আল-আজহার মসজিদ

আল-আজহার মসজিদ (আরবি: الجامع الأزهر al-Gāmi` al-Azhar) মিশরের কায়রোতে অবস্থিত একটি মসজিদ। ফাতেমীয় খলিফা আল-মুইজ লিদিনাল্লাহ নতুন রাজধানীর জন্য ৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এটি নির্মাণ শুরু করেন। এর নাম মুহাম্মদ (সা) এর মেয়ে ফাতিমার সাথে সম্পর্কিত মনে করা হয়। তার উপাধি ছিল আজ-জাহরা। এটি কায়রোর প্রথম মসজিদ। এরপর থেকে এই শহরকে "হাজার মিনারের শহর" বলা হয়।[nb 1]

আল-আজহার মসজিদ
الجامع الأزهر

আল-আজহার মসজিদের বাইরের দৃশ্য। বাম থেকে ডানে: আল-গাওরি, কাইতবাই, আকবাগাউয়িয়া ও কাতখুদা মিনার

আল-আজহার মসজিদ
মিশরে অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ৩০.০৪৫৭° উত্তর ৩১.২৬২৭° পূর্ব / 30.0457; 31.2627
অবস্থান কায়রো, মিশর
প্রতিষ্ঠিত ৯৭২
শাখা/ঐতিহ্য ইসলাম1
পরিচালনা
স্থাপত্য তথ্য
ধরণ হাইপোস্টাইল মসজিদ, ফাতেমীয়
ধারণক্ষমতা ২০,০০০
আয়তন ৭,৮০০ মি (৮৪,০০০ ফু)
মিনার
পাদটীকা 1৯৭২ থেকে ১১৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আল-আজহার ইসমাইলি ধারার প্রতিষ্ঠান ছিল

৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদের নির্মাণ সম্পন্ন হয়। ৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে এখানে ৩৫ জন আলেমকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এরপর মসজিদ ধীরে ধীরে বর্তমান আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠে। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে নীরবিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষাদানে রত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এর অবস্থান দ্বিতীয়। মরক্কোর ফেজে অবস্থিত কারাউয়িইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম অবস্থানে রয়েছে। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম বিশ্বে দীর্ঘদিন ধরে সর্বোচ্চ শরিয়া শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মাদ্রাসার অংশ হিসেবে মসজিদের সাথে যুক্ত। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে এটি জাতীয়করণ করা হয় এবং স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

একহাজার বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসে মসজিদ কখনো উপেক্ষিত হয়েছে আবার কখনো গুরুত্ব পেয়েছে। ইসমাইলি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে সালাহউদ্দিন ও আইয়ুবী শাসকরা আল-আজহারকে গুরুত্ব প্রদান করেননি। তবে মামলুক যুগে মসজিদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। এসময় মসজিদের কয়েক দফা সম্প্রসারণ ও সংস্কার করা হয়। মিশরের পরবর্তী শাসকরা মসজিদের প্রতি বিভিন্ন মাত্রার আচরণ প্রদর্শন করেছেন। মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে আল-আজহার মিশরের সমাজে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান। মিশর ছাড়াও বাকি মুসলিম বিশ্বে আল-আজহার গুরুত্বপূর্ণ কর্তৃপক্ষ।

নাম

আরবি ক্যালিগ্রাফিক শৈলীতে লিখিত ফাতিমা আজ-জাহরা (فاطمة الزهراء)

কায়রো শহর জওহর আল-সিকিলি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ছিলেন সিসিলি থেকে আগত গ্রিক বংশোদ্ভূত ফাতেমীয় সেনাপতি। তিনি ফাতেমীয় খিলাফতের পূর্ববর্তী রাজধানীর নামানুসারে এর নাম দিয়েছিলেন আল-মানসুরিয়া। ৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম এই মসজিদ ব্যবহৃত হয়। একে তখনকার সাধারণ রীতি হিসেবে তখন জামি আল-মানসুরিয়া (جامع المنصورية, "মানসুরিয়ার মসজিদ") বলা হত। খলিফা আল-মুইজ লিদিনাল্লাহ শহরের নাম বদলে আল-কাহিরা (القاهرة) রাখেন যার অর্থ বিজয়ী। এরপর মসজিদের নাম জামি আল-কাহিরা (جامع القاهرة, "কায়রোর মসজিদ") হয়।[1]

মসজিদের বর্তমান নামটি খলিফা আল-মুইজ থেকে মিশরের দ্বিতীয় ফাতেমীয় খলিফা আল-আজিজ বিল্লাহর সময় প্রদান করা হয়েছে।[1] আজহার শব্দটি জাহরা শব্দের পুংলিঙ্গ। জাহরা ছিল মুহাম্মদ (সা) এর কন্যা ও চতুর্থ খলিফা আলি ইবনে আবি তালিবের স্ত্রী ফাতিমার সম্মানসূচক উপাধি।[2] ফাতেমীয় খলিফারা নিজেদেরকে ফাতিমার বংশধর দাবি করতেন। একটি তত্ত্ব অণুযায়ী আল-আজহার নামটি তার সম্মানসূচক নাম থেকে এসেছে।[3][4] তবে এই তত্ত্বটি কোনো আরব সূত্র কর্তৃক সমর্থিত নয় এবং পরবর্তী পাশ্চাত্য সূত্রগুলো এ ব্যাপারে সত্য-মিথ্যা উভয়ে মত প্রকাশ করেছে।[5]

আরেকটি তত্ত্ব অণুযায়ী ফাতেমীয় খলিফাদের প্রাসাদের নামানুসারে মসজিদের নামকরণ হয়েছে। মসজিদের নিকটে অবস্থিত অবস্থিত প্রাসাদসমূহকে সম্মিলিতভাবে আল-কুসুর আল-জাহিরা (االقصور الزاهرة) বলা হত। রাজকীয় বাগানের নামও জাহরা থেকে উদ্ভূত আরেকটি নামে নামকরণ করা হয়েছে। মসজিদের নাম জামি আল-কাহিরা থেকে আল-আজহার হওয়ার পূর্বে প্রাসাদসমূহের নির্মাণ ও নামকরণ সম্পন্ন হয়।[1][6]

জামি শব্দটি আরবি ধাতু জামাআ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ সমবেত হওয়া। জামাতের সাথে নামাজ পড়া হয় এমন মসজিদের ক্ষেত্রে এই শব্দ ব্যবহার হয়। ধ্রুপদি আরবিতে জামি আল-আজহার বলা হলেও মিশরীয় আরবিতে একে গামা হিসেবে পরিবর্তিত হয়েছে।[nb 2]

ইতিহাস

ফাতেমীয় খিলাফত

ফাতেমীয় যুগে নির্মিত মার্বেল আচ্ছাদিত উঠোন। দুইটি মামলুক যুগের মিনার দেখা যাচ্ছে। বাম থেকে ডানে, আল-গাওরি মিনার ও কাইতবাই মিনার। গম্বুজের পেছনে আকবাগাউয়িয়া মিনারের শীর্ষভাগ দেখা যাচ্ছে। পেছনের মিনার কাতখুদা নির্মাণ করেছিলেন।

ফাতেমীয় খলিফা আল-মুইজ লিদিনাল্লাহ তার সেনাপতি জওহর আল-সিকিলির মাধ্যমে সুন্নি ইখশিদিদের পরাজিত করে মিশর জয় করেছিলেন।[7][8] খলিফার নির্দেশে জওহর খলিফা ও সেনাবাহিনীর জন্য রাজকীয় পরিবেষ্টিত স্থান নির্মাণের তত্ত্বাবধান করেন এবং আল-আজহারকে শিয়া ইসমাইলি মতবাদ প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়।[7] সুন্নি অধ্যুষিত ফুসতাত শহরের নিকটে গড়ে উঠা কায়রো ইসমাইলি শিয়া মতবাদের কেন্দ্র হয়ে উঠে।[9]

জওহর নতুন শহরের জন্য মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেন। ৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৪ এপ্রিল এর নির্মাণ শুরু হয়।[5] ৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে এর নির্মাণ সমাপ্ত হয়। সে বছরের ২২ জুন রমজান মাসে এখানে প্রথম জুমার নামাজ আদায় করা হয়।[5]

আল-আজহার শীঘ্রই মুসলিম বিশ্বের একটি প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে উঠে। সরকারি ঘোষণা ও অধিবেশন এখানে জারি ও অণুষ্ঠিত হত।[7] ফাতেমীয় শাসনের সময় ইসমাইলি মতবাদকে জনসাধারণের শিক্ষার জন্য ব্যবস্থা করা হয়।[10] কাজি আল-নুমানকে কাজি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এবং তাকে ইসমাইলি মতবাদ শিক্ষাদানের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।[10] খলিফার প্রাসাদ ও আল-আজহার উভয় স্থানে পাঠদান করা হত এবং নারীদের জন্য পৃথক পাঠদানের ব্যবস্থা থাকত।[11][12] ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ঈদুল ফিতরের সময় খলিফা কর্তৃক আল-আজহারকে কায়রোর সরকারি জুমা মসজিদ ঘোষণা করা হয়। আল-মুইজ ও তার পুত্র খলিফা হওয়ার পর রমজানের সময় আল-আজহারে অন্তত একবার জুমার খুতবা প্রদান করতেন।[13]

