ভারতী

ভারতী ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত প্রকাশিত একটি বাংলা মাসিক পত্রিকা। পত্রিকাটির প্রথম প্রকাশ শ্রাবণ ১২৮৪ বঙ্গাব্দ (১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ)। প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রথম সাত বছর এই পত্রিকার সম্পাদনা করেন। পরে বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণকুমারী দেবী, হিরণ্ময়ী দেবী, সরলা দেবী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ঠাকুর পরিবারের সদস্যরাই প্রধানত এই পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঠাকুরবাড়ির স্বনামধন্য লেখক-লেখিকারা এই পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। বালক পত্রিকাটি কিছুকাল এই পত্রিকার সঙ্গে যুগ্মভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল স্বদেশীয় ভাষার আলোচনা, জ্ঞানোপার্জন ও ভাবসমৃদ্ধিতে সাহায্য করা। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এই পত্রিকায়। এই পত্রিকা সেযুগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গ্রন্থসমালোচনারও দুঃসাহস প্রকাশ করে। রবীন্দ্রনাথ রচিত বাংলা ভাষার প্রথম ছোটোগল্প "ভিখারিণী" ও কবির অন্যতম উল্লেখযোগ্য কীর্তি ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী-র কবিতাগুলি এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। বিদেশি পত্রিকার আদলে ভারতী পত্রিকায় একাধিকবার বারোয়ারি উপন্যাস রচনার আয়োজন করা হয়। এই পত্রিকায় প্রকাশিত রচনার মান অত্যন্ত উন্নত ছিল। ১৯১৫ সালে মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক তরুণ লেখক গোষ্ঠী। "ভারতী গোষ্ঠী" নামে পরিচিত এই লেখকগোষ্ঠীর সদস্যরা ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, অসিতকুমার হালদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচী, চারুচন্দ্র রায়, করুণাধন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এঁরা সকলেই ছিলেন রবীন্দ্র গোষ্ঠীভুক্ত। এঁরা ছাড়াও এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন প্রমথ চৌধুরী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়মোহিতলাল মজুমদার। পঞ্চাশ বছর এই পত্রিকাটির অস্তিত্ব ছিল।

ইতিহাস

ভারতী পত্রিকার পৃষ্ঠপোষণা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সক্রিয় ভূমিকা ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাবে ১৮৭৭ সালের জুলাই মাসে (শ্রাবণ, ১২৮৪ বঙ্গাব্দ) দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় এই পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় নিবন্ধে পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল:

" ভারতীর উদ্দেশ্য যে কি তাহা নামেই প্রকাশ। ভারতীর এক অর্থ বাণী, আর এক অর্থ বিদ্যা, আর এক অর্থ ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। বাণীচ্ছলে স্বদেশীয় ভাষার আলোচনাই আমাদের উদ্দেশ্য। বিদ্যাস্থলে বক্তব্য এই যে, বিদ্যার দুই অঙ্গ, জ্ঞানোপার্জন এবং ভাবস্ফুর্তি। উভয়েরই সাধ্যানুসারে সহায়তা করা আমাদের উদ্দেশ্য। স্বদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাস্থলে বক্তব্য এই যে, আলোচনার সময় আমরা স্বদেশ বিদেশ নিরপেক্ষ হইয়া যেখান হইতে যে জ্ঞান পাওয়া যায়, তাই নতমস্তকে গ্রহণ করিব। কিন্তু ভাবালোচনার সময় আমরা স্বদেশীয় ভাবকেই বিশেষ স্নেহদৃষ্টিতে দেখিব।"[1]

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর পত্রিকার সম্পাদক হলেও প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথই।[2]ভারতী পত্রিকার প্রথম প্রকাশকালে রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ষোলো বছর তিন মাস। প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই পত্রিকার অন্যতম লেখক। তার এই সময়ের রচনা ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী-র কবিতাগুচ্ছ, মাইকেল মধুসূদনের "মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা", এবং "ভিখারিণী" ও "করুণা" নামে দুটি গল্প প্রকাশিত হয় ভারতী-তে। উল্লেখ্য, "ভিখারিণী" বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটোগল্প। ভারতী পত্রিকার বিকাশে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা তাই অনস্বীকার্য।

ভারতী পত্রিকাটি দীর্ঘ ৫৯ বছর স্থায়ী হয়। বিভিন্ন সময়ে যাঁরা এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১২৮৪-১২৯০), স্বর্ণকুমারী দেবী (১২৯১-১৩০১), হিরণ্ময়ী দেবীসরলা দেবী (১৩০২-১৩০৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৩০৫), সরলা দেবী (১৩০৬-১৩১৪), স্বর্ণকুমারী দেবী (১৩১৫-১৩২১), মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৩২২-১৩৩০), এবং সরলা দেবী (১৩৩১-১৩৩৩, কার্তিক)।[2]

দীর্ঘ ৫৯ বছরের ইতিহাসে ভারতী একাধিক সম্ভাবনাময় লেখকের উত্থানে সাহায্য করে। সরলা দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী, হিরণ্ময়ী দেবী প্রমুখ নারীদের সম্পাদনায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে এই পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এখানে। প্রকাশিত হয় স্বর্ণকুমারী দেবীর উপন্যাস, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নানা রচনা, এবং প্রমথ চৌধুরীর গদ্যও। ১৩১৪ বঙ্গাব্দে ভারতী পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড়দিদি

১৮৭৭ সাল থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত ভারতী পত্রিকার সম্পাদকীয় কার্যালয় ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। সরলা দেবী রামভূজ দত্তচৌধুরীকে বিবাহ করে পাঞ্জাবে চলে যাওয়ার সময় ভারতীয় সত্ত্ব প্রদান করে যান মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে। ১৯১৫ সালে ঠাকুরবাড়ির ঠিকানা থেকে ভারতী-র সম্পাদকীয় কার্যালয় উঠে আসে ২২ সুকিয়া স্ট্রিটে (কৈলাস বসু স্ট্রিট)। নলিনীকান্ত সরকারের লেখা থেকে জানা যায় যে তিনতলা এই বাড়িটির এক তলায় ছিল কান্তিক প্রেস, দোতলায় ছাপাখানা এবং তিন তলায় ছিল ভারতী-র কার্যালয়। মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন কান্তিক প্রেস ও ভারতী উভয়েরই মালিক। মণিলালের সঙ্গে যোগ দিলেন তার সাহিত্যিক বন্ধু সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়। দুই বন্ধুর যুগ্মসম্পাদনায় কান্তিক প্রেস থেকেই নবপর্যায় ভারতী পত্রিকার আত্মপ্রকাশ।[1] এই সময়ই এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে রবীন্দ্রানুসারী ভারতী গোষ্ঠী

পাদটীকা

  1. সন্দীপ দত্ত, "বাংলা সাময়িকপত্র: একাল ও সেকাল" (পর্ব তেরো), একদিন, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৭
  2. সন্দীপ দত্ত, "বাংলা সাময়িকপত্র: একাল ও সেকাল" (পর্ব তেরো), একদিন, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৭

তথ্যসূত্র

  • সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী, সংকলন ও সম্পাদনা: শিশিরকুমার দাশ, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০০৩
  • বাংলা সাহিত্য পরিচয়, ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তুলসী প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০৮
  • বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পঞ্চম খণ্ড, সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯৯
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.