নারায়ণদেব

নারায়ণদেব মধ্যযুগের মনসামঙ্গল কাব্যের একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি। তিনি তার যে সংক্ষিপ্ত আত্মপরিচয় দিয়েছেন তা থেকে জানা যায়, তার বৃদ্ধ পিতামহ উদ্ধারণদেব রাঢ়দেশ ত্যাগ করে পূর্ববঙ্গের বোরগ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। বোরগ্রাম ময়মনসিংহ জেলার পূর্বসীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। অনুমিত হয় তিনি চৈতন্যপূর্ববর্তী যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার রচিত মনসামঙ্গল কাব্য আসামের ব্রহ্মপুত্র এবং সুরমা উপত্যকা , উভয় অঞ্চলেই ব্যাপক প্রচার লাভ করেছিল। এর ফলে অসমিয়া ভাষায় তার কাব্যটি আনুপূর্বিক পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এমন কি কেউ কেউ তাকে অসমিয়া ভাষার আদি কবির মর্যাদা দিয়েছেন।[1]

নারায়ন দেব (পদ্মাপুরাণ)
সময়কালপঞ্চদশ শতাব্দের শেষ পাদ থেকে ষোড়শ শাতাব্দের প্রথম পাদ
ধরনমঙ্গলকাব্য
বিষয়বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ

জন্ম ও বংশ পরিচয়

নারায়ণদেব তার বেশিরভাগ পুঁথিতে সংক্ষেপে আত্মজীবনীর উল্লেখ করেছেন। যদিও এক পুঁথি থেকে অন্য পুঁথির নানা বৈষম্য আছে তবুও মোটামুটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বলা হয় তিনি রাঢ়দেশের এক কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন; তার পিতামহ উদ্ধারণদেব (উদ্ধবরাম) রাঢ়দেশ ত্যাগ করে ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত বোরগ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। পিতার নাম নরসিংহ আর মাতা রুক্মিণী । কবিরা ছিলেন কায়স্থ এবং মৌদ্‌গল্য গোত্র। কবির জন্মস্থান নিয়ে এক সময় খুব বিতর্ক ছিল। ব্রহ্মপুত্রের তীরে অবস্থিত বোরগ্রাম বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত, কিন্তু কোনো একসময় শ্রীহট্টবাসীরা নারায়ণদেবকে শ্রীহট্টের অধিবাসী বলে দাবী করতেন। এর কারণ হিসাবে তারা পূর্বে বোরগ্রামের শ্রীহট্টের অন্তর্ভুক্তির কথা উল্লেখ করতেন। ১৩১৮ সনের রংপুর সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকায় সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী অনেক তথ্য প্রমাণসহ কবিকে ময়মনসিংহবাসী হিসাবে প্রমাণ করতে তৎপর হন, কিন্তু এর পাল্টা হিসাবে শ্রীহট্টবাসী বিরজাকান্ত ঘোষ ১৩১৯ সনে রংপুর সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকায় নারায়ণদেবকে শ্রীহট্টের অধিবাসী হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। ১৩২০ সনে 'সৌরভ' পত্রিকার মাঘ সংখ্যায় রমানাথ চক্রবর্তী সতীশচন্দ্রকে সমর্থন করেন। আবার অচ্যুতচরণ চৌধুরী 'শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত' শীর্ষক গ্রন্থে নারায়ণদেবকে আসামবাসী বলে দাবী করেছিলেন।[2]

মনসামঙ্গলের কবি হিসাবে নারায়ণদেব

নারায়ণদেবের উপাধি ছিল 'সুকবি-বল্লভ'। তিনি মনসামঙ্গল কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কিনা তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের অবকাশ থাকলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে তিনি বাংলা ও আসামের অন্যতম জনপ্রিয় কবি ছিলেন। তার কাব্যের সহজ শিল্পরস তাকে মধ্যযুগের অন্যতম প্রভাবশালী কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নারায়ণদেবের বিশিষ্ঠতা এইখানে যে তিনি কালিকাপুরাণ, শিবপুরাণ, কালিদাসের 'কুমারসম্ভব' প্রভৃতি সংস্কৃত গ্রন্থের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও আপন প্রচেষ্টায় তার কাহিনিকে বিশাল রূপদান করেছিলেন ; এদিক থেকে তিনি মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যান্য কবি যেমন বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই কিংবা কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের থেকে অনেকখানি এগিয়ে। নারায়ণদেব নামাঙ্কিত একাধিক পুঁথি পাওয়া গেছে । ১৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দে লিখিত একখানি প্রাচীন পুঁথির আলোকচিত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথি বিভাগে রক্ষিত আছে। নারায়ণদেবের অনেক পুঁথিতে অন্য কবি বা গায়েনের ভণিতা আছে, কিন্তু মুল কাহিনির সাথে তার খুব ভিন্নতা নেই। তাই তার পুঁথিকে অনেকেই নির্ভরযোগ্য বলে গ্রহণ করে থাকেন।[3] সমালোচক আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, --" নারায়ণ দেবের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে , তাঁহার কাব্যের পরিসমাপ্তির পরিকল্পনা চাঁদ সদাগরের চরিত্রের আনুপূর্বিক সামঞ্জস্য রক্ষায় সার্থক হইয়াছে। তিনিই চাঁদ সদাগরকে দিয়া বাম হস্তে মুখ না ফিরাইয়া একটি ফুল দিয়া পূজা করিয়াছেন, কিন্তু অন্যান্য কোনো কোনো কবি , এমনকি , বিজয়গুপ্তও তাঁহাকে দিয়া ঘটা করিয়া মনসার পূজা করাইয়া কাব্যের উপসংহার করিয়াছেন। এই দিক দিয়া নারায়ণ দেবের রচনায় কাব্যগুণ অধিক প্রকাশ পাইয়াছে বলিতে হইবে।"[4] তাছাড়া নারায়ণ দেব যে প্রতিভাশালী কবি ছিলেন তার বড় প্রমাণ সপ্তদশ শতকের কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ তার কাব্যের প্রারম্ভে নারায়ণ দেবের বন্দনা করেছেন এইভাবে--

ব্যাস বাল্মীকি মুনি নারায়ণ তত্ব জানি
তোমাকে সেবিয়া হৈল কবি ।।

তথ্যসূত্র

  1. ডঃ তমোনাশ দাশগুপ্ত সম্পাদিত, নারায়ণদেবের পদ্মাপুরাণ, কলিকাতা ১৯৪১;
  2. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত; দ্বিতীয় খণ্ড, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা- ১৯৯৬, পৃষ্ঠা-১১৬
  3. শ্রীমতী সাধনা সেনগুপ্ত সম্পাদিত, নারায়ণদেবের পুঁথি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
  4. ভট্টাচার্য, আশুতোষ। বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.