অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ই আগস্ট, ১৮৭১- ৫ই ডিসেম্বর, ১৯৫১) একজন খ্যাতিমান ভারতীয় বাঙালি চিত্রশিল্পী, নন্দনতাত্ত্বিক এবং লেখক।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Abanindranath Tagore
জন্ম(১৮৭১-০৮-০৭)৭ আগস্ট ১৮৭১
মৃত্যু৫ ডিসেম্বর ১৯৫১(1951-12-05) (বয়স ৮০)
জাতীয়তাভারতীয়
আন্দোলনবেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট
স্বাক্ষর

জন্ম ও পরিবার

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৭ আগস্ট, ১৮৭১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র । দাদা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

জীবনপঞ্জি

পিতামহ ও পিতা ছিলেন একাডেমিক নিয়মের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পী। এ সুবাদে শৈশবেই চিত্রকলার আবহে বেড়ে ওঠেন তিনি। ১৮৮১ থেকে ১৮৮৯ পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন। '৮৯ সালেই সুহাসিনী দেবীর সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮৯০-এ গড়া রবীন্দ্রনাথের খামখেয়ালি সভার সভ্য হয়ে তিনি কবিতা পড়েছেন; নাটক করেছেন। ১৮৯৬ সালে কোলকাতা আর্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম এই মর্যাদা লাভ করেন। ১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরি ভারত ভ্রমণে এলে আর্ট গ্যলারি পরিদর্শনের সময় তাঁদেরকে ওরিয়েন্টাল আর্ট সম্পর্কে বোঝাবার দায়িত্ব পান। ১৯১৩ সালে লন্ডনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়; এবং তিনি ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে সি আই ই উপাধি লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টর অফ লিটারেচার ডিগ্রি প্রদান করে ১৯২১ সালে। ১৯৪২ সালে শিল্পীপত্নীর মৃত্যু হয়। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর আচার্যরূপে দায়িত্ব পালন করেন।

চিত্রসাধনা

অবনীন্দ্রনাথের কুটুম কাটাম।

অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকলার পাঠ শুরু হয় তৎকালীন আর্ট স্কুলের শিক্ষক ইতালীয় শিল্পী গিলার্ডির কাছে। তাঁর কাছে অবন শেখেন ড্রয়িং, প্যাস্টেলজলরং। পরবর্তীতে ইংরেজ শিল্পী সি এল পামারের কাছে লাইফ স্টাডি, তেলরং ইত্যাদি শিক্ষা অর্জন করেন। ভারতীয় রীতিতে তাঁর আঁকা প্রথম চিত্রাবলি ‘কৃষ্ণলীলা-সংক্রান্ত’। এই রীতি অনুসারী চিত্রশিল্পের তিনি নব জন্মদাতা। ১৮৯৫ সালের দিকে অবনীন্দ্রনাথ প্রথম নিরীক্ষা শুরু করেন। ১৮৯৭ সালে আঁকলেন শুক্লাভিসার- রাধার ছবি মাঝে রেখে উৎকীর্ণ কবি গোবিন্দ দাসের পঙ্ক্তিমালা, যা ছিল পাশ্চাত্য নিয়মের সাথে ভারতীয় রীতির নবতর সংশ্লেষণ; যোজন-বিয়োজন। ১৯০০ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে কৃষ্ণলীলা সিরিজ প্রদর্শিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ই বি হ্যাভেলের উদ্যোগে লর্ড কার্জনের দিল্লি দরবারে আরো দুটি প্রদর্শনী এবং লন্ডনের ‘স্টুডিও’ পত্রিকায় চিত্রালোচনা প্রকাশিত হলে অবনীন্দ্রনাথের ছবি শিল্পরসিকদের মাঝে আগ্রহের জন্ম দেয়। তাঁর শাজাহানের অন্তিমকাল মোঘল মিনিয়েচারের এক লোকায়ত নিরীক্ষা,যেখানে শাজাহানের অন্তিম সারবত্তা করুণ রসের। ক্রমান্বয়ে আকঁলেন বুদ্ধ ও সুজাতা (১৯০১), কালীদাসের ঋতুসঙ্ঘার বিষয়ক চিত্রকলা (১৯০১), চতুর্ভুজা ভারতমাতা(১৯০৫), কচদেবযানি (১৯০৬), শেষযাত্রা (১৯১৪)। জাপানি প্রভাবে অবনীন্দ্রনাথ অঙ্কন করেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ওমর খৈয়াম (১৯৩০)চিত্রাবলি। চিত্রসাধনের শেষ পর্যায়ে অবনীন্দ্রনাথের শিল্পচিন্তা নতুন মাত্রা লাভ করে। গড়ে তোলেন কুটুম কাটাম – আকারনিষ্ঠ এক বিমূর্ত রূপসৃষ্টি।

