নীলটুনি

নীলটুনি (Cinnyris asiaticus) (ইংরেজি: Purple Sunbird), দুর্গা টুনটুনি বা মধুচুষকি নেকটারিনিইডি (Nectariniidae) পরিবার বা গোত্রের অন্তর্গত একটি ক্ষুদ্রকায় মধুপায়ী পাখি।[1]

নীলটুনি
পুরুষ নীলটুনি, প্রজনন ঋতুতে
স্ত্রী নীলটুনি

ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত  (আইইউসিএন ৩.১)
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: Animalia
পর্ব: কর্ডাটা
শ্রেণী: পক্ষী
বর্গ: Passeriformes
পরিবার: Nectariniidae
গণ: Cinnyris
প্রজাতি: C. asiaticus
দ্বিপদী নাম
Cinnyris asiaticus
Latham, 1790
প্রতিশব্দ

Arachnechthra intermedia
Nectarinia mahrattensis

বিবরণ

পুরুষ পাখি গাঢ় নীল বা ধাতব-বেগুনী যা দূর থেকে কালো মনে হয়, কেবল দেহে সরাসরি আলো পড়লে বোঝা যায় দেহে কতো চাকচিক্য। ঠোঁট, চোখ, পেট ও অবসারণী এবং পা কালো। কখনো কখনো বুকে একটি তামাটে-লাল বন্ধনী থাকে। বুকের পাশে একগুচ্ছ কমলা-হলুদ পালক থাকে যা বেশিরভাগ সময় দেহের অন্য পালকের নিচে চাপা পড়ে থাকে। যখন পুরুষ পাখি নাচে তখন এদের এ পালকের বাহার ফুটে উঠে। তবে এই রূপ শুধু বাসা বাঁধা ও ডিম পাড়ার মৌসুমেই। ছানারা বাসা ছেড়ে উড়ে যাওয়ার পর থেকে এই নীলচে বেগুনি ও কালো রং আস্তে আস্তে ফ্যাকাশে হতে থাকে। প্রজননের বাইরের অন্তর্বর্তীকালে পুরুষ দেখতে প্রায় স্ত্রী পাখির মতো, কেবল থুতনী থেকে বুক পর্যন্ত ছোপ ছোপ কালোর একটি মোটা ডোরা থাকে। এ রঙ থেকে পুরুষের পুরো কালো-নীল রঙে পৌঁছাতে অনেকগুলো অবস্থানে এদের দেখা যায়। স্ত্রী পাখির উপরের দিক ফিকে জলপাই রঙের। ভ্রু হলুদাভ ও গাঢ় বাদামী মুখোশ থাকে। নিচের অংশ হালকা হলুদাভ এবং তাতে হলুদের বিভিন্নতা দেখা যায়। লেজ ধূসর কালো, লেজের পালকের আগার কোণায় সাদা রঙ থাকে। দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ১০ সেন্টিমিটার, যার লেজ প্রায় ৩.৩ সেন্টিমিটার এবং ঠোঁট ২ সেন্টিমিটার।[1] নীল টুনিরা আট থেকে বার বছর পর্যন্ত বাঁচে।[2]

intermedius উপপ্রজাতি; বুকের পাশে কমলা হলুদ ছোপ, যা অধিকাংশ সময় অন্য পালকের নিচে ঢাকা থাকে

উপপ্রজাতি

পুরুষ নীলটুনি, প্রজননের বাইরের অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা

নীলটুনির তিনটি উপপ্রজাতি সনাক্ত করা গেছে। এরা হচ্ছে-

  • C. asiaticus asiaticus (Latham, ১৭৯০), পশ্চিম ও পূর্ব ব্যতীত সমগ্র ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা
  • C. asiaticus brevirostris (Blanford, ১৮৭৩), ভারতের রাজস্থান ও গুজরাটের পশ্চিমাংশ, পাকিস্তান, পূর্ব আফগানিস্তান, দক্ষিণ-পূর্ব ইরান, উত্তর আরব আমিরাত ও ওমান
  • C. asiaticus intermedius (Hume, 1870), বাংলাদেশ, ভারতের পূর্বাংশ, মিয়ানমার, চীনের দক্ষিণাঞ্চল (ইউনান প্রদেশ), লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড।[3]

আচরণ ও খাদ্যাভ্যাস

নীলটুনি গানের পাখি। পুরুষ টুনি চমৎকার সুরে গান গায়। ভোরে সব পাখির আগে এরা মধুর কণ্ঠে ঘুমভাঙানি গান গেয়ে ওঠে। এরা মিষ্টিমধুর চি-হুইট-চি-হুইট-চি-হুইট স্বরে গান করে। যতটুকু পাখি, আওয়াজ তার তুলনায় বেশ জোরালো। স্ত্রী টুনি সাধারণত নীরব, স্বরও বেশ কর্কশ।