পলিমেথ ও আইনবিদ ইয়াকুব ইবনে কিলিস ছিলেন ফাতেমীয়দের প্রথম দাপ্তরিক উজির। তিনি ৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে আল-আজহারকে ইসলামি আইনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন।[14] পরের বছর শিক্ষাদানের জন্য ৪৫ জন আলেমকে নিয়োগ দানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপিত হয়।[15]

খলিফা আল-আজিজ বিল্লাহর (শাসনকাল ৯৭৫-৯৯৬) শাসনামলে মসজিদ সম্প্রসারিত হয়। আল-মুফাদ্দালের মতে খলিফা মসজিদের কিছু অংশ সংস্কার এবং ছাদের উচ্চতা এক কিউবিট বৃদ্ধি করেছিলেন। পরবর্তী ফাতেমীয় খলিফা আল-হাকিম বি-আমরাল্লাহ মসজিদ সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখেন। তিনি ১০১০ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে একটি নতুন কাঠের দরজা স্থাপন করেছিলেন। আল-হাকিমের সময় আল-হাকিম মসজিদ নির্মিত হওয়ার ফলে আল-আজহার কায়রোর মূল মসজিদ হিসেবে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। ১০০৯ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে আল-হাকিম মসজিদ খলিফার খুতবার মূল স্থান হয়ে উঠে। এর পূর্বে খলিফা খুতবার স্থান পরিবর্তন করতেন। পরবর্তীতে আল-মুসতানসির বিল্লাহ পুনরায় আল-আজহারকে পূর্বের মত ব্যবহার শুরু করেন। পরবর্তী ফাতেমীয় খলিফাদের যুগে মসজিদের সম্প্রসারণ ও সংস্কার করা হয়েছে।[16]

শুরুতে এখানে কোনো গ্রন্থাগার ছিল না। ১০০৫ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা কয়েকশত পাণ্ডুলিপি সংবলিত একটি গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন।[17] জনগণের মধ্যে ইসমাইলি মতবাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য ফাতেমীয় প্রচেষ্টা ব্যাপকভাবে সফল হয়নি।[9] ফাতেমীয় খিলাফতের পতনের পর গোলযোগে পাণ্ডুলিপির অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।[17] এরপর আল-আজহার একটি সুন্নি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত হয়।[9]

আইয়ুবীয় রাজবংশ

সালাহউদ্দিন ১১৭১ খ্রিষ্টাব্দে ফাতেমীয় খিলাফত উচ্ছেদ করেন। তিনি শিয়া মতবাদের প্রতি বিরূপ ছিলেন। এসময় থেকে মসজিদ গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। সালাহউদ্দিন কর্তৃক নিযুক্ত কাজি সদরউদ্দিন ইবনে দিরবাস এখানে জামাতে নামাজের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন।[18] সম্ভবত শুধু একটি মসজিদে পুরো সম্প্রদায়ের জামাত হতে হবে এমন একটি মত অথবা শিয়া প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিরূপ মনোভাবের কারণে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল।[17][19] এই সময় নাগাদ আরো বড় আল-হাকিম মসজিদ নির্মিত হয়েছিল এবং কায়রোর জামাত এখানে অণুষ্ঠিত হত।[18]

সালাহউদ্দিন মসজিদের মিহরাবে যুক্ত ফাতেমীয় খলিফাদের নামাঙ্কিত একটি রৌপ্য পাত খুলে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল-আজহার ও অন্যান্য মসজিদ থেকে খুলে ফেলা অণুরূপ পাতের মূল্য দাঁড়ায় ৫,০০০ দিরহাম।[16] তবে সালাহউদ্দিন সম্পূর্ণভাবে মসজিদটিকে উপেক্ষা করেননি, আল-মুফাদ্দালের মতে মসজিদের একটি মিনার সালাহউদ্দিনের শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল।[16]

মসজিদের শিক্ষাকেন্দ্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।[18] এখানকার একসময়ের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার এসময় উপেক্ষিত হয় এবং ফাতেমীয় শিক্ষার পাণ্ডুলিপিগুলো নষ্ট হয়ে যায়।[17][20] আইয়ুবীয় শাসকরা সুন্নি ধর্মতত্ত্বের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং তারা কায়রোজুড়ে সুন্নি মাদ্রাসা স্থাপন করেছেন।[18] ছাত্রদের বৃত্তি ও মসজিদে পাঠদান বন্ধ হয়ে যায়। [18] ফাতেমীয় যুগে দায়িত্বপালনকারী শিক্ষকরা অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হন।[20]

তবে এরপরও আল-আজহার এসময় একটি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে টিকে ছিল।[18] দাপ্তরিক পাঠদান বন্ধ থাকলেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে মসজিদে পাঠদান করা হত। একটি মতানুযায়ী একজন পন্ডিত (সম্ভবত আবদুল লতিফ আল-বাগদাদি) মসজিদে আইন ও চিকিৎসাসহ বেশ কিছু বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করতেন। সালাহউদ্দিনের সম্পর্কে মত রয়েছে যে তিনি আল-বাগদাদিকে ৩০ দিনার বেতন হিসেবে প্রদান করতেন এবং তার উত্তরাধিকারীরা তা বৃদ্ধি করে ১০০ দিনার করেছিলেন।[20] সালাহউদ্দিন ও তার উত্তরসুরিদের সময় মসজিদের গুরুত্ব আগের মত না থাকলেও আল-আজহারের উপর আইয়ুবীয় নীতির প্রভাব পড়েছে। তারা শিয়া মতবাদের মোকাবেলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুন্নি ধর্মতত্ত্ব শিক্ষাদান করত। তাদের পাঠক্রমে ধর্মতত্ত্ব ছাড়াও অলংকারশাস্ত্র, গণিত ও বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত ছিল।[21] সালাহউদ্দিনের বিজয়ের আগ পর্যন্ত মিশরে অণুরূপ কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। তিনি ও তার পরবর্তী আইয়ুবীয় শাসকরা মিশরে ২৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। এর মধ্যে সালিহিয়া মাদ্রাসা অন্যতম।[22]

আল-আজহারে এরপর সালাহউদ্দিনের শিক্ষা সংস্কারের ধারা গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে মামলুকদের শাসনামলে আল-আজহারের উন্নয়ন হয়েছিল। মামলুকরা মাদ্রাসার ছাত্রদের বৃত্তি ও শিক্ষকদের বেতন পুনর্বহাল করে।[17]

মামলুক সালতানাত

একজন মামলুক বে

মামলুক সুলতান বাইবার্সের শাসনামলে ১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দে আল-আজহারে পুনরায় জামাতে নামাজ শুরু হয়। মামলুকরা একই মসজিদে পুরো সম্প্রদায়ের জামাত বিষয়ক মত অণুসরণ করতেন না।[19] আল-আজহারের সাথে এসময়ে ফাতেমীয় ও ইসমাইলি সম্পর্ক ছিল না। এছাড়াও কায়রো দ্রুত সম্প্রসারণের কারনে বাইবার্স মসজিদের সাবেক ইতিহাস উপেক্ষা করতে সক্ষম হন এবং আগের মত গুরুত্ব প্রদান করেন। বাইবার্স ও মামলুক সুলতানগণ আল-আজহারের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান ও মসজিদের সংস্কার করেছিলেন।[23] আল-মুফাদ্দালের মতানুযায়ী আমির ইজ্জউদ্দিন আইদামুর আল-হিল্লি সংস্কারের সময় মসজিদের পাশে বাড়ি তৈরি করেছিলেন। আল-মাকরিজি লিখেছেন যে আমির দেয়াল ও ছাদ সংস্কার করেছেন এবং মেঝেতে নতুন গালিচা স্থাপন করেছেন। ফাতেমীয় খলিফা আল-হাকিমের পর ১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি প্রথম খুতবা প্রদান করা হয়।[24]

১৩০২ খ্রিষ্টাব্দে একটি ভুমিকম্পের ফলে আল-আজহারসহ মামলুক অঞ্চলের বেশ কিছু মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মসজিদগুলো সংস্কারের জন্য আমিরদেরকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বাইবার্সের শাসনের পর এই প্রথমবার সংস্কারকার্য সম্পাদিত হয়েছিল।[25] এর সাত বছর পর মসজিদের উত্তরপশ্চিম দেয়ালের পাশে মাদ্রাসা আল-আকবাগাউয়িয়া নির্মিত হয়। মসজিদের কিছু দেয়াল নতুন করে নির্মিত হয়। ১৩৩২-১৩৩৩ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রাসা আল-তাইবারসিয়া নির্মাণ শুরু হয় এবং এর নির্মাণকাজ ১৩৩৯-১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে সমাপ্ত হয়। এটি মসজিদের ওজুর স্থানে নির্মিত হয়েছিল।[24] মাদ্রাসাগুলো মসজিদের সম্পূরক ভবন হিসেবে নির্মিত হয়েছিল, এতে পৃথক প্রবেশ পথ ও নামাজের স্থান ছিল।[25]

আল-আজহার মসজিদ কায়রোতে নিজের অবস্থান ফিরে পেলেও সংস্কার ও অন্যান্য কার্যগুলো সুলতানের অধীনস্তরা সম্পাদন করতেন। বুরজি রাজবংশের সুলতান বারকুকের সময় এই অবস্থা পরিবর্তন হয়। মামলুক শাসনের সমাপ্তি পর্যন্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা মসজিদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সুলতান কাইতবাইকানসুহ আল-গাওরি উভয়ের শাসনামলে মসজিদের সংস্কার ও মিনার নির্মিত হয়।[26] ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে এবং কায়রোর দৃশ্যপটে অবস্থান উচু করার জন্য মিনার নির্মাণ মামলুক সুলতানদের প্রথা ছিল। সুলতানগণ আল-আজহার মসজিদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন।[26]

