রকমের হতে পারে:
১. নখরযুক্ত ভোঁদড় বা সাধারণ ভাষায় ভোঁদড়
২. নখহীন ভোঁদড়
নখহীন ভোঁদড়কে (Clawless otter) (বৈজ্ঞানিক নাম Amblonyx cinereus) "নখহীন" ডাকা হলেও এদের আসলে নখ রয়েছে, তবে বাইরের দিকে একটু কম বেরিয়ে থাকে। এদের দেহের রং কালচে বাদামি, দেহের নিচের অংশ ময়লা হলদে। ঠোঁট ও গলার দিককার রং প্রায় সাদা। নখহীন ভোঁদড়ের ওজন হয় ৩ থেকে ৫ কেজি।[2]

বৈশিষ্ট্য

ভোঁদড় সাধারণত লিপ্তপদী[1], মানে হাঁসের পায়ের মতো আঙ্গুলগুলো পাতলা পর্দা দিয়ে জোড়া লাগানো থাকে।[2] এদের লেজ মোটা আকারের এবং শরীর লম্বাটে গড়নের। বেশিরভাগেরই পায়ে ধারালো নখযুক্ত থাবা আছে। সাঁতার কাটার সময়ে ভোঁদড়ের নাক ও কানের ফুটো বন্ধ থাকে। এদের নাকের ডগায় লম্বা গোঁফের মতো খাড়া লোম থাকে। এই গোঁফ সংবেদনশীল বলে পানির নিচে শিকার ধরতে ভোঁদড়কে সহায়তা করে।[1] এদের গোঁফ যেহেতু খাড়া, তাই জলে ভিজে গায়ে লেপ্টে যায় না, ঘোলা জলে এই স্পর্শকাতর গোঁফ শিকারের উপস্থিতি জানান দেয়। নোখহীন ভোঁদড়ের হাত-পায়ের পাতাও খুব স্পর্শকাতর। ফলে কাদায় লুকানো ঝিনুক, শামুক, চিংড়ি, কাঁকড়া এদের হাত থেকে রক্ষা পায় না। এদের শক্তিশালী ছুঁচালো দাঁত আর মাড়ি পিচ্ছিল শিকার ধরতে বা মাছের মুড়ো চিবোতে অত্যন্ত কার্যকর।[2]

ভোঁদড়ের দেহে দুই স্তর লোম রয়েছে। প্রথম স্তর আকারে ছোট[2], কোমল এবং তাপরোধী। এই অন্তঃলোম বাতাস ধরে রেখে পানির নিচে এদের দেহ উষ্ণ ও শুকনো রাখে।[1] এই লোমগুলো পানিরোধী। দ্বিতীয় স্তরের লোম লম্বা। এই লোমই আমাদের চোখে পড়ে, এগুলো জলে ভিজে ওঠে। এদের লেজ চ্যাপ্টা, ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি (মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত ১৮ থেকে ২২ ইঞ্চি) লম্বা। নৌকার দাঁড়ের মতো হাত-পা (পা হাতের চেয়ে বড়), শক্ত খাড়া গোঁফ জলে শিকার করার অত্যন্ত উপযোগী।[2] ভোঁদড় লিপ্তপদী বলে পানির নিচে খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারে এবং পানির উপরে মাথা না তুলে একবারে প্রায় আধা কিলোমিটার যেতে পারে।[1]

ভোঁদড় বা উদবড়ালের গন্ধ বিকট একপ্রকার গন্ধ রয়েছে; অভিজ্ঞজনেরাও এ গন্ধকে বাঘের গন্ধ বলে ভুল করতে পারেন। ভোঁদড়েরা দলবেঁধে থাকলে প্রচন্ড চেঁচায়। অধিকাংশ সময় এরা বাচ্চা সাথে নিয়ে শিকার খোঁজে। ভোঁদড়-গোত্রের অন্যান্য প্রাণীরা নিশাচর হলেও ভোঁদড় সব সময়ই কর্মতৎপর।[2]

উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের সামুদ্রিক ভোঁদড় পাথরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এরা সামনের পা দিয়ে পাথর টেনে তুলে তার সহায়তায় শামুক, ঝিনুক ইত্যাদির খোল ভেঙ্গে থাকে। এরা ভাসমান অবস্থায় বুকের উপরে পাথর রেখে তাকে কামারের নেহাইয়ের মতো ব্যবহার করে।[1]

খাদ্য ও স্বভাব

Northern river otters

অনেক ভোঁদড় শীতল পানিতে বসবাস করে এবং শরীর উষ্ণ রাখার জন্য এদেরকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। দিনে ইউরেশিয়ান ভোঁদড়কে তাদের দেহের ওজনের ১৫ শতাংশ আর সামুদ্রিক ভোঁদড়কে তাপমাত্রাভেদে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।

