গোবর গোহ
যতীন্দ্রচরণ গুহ (১৩ মার্চ ১৮৯২ - ২ জানুয়ারি ১৯৭২) ওরফে গোবর গোহ ছিলেন এক বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় কুস্তিগীর ও পালোয়ান। ১৯২১ সালে তিনি প্রথম এশীয় ব্যক্তি যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত বিশ্ব লাইট হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন।[2][3][4]
গোবর গোহ | |
---|---|
গোবর গোহ | |
জন্ম | কলকাতা, বাংলা, ব্রিটিশ ভারত | ১৩ মার্চ ১৮৯২
মৃত্যু | ২ জানুয়ারি ১৯৭২ ৭৯) | (বয়স
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পেশা | কুস্তিগীর |
পিতা-মাতা | পিতামহের পিতামহ শিবচরণ গুহ পিতামহ অম্বিকাচরণ গুহ পিতা রামচরণ গুহ[1] |
প্রারম্ভিক জীবন
গোবর গুহ ছিলেন এক কুস্তিগীর বংশের সন্তান। কলকাতার গুহ পরিবার শরীরচর্চা ও শরীরচর্চার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য পরিচিত ছিল। গোবরের পিতামহের পিতামহ শিবচরণ গুহ আধুনিক বঙ্গের প্রথম আখড়াটি স্থাপন করেন কলকাতার হোগোলকুঁড়িয়ায়, বর্তমান শোভাবাজার মসজিদবাড়ি স্ট্রীটে। পিতামহ অম্বিকাচরণ গুহ বা অম্বুবাবু ছিলেন নামকরা কুস্তিগীর। বঙ্গে আখড়া সংস্কৃতির প্রচলনের পথিকৃৎ মনে করা হয় তাকে। পিতা রামচরণ গুহও ছিলেন কুস্তিগীর। তার কাকা ক্ষেত্রমোহন গুহ অথবা খেতুবাবু ছিলেন নামকরা কুস্তিগীর।
গোবর গুহ জন্মেছিলেন ১৮৯২ সালে, কলকাতায়। ছোটবেলায় তার নাদুসনুদুস চেহারা দেখে পিতামহ অম্বুবাবু তাকে রসিকতা করে 'গোবরের ড্যালা' বলেছিলেন। সেই থেকে তার ডাকনাম হয় গোবর। পিতামহের রসিকতায় গোবরের জেদ চেপে যায়। তিনি পিতামহের কাছেই প্রথমিক অনুশীলন শুরু করেন। তার পিতা ও খুল্লতাত চেতুবাবুর কাছেও তিনি কুস্তির শিক্ষা নেন। তারপর কঠোর অনুশীলন শুরু করেন গুহ পরিবাবের আখড়াতেই কর্মরত নামকরা কুস্তিগীর খোলসা চৌবে ও রহমানি পালোয়ানের নিকট। বয়ঃপ্রাপ্ত হলে গোবরের উচ্চতা দাঁড়ায় ছয় ফুট এক ইঞ্চি ও ওজন ২৯০ পাউন্ড। তার স্ফীত ছাতি হয় ৪৮ ইঞ্চি। ১৯১০ সালে গোবর বিদ্যাসাগর স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন।
কর্মজীবন
১৯১০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে গোবর পেশাদার কুস্তিগীর হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। তার প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী ত্রিপুরার মহারাজার সভা পালোয়ান নবরঙ সিংহ, যদিও এর জন্য তিনি কোন অর্থ পাননি। সেই বছরই লন্ডনের জন বুল সোসাইটি কুস্তির এক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন করে। সেখানে বিশ্বের সমস্ত নামকরা কুস্তিগীরদের আমণ্ত্রন করা হয়। বৃটিশ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন গামা পালোয়ান ও গোবর গুহ। সেবারের ইউরোপ যাত্রাকালে গোবর ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও ইতালিতে বিভিন্ন কুস্তিগীরদের সাথে লড়েন। গোবর দ্বিতীয়বার ইউরোপ যাত্রা করেন ১৯১২ সালে। এই যাত্রায় গোবর প্যারিসে একটি কুস্তি প্রতিযোগিতায় বিশ্বের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হেভিওয়েট বিশ্বচ্যাম্পিয়নের বিরুদ্ধে লড়েন। এর পরে তিনি স্কটল্যান্ডের সেরা কুস্তিগীর ক্যাম্পবেলকে পরাস্ত করেন। তার পর তিনি লড়েন স্কটল্যান্ডের আর এক বিখ্যাত কুস্তিগীর জিমি এসনের বিরুদ্ধে। কুস্তির পালাতে এসন সর্বক্ষণ বেআইনীভাবে মুষ্টি চালনা করা সত্ত্বেও গোবর এসনকে ভুপতিত করতে সমর্থ হন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১৯১৫ সালে দেশে ফিরে আসেন।