মুসলিম বিশ্বের প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য হওয়া এবং রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও আল-আজহার কায়রোর অন্যান্য মাদ্রাসার মত ছিল না। আল-আজহারে নিজস্ব পন্থায় পাঠদান করা হত। অন্যদিকে সালাহউদ্দিনের সময় নির্মিত মাদ্রাসাগুলো ছিল রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থার অংশ। মিশর ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে শিক্ষার্থীরা আল-আজহারে পড়াশোনার জন্য আসত। শিক্ষার্থীদের সংখ্যার দিক থেকে আল-আজহার অন্যান্য মাদ্রাসাগুলোকে ছাড়িয়ে যায়।[27] আল-আজহারের শিক্ষার্থীদের জাতীয়তার ভিত্তিতে রিওয়াকে দলবদ্ধ করা হত এবং ইসলামি আইনের বিষয়াদি শিক্ষা দেয়া হত। ডিগ্রি লাভের জন্য গড়পরতা ছয় বছর অধ্যয়ন করতে হত।[17]

১৪শ শতাব্দী নাগাদ আল-আজহার আইন, ধর্মতত্ত্ব, আরবি ভাষা শিক্ষার শ্রেষ্ঠ স্থান হিসেবে স্বীকৃত হয়। মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসত।[17] মিশরের উলামাদের একতৃতীয়াংশ এখানে শিক্ষকতা বা লেখাপড়া করেছেন বলে মত পাওয়া যায়।[27] মুহাম্মদ ইবনে ইয়াসের মতে মামলুক সালতানাতের শেষের দিকে আল-আজহার নয় বরং সালিহিয়া মাদ্রাসাকে "উলামাদের দুর্গ" হিসেবে দেখা হত।[28]

উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রদেশ

বাব আল-মুজাইয়িনিন, উসমানীয় শাসনামলে আবদুর রহমান কাতখুদা এটি নির্মাণ করেছিলেন। বাম পাশের মিনারটি কাতখুদা কর্তৃক পুনর্নির্মিত হয়েছিল।

উসমানীয়রা ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে মিশর অধিকার করে। এরপর সরাসরি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়ে গেলেও তুর্কিরা মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি সশ্রদ্ধাভাব দেখিয়েছে। [17][27] উসমানীয় সুলতান প্রথম সেলিম তার মিশরে অবস্থানের শেষ সপ্তাহে আল-আজহারে জুমার নামাজ আদায় করেছিলেন। তবে তিনি এসময় মসজিদের জন্য কিছু দান করেননি। পরবর্তীতে উসমানীয় আমিররা নিয়মিতভাবে আল-আজহারে জুমার নামাজ আদায় করতেন। তারা মসজিদে খুব বেশি ভর্তুকি দিতেন না, তবে বিভিন্ন উপলক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেয়া হত। উসমানীয় যুগের প্রথমদিকে শুধু দুইজন উসমানীয় ওয়ালি আল-আজহার মসজিদের সংস্কার করেছিলেন।[27]

প্রথম সেলিমের কাছে মামলুকরা পরাজিত হলেও মিশরীয় সমাজে তাদের প্রভাব ছিল। উসমানীয় গভর্নরদের অধীনে তারা বে (সর্দার) হিসেবে ছিলেন।[27] প্রথম সেলিমের অধীনে প্রথমে ইউনুস পাশা মিশরের উসমানীয় গভর্নর হন। কিন্তু তার দুর্নীতি কারণে সুলতান সেলিম তার স্থলে মামলুক আমির খাইর বেকে নিযুক্ত করেন। খাইর বে মার্জ দাবিকের যুদ্ধে উসমানীয়দের সহায়তা করেছিলেন।[29] মামলুকরা তাদের সালতানাত পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য কয়েকবার বিদ্রোহ করেছিল, এর মধ্যে দুইটি বিদ্রোহ ১৫২৩ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত হয়।[30] তবে উসমানীয়রা মিশরের ক্ষমতা কাঠামো থেকে মামলুকদের সম্পূর্ণরূপে অপসারণ করতে সক্ষম হয়। উসমানীয়দের বিজয়ের ফলে মামলুকরা অর্থনৈতিক ও সামরিক উভয় ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৮শ শতাব্দী নাগাদ মামলুক অভিজাতরা তাদের প্রভাবের অনেকাংশ ফিরে পায় এবং কায়রো এবং আল-আজহারের বিভিন্ন সংস্কারকার্যে অর্থসহায়তা প্রদান করে।[27]

ক্ষমতাশালী মামলুক বে আল-কাযদুগলি ১৮শ শতাব্দীর প্রথম দিকে বেশ কয়েকবার মসজিদের সংস্কার করেছেন। তার নির্দেশনায় ১৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দে অন্ধ ছাত্রদের রিওয়াক প্রতিষ্ঠিত হয়। কাইতবাইয়ের সময় প্রতিষ্ঠিত তুর্কি ও সিরিয়ান রিওয়াকে তিনি অর্থ সহায়তা করেছেন।[31]

১৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দে আবদুর রহমান কাতখুদা জানিসারি প্রধান নিযুক্ত হন। তিনি কায়রো ও আল-আজহারে বেশ কিছু নির্মাণ কাজ করেছেন। তার নির্দেশনা অণুযায়ী বাব আল-মুজাইয়িনিন (নাপিতদের ফটক), বাব আল-সায়িদা (সায়িদি ফটক) ও বাব আল-শুরবা (সুপ ফটক) নামক তিনটি ফটক নির্মিত হয়। প্রথম ফটকের বাইরে ছাত্ররা তাদের চুল কাটত বিধায় এই নাম হয়। দ্বিতীয় ফটকটি মিশরের সায়িদি গোষ্ঠীর নামে রাখা হয়েছে। তৃতীয় ফটক দিয়ে ছাত্রদের জন্য খাবার (প্রায়শ ভাতের সুপ) আনা হত। দক্ষিণে একটি নামাজের স্থান যুক্ত করায় ফলে নামাজের স্থান দ্বিগুণ হয়। কাতখুদা মসজিদের কয়েকটি রিওয়াক পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। তাকে আল-আজহারে তার নির্মিত সমাধিতে দাফন করা হয়েছে।[32][33]

উসমানীয় যুগে আল-আজহার মিশরের জনপ্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে এবং অন্যান্য মাদ্রাসাগুলোকে ছাড়িয়ে যায়। ১৮শ শতাব্দীর শেষ নাগাদ আল-আজহার মিশরের উলামাদের সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে পড়ে।[28] উলামারা সরকারের উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম ছিলেন। পাশার উপদেষ্টা হিসেবে বেশ কয়েকজন উলামা নিযুক্ত হয়েছিলেন।[34] এই যুগে ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও অন্যান্য বিষয় যেমন বিজ্ঞান, যুক্তি, দর্শন পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়।[35] এসময় শাফি মাজহাবের অণুসারী আবদুল্লাহ আল-শুবরাউয়ি আল-আজহারে প্রথম মালিকি মাজহাবের বাইরে থেকে রেক্টর নিযুক্ত হন।[36] এরপর ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মালিকি মাজহাবের কোনো রেক্টর এখানে দায়িত্বপালন করেননি। এসময় সালিম আল-বিশরি এই পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন।

মিশরে উসমানীয় শাসনের বিপক্ষে প্রতিবাদের ক্ষেত্রে আল-আজহার ভূমিকা পালন করেছে। আল-আজহারে ছাত্রপ্রতিবাদ সাধারণ বিষয় ছিল। ছাত্রদের সাথে একাত্মতা হিসেবে মসজিদ সংলগ্ন দোকানপাট অনেক সময় বন্ধ থাকত।[37] উলামারাও বিভিন্ন সময়ে সরকারের সমালোচনা করেছেন। ১৭৩০-৩১ খ্রিষ্টাব্দে উসমানীয় আগারা তিনজন পলাতকের পিছু ধাওয়ার সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের নিগৃহীত করেছিলেন। এর প্রতিবাদের আল-আজহারের ফটক বন্ধ রাখা হয়েছিল। ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হতে পারে ভেবে এসময় গভর্নর আগাদেরকে মসজিদের কাছে যেতে নিষেধ করেছিলেন। ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি ঘটনার সময় ওয়ালি আল-হুসাইন মসজিদের নিকটে জনতাকে নিগৃহীত করেছিলেন। তারা পরে আল-আজহারে প্রতিবাদের জন্য এসেছিল। এরপর ওয়ালিকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।[38]

ফরাসি আধিপত্য

১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে নেপোলিয়ন তার মিশর অভিযানের সময় ২ জুলাই আলেক্সান্দ্রিয়া এসে পৌছান এবং ২২ জুলাই কায়রোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।[39] মিশরীয় জনগণ ও উসমানীয় সাম্রাজ্য উভয়কে শান্ত করার জন্য নেপোলিয়ন আলেক্সান্দ্রিয়ায় ভাষণে ইসলাম ও সুলতানের প্রতি তার সম্মানের কথা প্রকাশ করেছিলেন:

মিশরের জনগণ, আপনাদের বলা হবে যে আমি আপনাদের ধর্ম ধ্বংস করতে এসেছি: একথা বিশ্বাস করবেন না! বলবেন যে আমি আপনাদের অধিকার রক্ষা এবং ধ্বংসকারীদের শাস্তি দিতে এসেছি, এবং আমি ঈশ্বর, তার নবী ও কুরআনকে মামলুকদের চেয়েও বেশি সম্মান করি ... আমরা কি তারা নই যারা শতাব্দীকাল ধরে সুলতানের বন্ধু হিসেবে রয়েছি?[40]

একজন মিশরীয় বেকে নেপোলিয়ন কর্তৃক তিনরঙের স্কার্ফ‌ প্রদান (১৭৯৮-১৮০০)।

২৫ জুলাই নেপোলিয়ন আল-আজহারের নয়জন শাইখের সমন্বয়ে একটি দিওয়ান গঠন করেন। তাদেরকে কায়রোর প্রশাসনের দায়িত্ব দেয়া হয়। উসমানীয় শাসন শুরু হওয়ার পর এই প্রথম মিশরীয়রা সরকারি ক্ষমতা পায়।[39][41] শহরের উলামাদের নিয়ে পরিষদ গঠনের এই নিয়ম প্রথমে আলেক্সান্দ্রিয়ায় শুরু হয়ে পরে ফরাসি-অধিকৃত মিশরে ছড়িয়ে পড়ে।[42] এছাড়া তিনি তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য আল-আজহারের উলামদের কাছ থেকে ফতোয়া আদায় করতে চেয়েছিলেন, তবে তিনি সফল হননি।[40]

মিশরীয় ও উসমানীয়দের উপর বিজয়ী হওয়ার নেপোলিয়নের চেষ্টা বিফল হয়। ১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর উসমানীয় সাম্রাজ্য যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ২১ অক্টোবর আল-আজহার থেকে ফরাসিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়।[43][44] পরেরদিন সকালে পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য দিওয়ান নেপোলিয়নের সাথে সাক্ষাত করে। নেপোলিয়ন প্রথমে রাগান্বিত হলেও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানে রাজি হন এবং শাইখদেরকে বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনা করতে বলেন। আলোচনার কথা উঠে আসার ফলে বিদ্রোহীরা ফরাসিদেরকে দুর্বল হয়ে পড়েছে ভেবে তা প্রত্যাখ্যান করে।[45] এরপর নেপোলিয়ন কায়রো দুর্গ থেকে আল-আজহার পর্যন্ত শহরে আগুন লাগিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। এই বিদ্রোহের সময় দুই থেকে তিনশত ফরাসি সৈনিক মারা যায়। এছাড়াও ৩,০০০ মিশরীয় হতাহত হয়।[46] সংক্ষিপ্ত বিচারের পর আল-আজহারের ছয়জন আলেমকে হত্যা করা হয় এবং পাশাপাশি আরো কয়েকজন দোষী সাব্যস্ত হন।[47] ফরাসিদের হাতে ধরা পড়া মিশরীয়দের বন্দী করা হয় এবং অস্ত্রসহ ধরা পড়লে শিরশ্ছেদ করা হয়।[48] ফরাসি সৈনিকরা উদ্দেশ্যমুলকভাবে মসজিদের সম্মানহানি করেছিল। তারা জুতা পায়ে ও বন্দুক নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করে। মসজিদের মিহরাবের সাথে ঘোড়া বেধে রাখা হয়। ছাত্রদের আবাসস্থল ও গ্রন্থাগার তছনছ করা হয় এবং কুরআন মাটিতে ফেলে দেয়া হয়। এরপর বিদ্রোহী নেতারা আলোচনায় বসতে চাইলে তা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল।[46]

নেপোলিয়ন মিশরে সম্মানিত ছিলেন। কায়রোর জনতার মধ্যে তাকে সুলতান আল-কবির বা মহান সুলতান বলা হত। এ ঘটনার পর তিনি তার অবস্থান হারিয়ে ফেলেন।[49] ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ফরাসি জেনারেল জ্য ব্যাপটিস্ট ক্লেবের আল-আজহারের ছাত্র সুলাইমান আল-হালাবির হাতে নিহত হন। হত্যাকান্ডের পর নেপোলিয়ান মসজিদ বন্ধের নির্দেশ দেন। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে উসমানীয় ও ব্রিটিশ সাহায্য আসার আগ পর্যন্ত মসজিদের দরজা বন্ধ ছিল।[41]

নেপোলিয়নের আক্রমণের পর আল-আজহারের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আসে। মিশরে ছাপাখানা চালু হওয়ার ফলে পূর্বের মৌখিক বক্তব্য ও স্মৃতিতে ধারণের মাধ্যমে শিক্ষার স্থলে লিখিত আকারে শিক্ষাদান শুরু হয়। তবে মসজিদের নিজস্ব ছাপাখানা ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে চালু হয়েছিল।[50] ফরাসিরা চলে যাওয়ার পর মুহাম্মদ আলি পাশা আধুনিক বিজ্ঞানের বিষয়াদি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে উৎসাহিত করেন। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ জামালউদ্দিন আফগানির নির্দেশনায় ইউরোপীয় দর্শনকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[50]

মুহাম্মদ আলি রাজবংশ ও ব্রিটিশ আধিপত্য

মুহাম্মদ আলি পাশা মিশরে মুহাম্মদ আলি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই রাজবংশ ১৮০৫ থেকে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মিশর শাসন করেছে।

ফরাসিদের মিশর ত্যাগের পর মিশরের ওয়ালি (গভর্নর) মুহাম্মদ আলি পাশা দেশে তার নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করায় মনোনিবেশ করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি আল-আজহারের আলেমদের প্রভাব হ্রাসের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেন। আল-আজহারের আয়ের একটি প্রধান উৎস ছিল করমুক্ত জমি। তিনি এগুলোর উপর করারোপ করেছিলেন।[41] ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে তিনি এসকল জমি সরকারের অণুকূলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন। এই সিদ্ধান্ত উলামাদের ক্ষিপ্ত করে তোলে। এর ফলে নকিব আ-আশরাফ নামক পদের দায়িত্বে থাকা উমর মাকরাম সেই বছরের জুলাই মাসে একটি বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয় এবং মাকরামসহ প্রভাবশালী উলামারা দায়িয়েতে নির্বাসিত হন।[51]

আল-আজহারের বাইরে লেখাপড়া করা ব্যক্তিদেরকে সরকারে নিযুক্ত করে আলি আল-আজহারের আলেমদের প্রভাব কমাতে চেয়েছিলেন। তিনি নির্বাচিত কিছু ছাত্রকে পাশ্চাত্য ব্যবস্থায় পড়াশোনার জন্য ফ্রান্সে পাঠান। তিনি পাশ্চাত্য ধাচের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন এবং আল-আজহারের ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে যান।[41]

মুহাম্মদ আলির নাতি ইসমাইল পাশার শাসনামলে কায়রোকে ইউরোপীয় শৈলীর শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ব্যাপক কার্যক্রম শুরু হয়।[52] এসকল কার্যক্রমের জন্য ব্রিটেনের কাছে মিশর বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করে ফলে ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা মিশর অধিকার করে নিতে সক্ষম হয়।[52][53]

ইসমাইল পাশার শাসনামলে আল-আজহার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ফিরে পায়। খেদিভ হিসেবে ইসমাইল পাশা বাব আল-সায়িদা ফটক ও মাদ্রাসা আল-আকবাগাউয়িয়া সংস্কার করেন। ব্রিটিশদের চাপের ফলে ইসমাইল পাশার পদত্যাগের পর তার পুত্র তৌফিক পাশা খেদিভ হন। তিনি মসজিদের সংস্কার বহাল রাখেন। তিনি মসজিদের বেশ কিছু অংশের নকশা নতুন করে প্রণয়ন করেছিলেন। তৌফিক পাশার পর তার পুত্র দ্বিতীয় আব্বাস ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে মিশর ও সুদানের খেদিভ হন। তিনি তার দাদা ইসমাইলের শুরু করা সংস্কারকাজ চালু রাখেন। মসজিদের মূল বহিরাঙ্গণ তিনি পুনরায় তৈরি করেছিলেন। সেসাথে একটি নতুন রিওয়াক নির্মিত হত। তার শাসনামলে ফাতেমীয় যুগে নির্মিত উঠোনও সংস্কার করা হয়। এসকল সংস্কার আল-আজহারের আধুনিকায়নে সহায়তা করেছে।[54]

ইসমাইল পাশার শুরু করা সংস্কার কার্যক্রম ব্রিটিশ শাসনামলেও চালু ছিল।[55] ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে শাইখ আল-আজহার মুহাম্মদ মাহদি আল-আব্বাসি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারা চালু ও ছাত্রদের পরীক্ষা পদ্ধতির উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু সংস্কার চালু করেন। ব্রিটিশ যুগে হিলমির শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নের জন্য আরো কিছু প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল।[56] মসজিদের পাণ্ডুলিপির সংগ্রহ কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত হয়, ছাত্রদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন করা হয় এবং পড়ালেখার ক্ষেত্রে নিয়মিত পরীক্ষার পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মিশরের অন্যান্য কলেজগুলো সরাসরি আল-আজহার মসজিদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা হয়।[55]

সাদ জাগলুল মিশরের শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে আল-আজহারের শিক্ষানীতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়েছি।[56] রক্ষণশীল ধারার সমর্থক হলেও আল-আজহার মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থি ছিল না।[55] এখানে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, বিশেষত ইন্দোনেশিয়া থেকে অনেক ছাত্র পড়তে আসে। এর ফলে ওয়াহাবিবাদের সাথে ভারসামত্য বজায় থাকে।[57]