যদিও ভোঁদড়ের মূল খাদ্য মাছ, তবে এরা অন্যান্য জলজ অমেরুদন্ডী প্রাণী, যেমন: কাঁকড়া, পানির ব্যাঙ ইত্যাদিও দলবেঁধে শিকার করে থাকে[3]। কিছু ভোঁদড় শেলফিশ খুলতে দক্ষ, আর অন্যরা ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী বা পাখি শিকার করে। নির্দিষ্ট শিকারের উপরে নির্ভরশীল বলে ভোঁদড় শিকারশূণ্যতার ঝুঁকিপূর্ণ।

অন্যান্য ভোঁদড়ের যেমন প্রথম পছন্দ মাছ, নোখহীন ভোঁদড়ের সবচেয়ে পছন্দের শিকার চিংড়ি, কাঁকড়া, ঝিনুক, শামুক ইত্যাদি শক্ত খোলসের প্রাণী।[2]

ভোঁদড় সমাজবদ্ধ জীব। এরা বেশ ক্রীড়াপ্রবণও। বুদ্ধিমান এই প্রাণীগুলো বেশ বন্ধুবৎসল এবং সহজেই পোষ মানে। অনেক স্থানে, বিশেষত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ও সুন্দরবন এলাকায় পোষা ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করতেও দেখা যায়।[1]

আবাস

বেশিরভাগ ভোঁদড় জলাশয়ের কিনারে, গর্তে বাস করে। শিকার করা বা ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছাড়া এরা পানিতে নামে না, ডাঙাতেই বেশিরভাগ সময় কাটায়। তবে সামুদ্রিক ভোঁদড়রা সমুদ্রে, জীবনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করে।

ভোঁদড়, জোয়ারপ্রবণ এলাকায় বাসা তৈরি করে জোয়ার-সীমানার উঁচুতে কোনো বড় গাছের তলায় গর্ত করে। গর্তের কয়েকটি মুখ থাকে। গর্তে ঢুকতে হয় জলের তলা দিয়ে। কিন্তু বাচ্চা প্রসবের জায়গাটি থাকে শুকনো এলাকায়। মায়ের সঙ্গে দুই-তিনটির বেশি বাচ্চা দেখা যায় না। সামুদ্রিক ভোঁদড় ছাড়া অন্য কোনো ভোঁদড় নোখহীন ভোঁদড়ের মতো লবণ সহ্য করতে পারে না। নোখহীন ভোঁদড়ের শত্রু হলো বাঘ, কুমির, হাঙর, মেছোবিড়ালমানুষ

বিস্তৃতি

সাতটি বর্গে প্রায় তেরোটি প্রজাতির ভোঁদড় অস্ট্রেলিয়া ছাড়া মোটামুটি গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে আছে।[1]

বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় ভোঁদড়কে "ধাইরা" এবং "বাদার ধাইরা" (নখহীন ভোঁদড়) নামে ডাকা হয়। বাংলাদেশের খাল-বিলে চরা ভোঁদড়ের বৈজ্ঞানিক নাম Lutra perspicillata, যেগুলোর ওজন হয় ৭ থেকে ৯ কেজি।[2]

গ্যালারি

তথ্যসূত্র

  1. ভোঁদড়। ঢাকা: এশিয়াটি সোসাইটি, বাংলাদেশ। ৩ মার্চ ২০১২ তারিখে মূল (ওয়েব) থেকে আর্কাইভ করা।
  2. থসরু চৌধুরী (২১ জুলাই ২০১০)। "ছোট ভোঁদড়" (ওয়েব)দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা। পৃষ্ঠা ২৪। সংগ্রহের তারিখ জুলাই ২১, ২০১০
  3. Kruuk H। Otters: ecology, behaviour and conservation। Oxford Biology। পৃষ্ঠা 99–116। আইএসবিএন 0198565879।
  • Gallant, D., L. Vasseur, & C.H. Bérubé (2007). Unveiling the limitations of scat surveys to monitor social species: a case study on river otters. Journal of Wildlife Management 71:258–265.

বহিঃসংযোগ

  • ARKive Photographs and Videos of Eurasian Otter. On the same site are photos and videos of Marine otter (Lontra felina), Sea otter (Enhydra lutris), Marine otter (Lontra felina) , Sea otter (Enhydra lutris), Smooth-coated otter (Lutrogale perspicillata) and the Giant otter (Pteronura brasiliensis).
  • The Otter Trust
  • International Otter Survival Fund
  • Otternet
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.