ডাক সংক্রান্তি

ডাক সংক্রান্তি হল হিন্দু বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী আশ্বিন মাসের শেষ দিনে সমগ্র রাঢ়-বাংলার গ্রামীন হিন্দু কৃষক সমাজের পালনীয় একটি লৌকিক উৎসব। এই সময় ধান্যক্ষেত্রে ফুল ধরা সবুজ ধানগাছকে গর্ভিণীজ্ঞানে পূজা করা হয় এবং সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা করা হয়। তাছাড়া, বিভিন্ন অনুষ্ঠান-আয়োজনের মাধ্যমে কিংবদন্তির 'ডাক পুরুষ'-এর আশীর্বাদ লাভ করার কামনা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর এমনকি উড়িষ্যাতেও 'ডাক সংক্রান্তি' পালিত হয়। তবে স্থানভেদে উৎসবের দিনটির হেরফের ঘটে।[1]

ডাক পুরুষ

বঙ্গীয় কৃষক সমাজের কিংবদন্তি অনুযায়ী, দূর অতীতে বাংলায় এক বলবীর্যবান ও মন্ত্রৌষধি জ্ঞানী মহাপুরুষ জন্মেছিলেন। তিনি প্রতিবছর আশ্বিন মাসের সংক্রান্তির আগের রাতে নির্দিষ্ট শুভলগ্নে লাঠি ও জ্বলন্ত মশাল হাতে বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গিতে ভয়ঙ্কর শব্দ করতে করতে বিধাতাপুরুষের কাছে যেতেন এবং তার কাছে পার্থিব মানুষদের শারীরিক ও সাংসারিক দুঃখের বিষয়গুলি ব্যক্ত করে সেসব দুঃখ থেকে পরিত্রাণের উপদেশ ও আশীর্বাদ মর্ত্যধামে নিয়ে আসতেন। পৃথিবীর মানুষের সংবাদ নিয়ে স্বর্গধামে গমন করতেন বলেই তার নাম 'ডাক পুরুষ'। আবার অন্যমতে, আশ্বিন-সংক্রান্তির পূর্বরাত্রে নির্দিষ্ট সময়ে পল্লীবাসীকে ডেকে উন্মুক্ত প্রান্তরে নিয়ে গিয়ে শারীরিক কসরত বা ব্যায়াম এবং মন্ত্রৌষধির শিক্ষা দিতেন। অনেক পণ্ডিতের মতে, এই ডাকপুরুষ পূর্ববঙ্গের মানুষ ছিলেন।[1]

উৎসব পালনের রীতি

ডাকপুরুষের কিংবদন্তির স্মৃতিকে জিইয়ে রাখতে এখনও রাঢ়-বঙ্গের কোন কোন অঞ্চলের যুবকরা বছরের ঐদিন মাঠে গিয়ে সারারাত কুস্তি, লাঠিখেলা, মশাল জ্বালানো প্রভৃতি ক্রীড়া-কৌতুক করে থাকেন এবং রাতশেষে নদী বা পুকুরে স্নান করে পাত্রভরে 'ডাক জল' নিয়ে বাড়িতে আসেন। কৃষক পরিবারের প্রত্যেকে নিমপাতা ও তালশাঁস খেয়ে ঐ জল পান করেন। তাদের বিশ্বাস, এটিই হল ডাকপুরুষের আদেশ বা বাণী এবং এতে সারাবছর তাদের শরীরস্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

ডাক-সংক্রান্তির দিন অনেক জায়গায় ধান্যক্ষেত্রে লৌকিক দেবী 'গাড়সে ষষ্ঠী'র পূজা করা হয় এবং ভোরবেলা 'ধানে ডাক' দেওয়া হয়। ঐদিন সমস্ত কৃষিকাজ বন্ধ থাকে। উৎসবের তিন-চার দিন আগে থেকে বাছাই করা শুকনো পাটকাঠি আঁটি বেঁধে রাখা হয়। উৎসবের পূর্বরাত্রে মশাল জ্বেলে গ্রামের কৃষকরা ঘুরে বেড়ায় এবং 'ওহো ওহো' শব্দ করে আনন্দ প্রকাশ করে। সকালে প্রজ্জ্বলিত মশালের শেষাংশ একত্র করে বৃহৎ অগ্নিকুণ্ড সৃষ্টি করে গা-হাত-পা-মুখ গরম করে। ভোরবেলা অল্পবয়সী ছেলেরা বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে কুলো পিটিয়ে নিম্নোক্ত ছড়া আবৃত্তি করে গোটা গ্রামকে জাগিয়ে তোলে —

"আশ্বিন যায় কার্তিক আসে
মা লক্ষ্মী গর্ভে বসে
আমন ধানের সার বসে।
এপারের পোকামাকড় ওপারেতে যায়
ওপারের শিয়াল কুকুরে ধরে ধরে খায়।
হোঃ হো হো—।"

উৎসবের দিন কৃষকবধূরা ঘরে ঘরে নতুন আউশ ধানের তণ্ডুলের গুড়োর সাথে নারকেল ও গুড় দিয়ে পিঠে তৈরি করে আত্মীয়বর্গের সঙ্গে আনন্দোৎসব পালন করেন।[1]

উৎসব পালনের রকমফের

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম অঞ্চলে কার্তিক মাসের শেষদিনে 'ডাক সংক্রান্তি' উদযাপিত হয়। এদিন স্থানীয় অধিবাসীরা ধানগাছের কাছে গিয়ে বলেন— 'ধান ফুলো, ধান ফুলো—'। বাঁকুড়াতে কার্তিক সংক্রান্তিকে 'মাথান ষষ্ঠী'ও বলা হয়। মেদিনীপুর অঞ্চলে ঐদিন ধানক্ষেতে শরকাঠি পোঁতার সময় কৃষকরা ছড়া বলেন—

"অন্ সরষে শশার নাড়ি
যারে পোকা ধানকে ছাড়ি
এখানে আছে খুদমালিকা
এখানে আছে ওল
মহাদেবের ধ্যান করে বলরে হরিবোল।"

[1]

তথ্যসূত্র

  1. বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, দুলাল চৌধুরী, আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা: ৭০০০৯৪, প্রথম প্রকাশ:২০০৪, পৃষ্ঠা: ২৫৫-২৫৬

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.