মিশরের বাদশাহ প্রথম ফুয়াদের শাসনামলে প্রণীত দুইটি আইনে আল-আজহারের শিক্ষাকাঠামোকে পুনর্গঠিত করা হয়। এর মধ্যে প্রথমটি ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত হয়েছিল। এর মাধ্যমে পুরো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আরবি ভাষা, শরিয়া ও ধর্মতত্ত্ব এই তিনটি বিভাগে ভাগ করা হয়। এসকল বিভাগ মসজিদের বাইরে কায়রোতে পৃথক ভবনে স্থাপন করা হয়েছিল[56] এসব বিভাগ থেকে ডিগ্রি নেয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হত।[58] ছয় বছর পর দ্বিতীয় আইনটি প্রণীত হয়। এই আইনের মাধ্যমে মূল দপ্তরকে মসজিদের বাইরে একটি ভবনে স্থানান্তর করা হয়। বিভাগসমূহের ভবনের জন্য পরবর্তীকালে বাড়তি অবকাঠামো নির্মিত হয়েছিল।[56]

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে মুস্তাফা আল-মারাগি আল-আজহারের রেক্টর নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন মুহাম্মদ আবদুহর অণুসারী। তার নিয়োগের পর মুহাম্মদ আবদুহ ও মুহাম্মদ আল-আহমাদি আল-জাওয়াহিরির মত সংস্কারকদের ধারণা আল-আজহারে প্রবর্তিত হওয়া শুরু হয়। অনেক উলামা তার নিয়োগের বিরোধী ছিলেন।[58][59] আল-মারাগি ও তার উত্তরসুরিরা মসজিদ ও মাদ্রাসার আধুনিকীকরণ সংস্কার শুরু করেছিলেন। এসময় পাঠদানের বিষয় বৃদ্ধি করা হয়। বাদশাহ ফুয়াদ আল-মারাগিকে অপছন্দ করতেন। এক বছর পর আল-জাওয়াহিরিকে রেক্টর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পরে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে আল-মারাগি পুনরায় রেক্টর হন। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যূর আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে আসীন ছিলেন। তার অধীনে আল-আজহারে আরবি ছাড়াও অন্য ভাষা এবং আধুনিক বিজ্ঞান পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়।[60] আল-জাওয়াহিরিও আধুনিকীকরণ ও সংস্কার চালু রেখেছিলেন। আল-মারাগির দ্বিতীয় দফা রেক্টর হিসেবে দায়িত্বপালন করার পর আবদুহর আরেক ছাত্র রেক্টর হয়েছিলেন।[59]

১৯৫২ এর বিপ্লব পরবর্তীকাল

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ নজিবজামাল আবদেল নাসেরের নেতৃত্বে ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টের বিপ্লবের পর মিশরের রাজতন্ত্র উৎখাত করা হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদ পৃথক হয়।[50][61] ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে আধুনিক ক্যাম্পাসের জন্য মসজিদের চারপাশের স্থান অধিগ্রহণ করে স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়। মসজিদ এরপর থেকে আর শিক্ষালয় হিসেবে টিকে থাকেনি। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ে উন্নীত করা হয়।[56][61] ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের আইনে আল-আজহারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকাকে পৃথক করা হয়।[62] এই আইনে আল-আজহারে ধর্ম বহির্ভূত বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করা হয় যেমন চিকিৎসা, প্রকৌশল, অর্থনীতি ইত্যাদি।[63][64] এসকল সংস্কারের পর আল-আজহার কর্তৃক পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোতে মিশরীয় ছাত্রদের সংখ্যা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ এর দশকের মধ্যে এসব বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা ৯০,০০০ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩,০০,০০০তে পৌছায়। ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে এই সংখ্যা ১০,০০,০০০ হয় এবং ২০০১ এ তা ১৩,০০,০০০ ছাড়িয়ে যায়।[65][66]

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের বিপ্লবের নেতা জামাল আবদেল নাসের আল-আজহারে বেশ কিছু সংস্কার সাধন করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে নাসের আল-আজহারের উলামাদের প্রভাব খর্ব করতে এবং নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ওয়াকফ জাতীয়করণ করা হয় এবং নবগঠিত আওকাফ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ফলে মসজিদ তার নিজ অর্থনৈতিক বিষয়াদি পরিচালনার দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।[67][68] ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শরিয়া আদালত বিলুপ্ত করে একে রাষ্ট্রীয় বিচারিক ব্যবস্থার সাথে অঙ্গীভূত করেন ফলে উলামাদের স্বাধীনতা অনেক কমে যায়।[68] ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের সংস্কার আইন দ্বারা ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের আল-আজহারের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া আইন বাতিল করা হয় এবং শাইখুল আজহার পদে নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। এই পদটি উসমানীয় যুগে সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেসময় থেকে এই পদে উলামাদের মধ্য থেকে কাউকে নিয়োগ দেয়া হত এবং উলামারা নিয়োগের দায়িত্বপালন করতেন।[69][70] তবে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব প্রদর্শনে অক্ষম হলেও জনগণের মধ্যে আল-আজহারের প্রভাব বজায় ছিল এবং একে জাতি ও রাষ্ট্রের ইসলামি চরিত্রের প্রতীক হিসেবে দেখা হত। বিপ্লবের পর আল-আজহার রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের অংশ হয়ে পড়ে। পাঠ্যক্রমের স্বাধীনতা ও মসজিদ হিসেবে ভূমিকা খর্ব হয়।[71] ধর্মীয় আইন ব্যাখ্যার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উলামাদের কর্তৃত্ব আরো কমে যায়।[72] এসব সংস্কার উলামাদের স্বাধীনতা খর্ব করলেও তারা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত হয়ে পুনরায় তাদের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করেছেন।[73] ১৯৬১ এর আইনে উলামাদেরকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সরবরাহ দিয়েছিল তবে মূল নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে ছিল না।[74] নাসের উলামাদেরকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অধীনস্থ করতে চাইলেও অতিমাত্রায় প্রভাব খর্ব করার প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এমন একটি প্রস্তাব তাহা হুসাইন ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে উত্থাপন করেছিলেন। এতে আল-আজহারের পাঠ্যক্রমে পরিচালিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ, কলেজিয়েট শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে শুধুমাত্র ধর্মীয় অণুষদ হিসেবে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল। উলামারা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। তবে আল-আজহারের প্রভাব নিয়ে নাসেরের কর্মকাণ্ড তার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিবেচনায় সম্পাদিত হয়েছিল যাতে তার শাসনকে আল-আজহার বৈধতা দেয়।[75]

আল-আজহার এরপর সরকারি ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয় এবং সরকারের বিভিন্ন কাজের বৈধতা দিতে ব্যবহৃত হয়। পূর্বে উলামারা সমাজতন্ত্রকে ইসলামের বিরোধী বলে বক্তব্য দিলেও বিপ্লব পরবর্তী সময়ের ভূমি সংস্কারের ব্যাপারে সমর্থন পাওয়া যায়। নাসের একে ইসলামি সমাজতন্ত্র বলতেন[76] উলামারা মুসলিম ব্রাদারহুডওয়াহাবি প্রভাবের সাথে ভারসাম্য রাখতে সহায়তা করেছেন।[77] নাসেরকে একবার হত্যার চেষ্টা করা হলে ব্রাদারহুডকে দোষারোপ করা হয়েছিল এবং সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়। ব্রাদারহুডের সদস্যদের গণগ্রেপ্তার শুরু হওয়ার পর নাসেরের উলামাদের সমর্থন প্রয়োজন হয় তাই তিনি আল-আজহারের উপর জারি করা কিছু নিয়ম শিথিল করেন। এরপর উলামারা ব্রাদারহুডের ব্যাপারে তার কার্যক্রমকে সমর্থন দেন এবং পরবর্তী সময়গুলোতেও সমর্থন বজায় রেখেছিলেন।[72][78] তবে নাসের ও আল-আজহার উভয়ে ব্রাদারহুডের বিপক্ষে গেলেও সংগঠন তাদের কাজ চালু রেখেছিল।[79] আল-আজহারের তরফ থেকে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধকে বৈধতা দেয়া হয়েছিল।[80]

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে নাসেরের মৃত্যুর পর আনোয়ার সাদাত মিশরের রাষ্ট্রপতি হন। তিনি আল-আজহারকে আরব বিশ্বে মিশরীয় নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন "আরব বিশ্ব মিশর ও তার আজহার ছাড়া চলতে পারে না।"[81] ব্রাদারহুডের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে সাদাত ব্রাদারহুড ও উলামাদের উপর কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছিলেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে সাদাত তার অবস্থানকে আক্রমণ করছে মনে হওয়ায় অনেক সাংবাদিক ও সংগঠনের উপর চড়াও হন। সমালোচনা বন্ধের জন্য তার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় নীতির সমালোচক বা বিরোধী উলামাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। আল-আজহারের উলামাগণ রাষ্ট্রীয় অঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকেন। ইসলামপন্থিসহ আরো অনেক গোষ্ঠী তাদের এই ভূমিকার নিন্দা জানায়।[80] প্রভাবশালী ইসলামপন্থি ব্যক্তিত্ব শুকরি মুস্তাফা সরকারের প্রতি সমর্থনের জন্য উলামাদের নিন্দা জানিয়েছিলেন।[81] মিশরের জনগণ ইসরায়েলকে শত্রু বিবেচনা করলেও সাদাত ইসরায়েলের সাথে শান্তি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। আল-আজহার এক্ষেত্রে তাকে সমর্থন দেয়।[80]