সাহিত্যসাধনা

প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা আনুমানিক ছাব্বিশ। গল্প কবিতা চিঠিপত্র শিল্প আলোচনা যাত্রাপালা পুথি স্মৃতিকথা সব মিলিয়ে প্রকাশিত রচনা সংখ্যা প্রায় তিনশ সত্তরটি। পিত্রব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অণুপ্রেরণায় লেখালেখির সূত্রপাত। কবিগুরু ‘বাল্য গ্রন্থাবলী’র কর্মসুচী শুরুর প্রাক্কালে বলেছিলেন,

ছোটদের পড়বার মত বই বাংলাভাষায় বিশেষ নেই। এ অভাব আমাদের ঘোচাতে হবে। তুমি লেখ।

[1] ‘বাল্য গ্রন্থাবলী’র প্রথম ও তৃতীয় বই অবনীন্দ্রনাথের শকুন্তলা ও ক্ষীরেরপুতুল। অবনীন্দ্রনাথের প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ‘নবযুগ’পত্রে ১৩১১ শ্রাবণে, ‘নবদুর্ব্বা’ নামে। রানী বাগেশ্বরী অধ্যাপক থাকার সময় ১৯২১-১৯২৯ সালের মধ্যে যে ঊনত্রিশটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেগুলি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪১ সালে ‘বাগেশ্বরীশিল্প প্রবন্ধাবলী’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।বাংলা ভাষায় লিখিত ভারতীয় নন্দন তত্ত্বের একটি আকর গ্রন্থ হিসাবে যা বিবেচিত হয়। চিত্রকলায় ধারাবাহিকতায় লেখালেখির জগতেও আপন ঐতিহ্যের অনুরাগী ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ।তিনি বেশ কিছু যাত্রাপালা ও পুথি রচনা করেন। যার মধ্যে ‘অরণ্যকান্ত পালা’কঞ্জুশের পালা,কাক ও পানির পালা,ঋষিযাত্রা,মারুতির পুথী,চাইবুড়োর পুথি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম

  • ওমর খৈয়াম (জাপানী রীতিতে আঁকা)
  • শাহাজাদপুরের দৃশ্যাবলী
  • আরব্যপোন্যাসের গল্প
  • বসন্তের হিমালয়
  • কবিকঙ্কন চন্ডী
  • প্রত্যাবর্তন
  • শেষযাত্রা
  • সাজাহান
  • কৃষ্ণলীলাবিষয়ক চিত্রাবলী
  • বজ্রমুকুট
  • ঋতুসংহার
  • বুদ্ধ
  • সুজাতা

প্রকাশিত গ্রন্থ

  • শকুন্তলা (১৮৯৫)
  • ক্ষীরের পুতুল (১৮৯৬)
  • রাজকাহিনী (১৯০৯)
  • ভারত শিল্প (১৯০৯)
  • ভূত পত্রীর দেশ (১৯১৫)
  • নালক (১৯১৬)
  • বাংলার ব্রত (১৯১৯)
  • খাজাঞ্জির খাতা (১৯২১)
  • প্রিয় দর্শিকা (১৯২১)
  • চিত্রাক্ষর (১৯২৯)
  • বসন্তের হিমালয়
  • বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী (১৯২৯)
  • বুড়ো আংলা (১৯৪১)
  • জোড়াসাঁকোর ধারে (১৯৪৪)
  • সহজ চিত্র শিক্ষা (১৯৪৬)
  • ভারত শিল্পের ষড়ঙ্গ (১৯৪৭)
  • আলোর ফুলকি (১৯৪৭)
  • ভারত শিল্পে মূর্তি (১৯৪৭)
  • মাসি (১৯৫৪)
  • একে তিন তিনে এক (১৯৫৪)
  • শিল্পায়ন (১৯৫৫)
  • মারুতির পুঁথি (১৯৫৬)
  • রং বেরং (১৯৫৮)

[2]

মৃত্যু

তিনি ১৯৫১ সালে ৫ই ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

সহায়কগ্রন্থ

  • পশ্চিম বঙ্গ অবনীন্দ্র সংখ্যা,তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ ১৪০২
  • মইনুদ্দীন খালেদ-দশ বাঙালি শিল্পী প্যাপিরাস-২০০৩
  • অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর -বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী- আনন্দ পাবলিশার্স-১৯৯৯।

তথ্যসূত্র

  1. ঠাকুর, অলোকেন্দ্রনাথ। ছবির রাজা ওবিন ঠাকুর। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা ২৪।
  2. সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত; বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; দ্বিতীয় সংস্করণ: ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা: ৮, আইএসবিএন ৯৮৪-০৭-৪৩৫৪-৬
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.