যুদ্ধের পর ১৯২০ সালে গোবর ইউরোপ ও আমেরিকা যাত্রা করেন। আমেরিকায় তিনি বিশ্ব পেশাদার কুস্তি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন। সান ফ্রান্সিস্কোর কলিসিয়ামে অনুষ্ঠিত উক্ত প্রতিযোগিতায় তদানীন্তন লাইট হেভিওয়েট বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অ্যাড সান্তেলকে পরাস্ত করেন এবং প্রথম এশীয় হিসেবে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব পান। এর পর তিনি এড লুইসের বিরুদ্ধে লড়েন, যাকে সর্বকালের সেরা পেশাদার কুস্তিগীর মানা হয়। লুইস গোবরের উপর বারংবার হেডলক পদ্ধতি ব্যবহার করে অকৃতকার্য হন। কয়েক রাউন্ড পর লুইস একবার গোবরকে ভূপতিত করেন এবং গোবরও একবার লুইসকে ভূপতিত করেন। এর পর লুইস বেআইনীভাবে মুষ্টি চালনা করলেও বিচারকরা তা উপেক্ষা করেন। গোবর বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে লুইস অতর্কিতে তাকে আক্রমণ করে ভূপতিত করলে গোবর অচৈতন্য হয়ে পড়েন। এর পর গোবর ইউরোপ ও আমেরিকার নানা স্থানে কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯২৬ সালে তিনি সফর শেষ করে দেশে ফেরেন।
১৯২৯ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে গোবর এবং ছোট গামার মধ্যে এক স্মরণীয় লড়াই হয়। লড়াইয়ে দুই কুস্তিগীরই ভারতীয় কুস্তির সমস্ত কৌশলের প্রদর্শন করেন। লড়াই অমীমাংসিতভাবে শেষ হলেও টেকনিকাল কারণে ছোট গামাকে জয়ী ঘোষণা করা হয়।
কুস্তির পাশাপাশি গোবর তাদের পারিবারিক আখড়ার পরিচালনাও করতেন। ১৯৩৬ সালে তিনি মসজিদবাড়ি স্ট্রীটের আখাড়াকে উঠিয়ে নিয়ে এসে হেদুয়ার কাছে গোয়াবাগান স্ট্রীটে স্থাপন করেন। ১৯৪৪ সালে গোবর পেশাদার কুস্তি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
প্রভাব
গোবর ভারতীয় কুস্তিকে বিশ্বের দরবারে এক উচ্চ স্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ভারতীয় কুস্তির রীতিতে বহু নতুন প্যাঁচের উদ্ভাবন করেন। তার উদ্ভাবিত ধোঁকা, টিব্বি, গাধানেট, ঢাক, টাং, পাট, ধোবা পাট, কুল্লা ইত্যাদি ভারতীয় কুস্তি রীতিতে সংযোজিত হয়। তার সর্বাধিক প্রচলিত পদ্ধতি হল রদ্দা।
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই কলকাতায় আখড়া সংস্কৃতি ও কুস্তির প্রচলন হয়। কিন্তু তা মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু সমাজের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিস্তারলাভ করেনি। তখনও পর্যন্ত কুস্তিকে পঞ্জাবী মুসলমানদের একচেটিয়া বলে মনে করা হত। বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকে প্রধানত: গোবর গুহর সফল্যেই মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু সমাজের মধ্যে কুস্তির প্রচলন হয়। গোবর গুহর আখড়ায় কুস্তি করতে আসতেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মান্না দে প্রমুখ। ব্যায়ামবীরদের মধ্যে নীলমণি দাস, বিষ্ণুচরণ ঘোষ, মনোহর আইচ, মনতোষ রায় প্রত্যকেই আসতেন তার আখড়ায়। ১৯৫২ অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী কুস্তিগীর খাশাবা দাদাসাহেব যাদব গোবর গুহর আখড়াতেই কুস্তির পাঠ নিয়েছিলেন। গোবর গুহর ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন বনমালী ঘোষ, জ্যোতিষচরণ ঘোষ ও বিশ্বনাথ দত্ত।
মৃত্যু
১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি, সেই রাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন নেই, পরম শান্তিতে চিরঘুমিয়ে ছিলেন তিনি । [5]
স্মৃতি
১৯৯২ সালে গোবর গুহর অনুগামীরা তার আখড়ায় তার জন্মশতবার্ষিকী পালন করেন। ১৯৯৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন রাজ্যপাল রঘুনাথ রেড্ডি কলকাতার আজাদ হিন্দ বাগে গোবর গুহর আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করেন। পরবর্তীকালে গোয়াবাগান স্ট্রীটের নাম পাল্টে গোবর গুহ সরণি রাখা হয়।
সূত্র
- "Ancestral"।
- সেনগুপ্ত, সুবোধচন্দ্র; বসু, অঞ্জলি, সম্পাদকগণ (জানুয়ারী ২০০২)। "গোবর গোহ"। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। প্রথম খন্ড (চতুর্থ সংস্করণ)। কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ৫৬৫। আইএসবিএন 81-85626-65-0।
- মন্ডল, অনন্ত (১৮ আগস্ট ২০১২)। "অথ কুস্তি-কথা"। গণশক্তি। কলকাতা। সংগ্রহের তারিখ ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
- বসু, তাপস। "কলকাতায় জাতীয় প্রতিযোগিতা: বাংলা কুস্তির হাল ফিরবে?"। banglabazar.co.in। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
- "Last Sleep"।