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে আনোয়ার সাদাত নিহত হওয়ার পর হোসনি মুবারক তার উত্তরসুরি হন। মুবারকের অধীনে আল-আজহার পূর্বের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা পেয়েছে। জাদ আল-হক ১৯৮২ থেকে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর আগপর্য‌ন্ত শাইখুল আজহার ছিলেন। তিনি দাবি করতেন যে সরকার যদি চায় যে আল-জামাআ আল-ইসলামিয়া বা অণুরূপ সংগঠনগুলোর সাথে আল-আজহার কার্যকরভাবে মোকাবেলা করুক তবে আরো বেশি স্বাধীনতা দিতে হবে এবং ধর্মীয় ঘোষণা দেয়ার অণুমতি দিতে হবে।[82] মুবারকের শাসনামলে সরকারের তরফ থেকে আল-আজহারকে কিছু ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। ১৯৯০ এর দশকে সেন্সরশিপ আইনের পরিবর্তনের ফলে আল-আজহার প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম পর্যবেক্ষণ করার সুবিধা পায়। নিয়মানুযায়ী অভিযোগ আসার পর আল-আজহার কাজ শুরু করতে পারত, তবে বাস্তবে এভাবে কাজ হত না। সম্প্রচারের পূর্বে টিভির স্ক্রিপ্ট অণুমোদনের জন্য নিয়মিতভাবে আল-আজহারে পাঠানো হত।[83]

আল-আজহার বিশ্বজুড়ে সুন্নিদের ভেতর মর্যাদা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। সুন্নিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় মুসলিম বিশ্বের আল-আজহারের প্রভাব রয়েছে।[84] মিশরের বাইরেও আল-আজহার তার ধর্মীয় সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে। উপসাগরীয় যুদ্ধের পূর্বে সৌদি আরবের বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ ইসলামের দুইটি প্রধান মসজিদ মসজিদুল হারামমসজিদে নববী সৌদি আরবে অবস্থিত হওয়ায় বিদেশি সৈনিকদের দেশে অবস্থানের অণুমতি দেয়া সঠিক হবে কিনা তা জানতে সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতির পরিবর্তে‌ আল-আজহারের কাছে ফতোয়া চেয়েছিলেন।[85] ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে নিকোলা সার্কোজি ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে ফ্রান্সের বিদ্যালয়গুলোতে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব না পড়ার অণুমতি দেয়ার জন্য ফ্রেঞ্চ কাউন্সিল অফ দ্য মুসলিম ফেইথের পরিবর্তে আল-আজহারের কাছে অণুরোধ করেছিলেন। আল-আজহার থেকে এই অণুরোধের অণুকূলে সিদ্ধান্ত এসেছিল। এই সিদ্ধান্ত ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়।[86]

২০১১ বিপ্লব পরবর্তী সময়

২০১১ মিশরীয় বিপ্লবের সময় আল-আজহারের উপর বিপ্লবের প্রভাব পড়েছে। এই বিপ্লবে রাষ্ট্রপতি হোসনি মুবারক ক্ষমতা হারান। এরপর অণুষ্ঠিত নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুড বিজয়ী হয়।[87] রাষ্ট্রের কাছ আল-আজহারের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য দাবি উঠে এবং আল-আজহারের অধিক স্বাধীনতা বজায় থাকে এমন আইন মসজিদের তরফ থেকে লিখিত হয়েছিল।[87] আল-আজহারের ভবিষ্যত ভূমিকা কী হবে সে বিষয়ে বিভিন্ন দল থেকে নানা রকম মত উঠে আসে।[88]

স্থাপত্য

আল-আজহারের স্থাপত্য কায়রোর ইতিহাসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। প্রাচীন মিশর থেকে শুরু করে গ্রিক ও রোমান শাসনসহ নানা সময়ের উপাদান এতে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও ইফ্রিকিয়ার অন্যন্য ফাতেমীয় স্থাপনাতেও এমন সব উপাদান ব্যবহৃত হয়েছিল।[89] পরবর্তীতে সংযুক্ত উপাদানগুলো মিশরের ভেতর ও বাইরে উভয় স্থান থেকে এসেছে। মসজিদের বিভিন্ন অংশ এধরনের মিশ্র প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আবার কিছু স্থানে একই ধরনের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। এমন একটি উদাহরণ হল উসমানীয়দের নির্মিত গম্বুজ ও মামলুকদের নির্মিত মিনার[90]

প্রথমে শুধু একটা উঠোনসহ নামাজের স্থান নির্মিত হলেও পরবর্তীকালে মূল কাঠামোকে ঘিরে মসজিদের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে।[91] মিশরের অনেক শাসক আল-আজহারের শিল্প ও স্থাপত্যকে রূপ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে উসমানীয়দের গম্বুজ, মামলুকদের মিনার ও সাম্প্রতিক সময়ে নতুন মিহরাব সংযোজন[92] মূল মিনার বা গম্বুজগুলো বর্তমানে টিকে নেই। বর্তমান মিনারগুলোর কিছু বেশ কয়েকবার পুনর্নির্মিত হয়েছে।[15][93]

ফাতেমীয়দের অধীনে কাঠামোগত পরিবর্তন

মসজিদের মূল কাঠামো ২৮০ ফুট (৮৫ মি) দীর্ঘ এবং ২২৭ ফুট (৬৯ মি) প্রশস্ত ছিল।[6] উঠোনের পাশে তিনটি আর্কেড উঠোনকে ঘিরে রয়েছে।[15] উঠোনের দক্ষিণপশ্চিমে নামাজের স্থান রয়েছে।[32][94] কিবলার দেয়ালের আকার ২৬০ ফুট (৭৯ মি) * ৭৫ ফুট (২৩ মি) যা সঠিক কোণ থেকে কিছুটা সরে আছে।[92] নামাজের স্থানকে ঘিরে রাখা চারটি আর্কেডগুলো মার্বেলের স্তম্ভ দ্বারা ধরে রাখা হয়েছে।[92][95] বিভিন্ন পুরুত্বের ভিত্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন উচ্চতার স্তম্ভবগুলো স্থাপন করা হয়েছে।[92] অভ্যন্তরের নকশায় আব্বাসীয়, কপ্টিকবাইজেন্টাইন স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।[96]

সবমিলিয়ে তিনটি গম্বুজ নির্মিত হয়েছে। উত্তর আফ্রিকান মসজিদে এটি সাধারণ প্রথা ছিল। তবে আল-আজহারের বেশ কয়েকবার সংস্কারের ফলে এগুলো বর্তমানে টিকে নেই।[96][97] ইতিহাসবিদ আল-মাকরিজি লিখেছেন যে মূল গম্বুজে আল-সিকিলি নিম্নোক্ত লেখা উৎকীর্ণ করেছিলেন:

আল্লাহর নামে, পরম দয়াময়, অশেষ দয়ালু; এর নির্মাণের জন্য আল্লাহর দাস, তার নিযুক্ত শাসক আবু তামিম মাআদ, ইমাম আল-মুইজ লিদিনাল্লাহ, আমিরুল মুমিনিন, তিনি এবং তার পূর্বপুরুষ ও বংশধরদের উপর আল্লাহর অণুগ্রহ হোক, এর নির্দেশে: তার অধীনস্থ জওহর, সচিব, সিকিলির হাতে ৩৬০ সালে (হিজরি)।

জওহর খলিফার উপাধিতে সম্মানসূচক হিসেবে আমিরুল মুমিনিন এবং নিজের "সচিব" উপাধি যুক্ত করেছিলেন। সেনাপতি হওয়ার পূর্বে তিনি সচিব হিসেবে কাজ করেছেন।[98]

মিশরের ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে স্তম্ভসহ হাইপোস্টাইল প্রার্থনা স্থান ব্যবহৃত হয়েছে।

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে মূল মিহরাব উন্মোচিত হয়। এর উপরে একটি অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ ও দুইপাশে মার্বেলের স্তম্ভ রয়েছে।[99] মিহরাবে কুরআনের দুই সেট আয়াত উৎকীর্ণ ছিল যা এখনো অক্ষত রয়েছে। প্রথম সেটে সূরা আল মু'মিনূনের প্রথম তিন আয়াত রয়েছে:

قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ – الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ – وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ

মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে – যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র - যারা অনর্থক কথাবার্তায় নির্লি‌প্ত

দ্বিতীয় আয়াতগুলো সূরা আল আনআমের ১৬২ ও ১৬৩ নং আয়াত:

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ – لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ

বল: আমার নামাজ, আমার কুরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে - তার কোন অংশীদার নেই। আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আনুগত্যশীল।

এই উৎকীর্ণ অংশগুলো একমাত্র অলংকরণ যা নিশ্চিতভাবে ফাতেমীয় যুগের সাথে সম্পর্কিত করা যায়।[99]