মধু পানে মগ্ন নীলটুনি

হামিং বার্ডের মতো এরাও বাতাসে স্থির থেকে উড়তে পারে। বাতাসে ঢেউ খেলিয়ে আলোর ঝিলিকের মতো এগাছে-ওগাছে, এ ফুল থেকে ও ফুলে উড়ে উড়ে মধু পান করে। খুব চঞ্চল। ফুলের বোঁটার ওপর বসে বাদুড়ের মতো ঝুলে পড়ে মধু পান করে। সচরাচর একাকি বা জোড়ায় অথবা অন্য পাখি যেমন ফুলঝুরি, ফিঙে, পাতা বুলবুলি, বুলবুলি বা চটকের সাথে দলে দলে ঘুরে বেড়ায়। মূলত মধু পান করে তবে সঙ্গে কিছু পোকামাকড়ও খায়। আর যখন মধুর অভাব দেখা দেয় তখন পুরোপুরি পোকামাকড় খেয়ে জীবনধারণ করতে পারে।[1]

প্রজনন

শীত ও বসন্তই প্রধানত নীলটুনির প্রজনন কাল। বাসার জায়গা পছন্দ করা এবং বাসা তৈরির পুরো দায়িত্ব স্ত্রী নীলটুনির। পুরুষ টুনি মাঝে মাঝে এসে কাজ তদারক করে। স্ত্রী টুনি দু-তিনটি ধূসর বা সবুজাভ সাদা ডিম পাড়ে। এর ওপর থাকে বাদামি ও বেগুনী ছোপ। স্ত্রী টুনি বাসায় বসে যখন ডিমে তা দেয়, তার লম্বা ছুঁচালো ঠোঁটটি দরজার মুখে বেরিয়ে থাকে। পুরুষ টুনি কখনোই ডিমে তা দেয় না। ডিম ফোটে ১৪-১৫ দিনে। তখন পুরুষ টুনি ক্ষণে ক্ষণে ডাকতে থাকে। স্ত্রী পুরুষ উভয়ে বাচ্চাদের খাওয়ায়। ছানা ১৬-১৭ দিনে বড় হয় এবং বাসা ছাড়ে। বাসা ছাড়ার পরও এরা সপ্তাহ দুয়েক বাবা-মায়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকে। একসময় নিজেরাই ঘর বাঁধে। এরা বছরে দুবার ডিম পাড়ে।[2]

বাসা

নীলটুনি মানববসতির আশেপাশেই বাসা করে, তবু সচরাচর তা চোখে পড়ে না। তার কারণ হঠাৎ দেখলে বাসাটাকে ঝোপ-জঙ্গল ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতেই এ ধরনের ছদ্মবেশী বাসা। নীল টুনি প্রতি মৌসুমে নতুন বাসা বানায়। তবে বাসা শক্তপোক্ত থাকলে দু-তিনবারও ব্যবহার করতে পারে।

এদের বাসার গড়ন ও সাজসজ্জায় রুচি ও বিলাসের ছাপ স্পষ্ট। সৌন্দর্য ও প্রকৌশলগুণে বাবুইয়ের পরই এদের বাসার স্থান। কখনও বাগানে বা উঠোনে বাগানবিলাস, বরই, ডালিম, লাউ, কুমড়া বা অন্য লতানো গাছ যা অযত্নে বেড়ে ওঠে, তাতে একটি অপরিচ্ছন্ন ঝুলন্ত থলের মত বাসা বানায় যার গায়ে মরা শুঁয়োপোকার মল, খোলস, ফুলের পাপড়ি, নোংরা জিনিসপত্র যেমন মরা পাতা বা কাগজের টুকরো ইত্যাদি থাকে। এসব জিনিস প্রচুর পরিমাণে মাকড়সার জাল দিয়ে বাসার গায়ে সেঁটে রাখা হয়। মাকড়সার জাল দিয়ে বাসার ভিত রচনা করা হয়। মূল বাসা হয় শুকনো পাতা, ঘাস, মাকড়সার জাল ও তন্তু দিয়ে। বাসার উপরের দিকে এক পাশে গোলাকার প্রবেশ পথ থাকে। প্রবেশপথের মুখের ওপর সানশেডের মতো থাকে। বৃষ্টির পানি আটকানোর জন্যই হয়তো এ ব্যবস্থা। বাসায় ডিম ও বাচ্চা রক্ষার জন্যও সব ধরনের ব্যবস্থা আছে। ভেতরে ডিম রাখার জন্য থাকে কোমল বিছানা। বাসাটি ঝোপঝাড়-লতার সঙ্গে ভালোভাবে আটকানো থাকে, বাতাসে দোলে। বাতাসের সময় ভারসাম্য রক্ষার জন্য নিচের দিকে মাকড়সার জাল ও লতাপাতা সুতোর মতো ঝোলানো থাকে।[2]

তথ্যসূত্র

  1. বাংলাদেশের পাখি, রেজা খান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা (২০০৮), পৃ. ২৫৪।
  2. , অতিসুন্দর নীল টুনি, আ ন ম আমিনুর রহমান, ২৬-০৪-২০১১, দৈনিক প্রথম আলো।
  3. , The Internet Bird Collection, নীলটুনি বিষয়ক পাতা।

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.