উঠোনের দেয়ালে কিল আকৃতির আর্চ ও অলঙ্করণ

১০০৯ থেকে ১০১০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মার্বেলের মেঝে যুক্ত করা হয়।[100] উঠোনকে ঘিরে থাকা আর্কেড কিল আকৃতির আর্চ যুক্ত ও অলঙ্করণ সমৃদ্ধ। এসকল আর্চ আল-হাফিজের শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল।[101] অলঙ্করণগুলোও তার সময়ের এবং ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে সেগুলো পুনরায় অঙ্কন করা হয়।[101] দুই ধরনের অলঙ্করণ এতে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও কুফিক লিপিতে লেখা কুরআনের আয়াত উৎকীর্ণ রয়েছে। কুরআনের আয়াত ফাতেমীয় যুগে উৎকীর্ণ হয়েছিল।[101] দক্ষিণের আর্কেডে মূল প্রবেশপথ অবস্থিত।[101]

১০০৯ খ্রিষ্টাব্দে আল-হাকিমের শাসনামলে একটি কাঠের দরজা যুক্ত করা হয়েছিল।[102] ১১২৫ খ্রিষ্টাব্দে আল-আমির একটি কাঠের মিহরাব যুক্ত করেন। আল-হাফিজ লিদিনাল্লাহর সময় অতিরিক্ত একটি গম্বুজ নির্মিত হয়। তিনি উঠোনের চারদিকে চতুর্থ একটি আর্কেড ও পশ্চিমের দেয়ালে একটি বহিরাঙ্গণ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন।[96][103]

মামলুক সংযোজন

মাদ্রাসা আকবাগাউয়িয়ার উপর অবস্থিত মিনার। মামলুক শাসনামলে এই মিনার নির্মিত হয়। উসমানীয় যুগে কাতখুদা এর পরিবর্তন সাধন করেছিলেন।

ফাতেমীয়দের পর সালাহউদ্দিন ও তার আইয়ুবীয় রাজবংশ মিশরের শাসনভার লাভ করে। সালাহউদ্দিন প্রথমে ফাতেমীয় খলিফা আল-আদিদের উজির ছিলেন। তিনি মিশরে তার অবস্থান শক্ত করেছিলেন এবং বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন।[104] এসময় শিয়া সংশ্লিষ্টতার জন্য আল-আজহার তার পূর্ব অবস্থান হারিয়ে ফেলে।[17] তবে পরবর্তী মামলুক সালতানাতের সময় মসজিদ সংস্কার ও বর্ধিত করা হয়।[105] সংস্কার কাজের মধ্যে ছিল মিহরাবের পরিবর্তন ও এতে মার্বেলের সম্মুখভাগ সংযুক্তি।[92]

মাদ্রাসা আল-আকবাগাউয়িয়ার শীর্ষে একটি গম্বুজ ও মিনার রয়েছে। এখানে আমির আকবুগার কবর অবস্থিত। ১৩৩৯ খ্রিষ্টাব্দে এটি নির্মিত হয়।[106] শুরু থেকে এই অংশটি মসজিদের সাথে যুক্ত রয়েছে।[91] এর প্রবেশপথ, কিবলার দেয়াল ও মিহরাবের কাচ মোজাইক সবই পুরনো এবং গম্বুজটি উসমানীয় যুগে নির্মিত।[106]

মাদ্রাসা গাওহারিয়া ১৪৪০ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছে।[107] এখানে সুলতানের কোষাগার রক্ষক গওহর আল-কানাকবাইয়ের কবর রয়েছে।[106] মাদ্রাসার মেঝে মার্বেল নির্মিত। দেয়াল আবলুশ কাঠ, হাতির দাঁতে সজ্জিত। কবরের ঘরটি ক্ষুদ্র আরাবেস্ক গম্বুজ দিয়ে আচ্ছাদিত।[106]

মাদ্রাসা আল-তাইবারসিয়া

মাদ্রাসা আল-তাইবারসিয়া ১৩০৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। এখানে আমির তাইবার্সের কবর অবস্থিত।[106][107] আল-আজহারের সম্পূরক মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এটি নির্মিত হয়েছিল বিধায় শুরু থেকে এটি মসজিদের সাথে যুক্ত।[25] এই মাদ্রাসায় মালিকি ও শাফি মাজহাব বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হত। বর্তমানে এখানে গ্রন্থাগারের পাণ্ডুলিপি রক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। পুরনো কাঠামোর মধ্যে শুধু কিবলার দিকের দেয়াল ও মিহরাব টিকে রয়েছে।[106] আল-মাকরিজি লিখেছেন যে এই মাদ্রাসায় শুধু শাফি মাজহাবের উপর শিক্ষা দেয়া হত। অন্যদিকে ইবনে দাকমাক লিখেছেন যে একটি লিওয়ানে শাফি এবং অন্য একটি লিওয়ানে মালিকি মাজহাবের উপর শিক্ষা দেয়া হত।[108]

আবদুর রহমান কাতখুদা মাদ্রাসাটি সম্পূর্ণরূপে পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। এসময় শুধু দক্ষিণপূর্বের দেয়াল ও মিহরাব রেখে দেয়া হয়। কে. এ. সি. ক্রেসওয়েল এই মিহরাবকে কায়রোর সুন্দরতম মিহরাবের অন্যতম হিসেবে বর্ণনা করেছেন।[108] মিহরাবের কুলুঙ্গি ১.১৩ মিটার (৩.৭ ফু) প্রশস্ত এবং ৭৬ সেন্টিমিটার (৩০ ইঞ্চি) গভীর। কুলুঙ্গির প্রত্যেক পাশে একটি করে ২.৭৮ মিটার (৯.১ ফু) উচু স্তম্ভ আছে। স্তম্ভের উপরে রঙ্গিন জ্যামিতিক নকশার ব্লক রয়েছে।[108] মিহরাবের উপরের অর্ধবৃত্ত বাইরের আর্চের ভেতর অবস্থিত। এই আর্চের বাইরে আয়তক্ষেত্রকার ফ্রেম রয়েছে। এই ধরনের ফ্রেমযুক্ত মিহরাব মিশরে এটি প্রথম।[109]

কাইতবাই মিনার

কাইতবাই মিনার

এই মিনার ১৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। এতে দুইটি অষ্টাভুজাকার ও একটি সিলিন্ডার আকৃতির উলম্ব অংশ রয়েছে। এর বারান্দা সংখ্যা তিন। প্রত্যেকটি বারান্দা মুকারনাস ব্যবহার করে ধরে রাখা হয়েছে।[110] প্রথম উলম্ব অংশটি অষ্টাভুজাকার। এর উপরে আরেকটি উলম্ব অংশ বারান্দা দ্বারা প্রথম অংশ থেকে পৃথক অবস্থায় রয়েছে।[110] দ্বিতীয় আরেকটি বারান্দা মিনারের শেষ অংশকে ধরে রেখেছে। তৃতীয় আরেকটি বারান্দা শীর্ষভাগকে ধরে রেখেছে।[110]

এই মিনারটি পূর্বের একটি ফাতেমীয় মিনারের স্থলে নির্মিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সমসাময়িক বিবরণসমূহ অণুযায়ী ফাতেমীয় মিনারের নির্মাণ কাজে ত্রুটি থাকায় তা কয়েকবার পুনর্নির্মিত হয়েছে।[93] এর মধ্যে একটি পুনর্নির্মাণ সুলতান বাইবার্সের শাসনামলে কাজি আল-কুজাত (সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি) সদর আল-দীন আল-আদরাই আল-দিমাস্কি আল-হানাফির নির্দেশনায় হয়েছিল।[89] ১৩৯৭ খ্রিষ্টাব্দে বারকুকের অধীনে এটি পুনরায় নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। মিনার বেশি বেকে যাওয়ায় ১৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে কায়রোর ওয়ালি ও মুহতাসিব তাজ আল-দীন আল-শাওবাকি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। ১৪৩২ খ্রিষ্টাব্দে আবার মিনারটি নির্মিত হয়। মসজিদে প্রবেশপথের পুনর্নির্মাণের অংশ হিসেবে কাইতবাই মিনার নির্মিত হয়েছিল।[93]

বাব আল-গিন্দি

বাব আল-মুজাইয়িনিন দিয়ে প্রবেশের পর অপর পাশে বাব আল-গিন্দি (কাইতবাইয়ের ফটক) অবস্থিত। এটি ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। এর মাধ্যমে নামাজের স্থানে যাওয়া যায়। [92]

গাওরি মিনার

আল-আশরাফ কানসুহ আল-গাওরির দুই অংশ বিশিষ্টি মিনার

এই মিনারটি কানসুল আল-গাওরির শাসনামলে ১৫০৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়।[92] এর ভিত্তি বর্গাকার। প্রথমে উলম্ব অংশটি অষ্টাভুজাকার[110] দ্বিতীয় উলম্ব অংশটি একটি বারান্দার মাধ্যমে প্রথম অংশের থেকে আলাদা করা। এটি নীল ফাইন্স দিয়ে সজ্জিত। দ্বিতীয় অংশের সাথে তৃতীয় অংশটিও বারান্দার মাধ্যমে আলাদা করা হয়েছে। তৃতীয় অংশটি দুইটি আয়াতকার উলম্ব অংশের সমন্বয়ে গঠিত। দুইটি উলম্ব অংশের প্রত্যেক পাশে অশ্বখুরাকৃতি আর্চ রয়েছে। এগুলোর শীর্ষভাগ কারুকার্য করা।[110]

উসমানীয় সংস্কার ও সংযোজন

মিশরে উসমানীয় শাসনামলে মসজিদে বেশ কিছু সংযোজন ও সংস্কার করা হয়। এর মধ্যে বেশ কিছু আবদুর রহমান কাতখুদার অধীনে হয়েছিল। তিনি মসজিদের আকার প্রায় দ্বিগুণ করেছিলেন।[111] তিনি বাব আল-মুজাইয়িনিন, বাব আল-শুরবাবাব আল-সায়িদা নামক ফটক নির্মাণ করেছিলেন।[32] এসময় কয়েকটি রিওয়াক সংযুক্ত করা হয় যার মধ্যে একটি অন্ধ ছাত্রদের জন্য ছিল।[33] কাতখুদা মূল নামাজের স্থানের দক্ষিণে অতিরিক্ত একটি মিহরাবসহ একটি অতিরিক্ত নামাজের স্থান যুক্ত করেছিলেন ফলে নামাজের স্থান দ্বিগুণ হয়।[33][111]

বাব আল-মুজাইয়িনিন

বাব আল-মুজাইয়িনিন (নাপিতদের ফটক)

বাব আল-মুজাইয়িনিন (باب المزينين) ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল।[112][113] এর দুইটি দুইটি প্রবেশপথ রয়েছে। দরজার উপরে দুইটি অলংকৃত অর্ধ-বৃত্তাকার আর্চ রয়েছে। আর্চের উপরে সাইপ্রেস গাছের প্যানেলের কারুকার্য রয়েছে। এটি উসমানীয় যুগের সাধারণ প্রথা ছিল।[91]

কাতখুদা নির্মিত একটি মুক্ত মিনার ফটকের বাইরে অবস্থিত ছিল। তৌফিক পাশার আধুনিকীকরণের সময় আল-আজহার স্ট্রিট চালুর পূর্বে এটি ভেঙে ফেলা হয়।[54]

বর্তমান কাঠামো

মসজিদের বর্তমান মিহরাবমিম্বর

বাব আল-মুজাইয়িনিন বর্তমানে প্রবেশপথ। এ ফটক দিয়ে প্রবেশের পর মার্বেলদিয়ে বাধাই করা উঠানে আসা যায়। এর বিপরীতে মূল নামাজের স্থান রয়েছে।[91][114] বাব আল-মুজাইয়িনিনের উত্তরপূর্বে উঠানের বহির্ভাগে মাদ্রাসা আল-আকবাগাউয়িয়া অবস্থিত এবং দক্ষিণপশ্চিমে মাদ্রাসা আল-তাইবারসিয়া অবস্থিত।[25] প্রধান প্রবেশপথের বিপরীতে ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত বাব আল-গিনদি (কাইতবাই ফটক) অবস্থিত। এর উপরে কাইতবাই মিনার রয়েছে।[91] এই ফটক দিয়ে নামাজের স্থানে যাওয়া যায়[92]

আরও দেখুন

  • মিশরে ইসলাম
  • বাব আল-ফুতুহ
  • কাতখুদার সাবিল-কুত্তাব
  • মধ্যযুগের আরব ও পশ্চিম ইউরোপীয় গম্বুজের ইতিহাস

পাদটীকা

  1. আমর ইবনুল আস মসজিদ আধুনিক কায়রো ও আফ্রিকার সবচেয়ে পুরনো মসজিদ। এটি ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। তবে আমর ইবনুল আস মসজিদসহ আল-আজহারের চেয়ে পুরনো মসজিদগুলো ফুসতাত শহরে নির্মিত হয়েছিল। ফুসতাত পরে কায়রোর অংশ হয়।
  2. মিশরীয় আরবিতে (ইংরেজি j) (ইংরেজি g) হিসেবে উচ্চারিত হয়। এই পরিবর্তন ১৯শ ও ২০শ শতাব্দীতে ঘটেছে। দেখুন Izre'el ও Raz 1996, পৃ. 153.

তথ্যসূত্র

  1. Rabbat 1996, পৃ. 53
  2. Bloom 2007, পৃ. 104
  3. Blair 2000, পৃ. 507
  4. Hitti 1973, পৃ. 114
  5. Creswell 1952, পৃ. 36
  6. Dodge 1961, পৃ. 5
  7. Summerfield, Devine এবং Levi 1998, পৃ. 9
  8. Williams 2002, পৃ. 151
  9. Petry ও Daly 1998, পৃ. 139
  10. Yeomans 2006, পৃ. 52
  11. Yeomans 2006, পৃ. 53
  12. Daftary 1998, পৃ. 96
  13. Dodge 1961, পৃ. 6–7
  14. Daftary 1998, পৃ. 95
  15. Behrens-Abouseif 1992, পৃ. 58
  16. Creswell 1952, পৃ. 37
  17. Summerfield, Devine এবং Levi 1998, পৃ. 10
  18. Rabbat 1996, পৃ. 56
  19. Behrens-Abouseif 1992, পৃ. 60
  20. Dodge 1961, পৃ. 36
  21. Dodge 1961, পৃ. 40–41
  22. Dodge 1961, পৃ. 40
  23. Lulat 2005, পৃ. 77
  24. Creswell 1952, পৃ. 37–38
  25. Rabbat 1996, পৃ. 57
  26. Rabbat 1996, পৃ. 58
  27. Rabbat 1996, পৃ. 59
  28. Winter 2004, পৃ. 115
  29. Winter 2004, পৃ. 12
  30. Winter 2004, পৃ. 14
  31. Rabbat 1996, পৃ. 59–60
  32. Rabbat 1996, পৃ. 49–50
  33. Rabbat 1996, পৃ. 60–61
  34. Abu Zayd, Amirpur এবং Setiawan 2006, পৃ. 36
  35. Rahman 1984, পৃ. 36
  36. Heyworth-Dunne 1938, পৃ. 681
  37. Winter 2004, পৃ. 120
  38. Winter 2004, পৃ. 121
  39. Raymond 2000, পৃ. 293
  40. Watson 2003, পৃ. 13–14
  41. Rabbat 1996, পৃ. 61
  42. Dwyer 2008, পৃ. 380
  43. Watson 2003, পৃ. 14
  44. McGregor 2006, পৃ. 43
  45. Dwyer 2008, পৃ. 403
  46. Dwyer 2008, পৃ. 404
  47. Richmond 1977, পৃ. 25
  48. Asprey 2000, পৃ. 293
  49. Flower 1976, পৃ. 27
  50. Summerfield, Devine এবং Levi 1998, পৃ. 11
  51. Petry ও Daly 1998, পৃ. 148
  52. Raymond 2000, পৃ. 312
  53. Shillington 2005, পৃ. 199
  54. Rabbat 1996, পৃ. 62
  55. Summerfield, Devine এবং Levi 1998, পৃ. 12
  56. Rabbat 1996, পৃ. 63
  57. Abu Zayd, Amirpur এবং Setiawan 2006, পৃ. 19
  58. Rahman 1984, পৃ. 64
  59. Voll 1994, পৃ. 183
  60. Goldschmidt 2000, পৃ. 123
  61. Summerfield, Devine এবং Levi 1998, পৃ. 13
  62. Abdo 2002, পৃ. 50–51
  63. Zaman 2002, পৃ. 60
  64. Tibi 2006, পৃ. 173
  65. Zaman 2002, পৃ. 86
  66. Zeghal 2007, পৃ. 110
  67. Abdo 2002, পৃ. 49–50
  68. Zeghal 1999, পৃ. 372
  69. Ghazzal 2005, পৃ. 79
  70. Lulat 2005, পৃ. 79
  71. Binder 1988, পৃ. 340
  72. Abdo 2002, পৃ. 51
  73. Zeghal 1999, পৃ. 374
  74. Zeghal 1999, পৃ. 375
  75. Zeghal 1999, পৃ. 376
  76. Abdo 2002, পৃ. 52
  77. Aburish 2004, পৃ. 200
  78. Shillington 2005, পৃ. 478
  79. Aburish 2004, পৃ. 88
  80. Abdo 2002, পৃ. 31
  81. Abdo 2002, পৃ. 54
  82. Barraclough 1998, পৃ. 239–240
  83. Barraclough 1998, পৃ. 242–243
  84. Rahman 1984, পৃ. 31
  85. Tibi 2006, পৃ. 165
  86. Zeghal 2007, পৃ. 123
  87. Brown 2011, পৃ. 10
  88. Brown 2011, পৃ. 11–15
  89. Rabbat 1996, পৃ. 50
  90. Rabbat 1996, পৃ. 45
  91. Rabbat 1996, পৃ. 46
  92. Rabbat 1996, পৃ. 47–48
  93. Rabbat 1996, পৃ. 51
  94. Holt, Lambton এবং Lewis 1977, পৃ. 713
  95. Rivoira ও Rushforth 1918, পৃ. 154
  96. Behrens-Abouseif 1992, পৃ. 59
  97. Petersen 2002, পৃ. 45
  98. Dodge 1961, পৃ. 3–4
  99. Rabbat 1996, পৃ. 64
  100. Abdo 2002, পৃ. 45
  101. Rabbat 1996, পৃ. 47
  102. Dodge 1961, পৃ. 19–22
  103. Dodge 1961, পৃ. 31
  104. Shillington 2005, পৃ. 438
  105. Petry ও Daly 1998, পৃ. 312
  106. Yeomans 2006, পৃ. 56
  107. Holt, Lambton এবং Lewis 1977, পৃ. 731
  108. Creswell 1959, পৃ. 253
  109. Creswell 1959, পৃ. 253–254
  110. Yeomans 2006, পৃ. 55
  111. Yeomans 2006, পৃ. 54
  112. Russell 1962, পৃ. 185
  113. Gottheil 1907, পৃ. 503
  114. Beattie 2005, পৃ. 103

আরও পড়ুন

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.