হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান

হুজাইফার পিতা হুসাইল ছিলেন মূলতঃ মক্কার বনী "আবস" গোত্রের লোক। ইসলামপূর্ব যুগে তিনি নিজ গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে মক্কা থেকে পালিয়ে ইয়াসরিবে আশ্রয় নেন ।এবং সেখানে বনী আবদুল আশহাল গোত্রের এক কন্যা রাবাহ বিনতু কাব কে বিয়ে করেন ।বনি আবদুল আশহাল গোত্রের আদি সম্পর্ক মূলত ইয়ামানের সাথে তাই তার পুত্রের নামকরণ হয় হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান ।[5][7][8]

হুজাইফা ও তার পিতা রাইরে থেকে মদিনার ফেরার পথে কুরাইশরা তাদের পথ আগলে দাড়ায় ।এবং এই অঙ্গীকারনামায় তাদের পথ ছেড়ে দেয় যে তারা মদিনায় পৌঁছে যুদ্ধে মুহাম্মদকে কোন সহযোগিতা করবে না ।এই ওয়াদা পালনার্থে তারা দুজন বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি ।[5][8][11][12][13]

হুজাইফা উহুদ যুদ্ধে তার পিতার সাথে যোগদান করেন। তিনি দারুণ সাহসের সাথে যুদ্ধ করেন এবং নিরাপদে মদীনায় ফিরে আসেন। তবে তার বৃদ্ধ পিতা শাহাদাত বরণ করেন। উহুদ যুদ্ধের সময় বার্ধক্যে জনিত কারণে তার পিতা আল-ইয়ামান ও সাবিত ইবন ওয়াকশ দুর্গ পাহারার জন্য রেখে যাওয়া হয় । যুদ্ধ যখন তীব্র আকার ধারণ করে তখন তারা দুজনও যুদ্ধের জন্য বের হয়ে যায় । সাবিত ইবনে ওয়াকশ কুরাইশ বাহিনীরহাতে নিহত হন এবং হুজাইফার পিতা যুদ্ধের ভিড়ের মধ্যে না চেনার কারণে মুসলমান বাহিনীর হাতে নিহত হন । হুজাইফা তখন তার পিতাকে চিনতে পেরে চিৎকার করলেও কেও তার ডাক শুনেনি ।[14] পরবর্তীতে রাসূল(সা.) তার পিতার রক্তমূল্য দিতে চাইলে তিনি রাসুলের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে তা গ্রহণ করেননি ।[15][16][17]

হুজাইফা ইবন ইয়ামান খন্দক যুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ গুপ্তচরের ভূমিকা পালন করেন। খন্দকের যুদ্ধের সময় পরিবেশের ব্যপক বিপর্যয় দেখা দিলো ।কুরাইশ ও মুসলিম উভয় দল থেকেই বহু মানুষ প্রস্থান করতে লাগলো কেননা তখন প্রচণ্ড শীত পরছিল,বাতাস হচ্ছিলো যে রান্না করা সম্ভব ছিলনা ।চারিদিকে ছিলো ঘোর অন্ধকার ।[18] এমন পরিস্থিতিতে কেওই তাবুর বাইরে বের হয়ে কুরাইশদের খবর আনতে রাজি হচ্ছিলো না । তখন রাসুল এই দায়িত্ব হুজাইফা ইবনুল ইয়ামানকে দিলেন । হুজাইফা সেই দায়িত্ব নিস্থার সাথে পালন করেন,কুরাইশ ও আবু সুফিয়ান বাহিনীর সমস্ত খবর তিনি নিয়ে আসেন ।রাসুল(সঃ) তার প্রতি খুশি হন ।[19][20][21][22][23] । খন্দক পরবর্তী রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় বা তার পরের সকল অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।

হযরত রাসুলে কারীমের সা. ওফাতের পর তিনি ইরাকে বসতি স্থাপন করেন। তারপর বিভিন্ন সময় কূফা, নিস্সীবীন ও মাদায়েনে বসবাস করেন। নিস্সীবীনের ‘আল-জাযীরা’ শহরে একটি বিয়েও করেন।[24] হযরত হুজাইফা পারস্যের নিহাওয়ান্দ, দাইনাওয়ার, হামজান, মাহ্ রায় প্রভৃতি অঞ্চল জয় করেন এবং গোটা ইরাক ও পারস্যবাসীকে কুরআনের এক পাঠের ওপর সমবেত করেন ।[8][25]

১৮ হিজরী মতান্তরে ২২ হিজরীতে নিহাওয়ান্দের ওপর সেনা অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় ।[28] নিহাওয়ান্দে ছিল মূলত একটি অগ্নি উপাসনা কেন্দ্র । এই নিহাওয়ান্দের যুদ্ধে পারসিক সৈন্যসংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৫০ হাজার ও মুসলিম সৈন্য ছিলো ৩০ হাজার । খলীফা উমার রা. মুসলিম বাহিনীর অধিনায়ক নিয়োগ করেন হযরত [[নুমান ইবনে মুকাররিন]]কে। তারপর তিনি কূফায় অবস্থানরত হযরত হুজাইফাকে একটি চিঠিতে সেখান থেকে একটি বাহিনী নিয়ে নিহাওয়ান্দের দিকে যাত্রা করার জন্য নির্দেশ দেন। এদিকে খলীফা মুসলিম মুজাহিদদের প্রতি জারি করা এক ফরমানে বললেন, চারিদিক থেকে মুসলিম সৈন্যরা যখন এক স্থানে সমবেত হবে তখন প্রত্যেক স্থান থেকে আগত বাহিনীর একজন করে আমীর থাকবে। আর গোটা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হবেন, নু’মান ইবন মুকরিন। নু’মান যদি শাহাদাত বরণ করেন, হুজাইফা হবেন পরবর্তী আমীর। আর তিনি শহীদ হলে আমীর হবেন জারীর ইবন আবদিল্লাহ আল-বাজালী। এভাবে খলীফা একের পর এক সাতজন সেনাপতির নাম ঘোষণা করেন। হযরত নু’মান নিহাওয়ান্দের অদূরে শিবির স্থাপন করে বাহিনীর দায়িত্ব বন্টন করেন। সেখানে হযরত হুজাইফাকে দক্ষিণ ভাগের সেনাপতি নিয়োগ করা হয় ।[29]

প্রচন্ড যুদ্ধের এক পর্যায়ে নুমান ইবনে মুকাররিন শাহাদত বরন করেন,সেনাপতি নির্বাচিত হন হুজাইফা । তিনি পার্শ্ববর্তী লোকদেরকে নু’মানের শাহাদাতের খবর প্রচার করতে নিষেধ করে দিলেন। আর সাথে সাথে নু’মানের স্থলে ভাই নু’য়াঈমকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। যাতে নু’মানের শাহাদাতে যুদ্ধের ওপর কোন রকম প্রভাব না পড়ে। হুজাইফা বিজ্ঞতা ও রণ কৌশলীতে মুসলমান বিজয় লাভ করলো ।[30]

ইবন আসাকির বলেন,নিহাওয়ান্দের শাসক বাৎসরিক ৮ লক্ষ দিরহাম কর দানের অঙ্গীকার করে হযরত হুজাইফা(রাঃ) এর সাথে সন্ধি করেন। নিহাওয়ান্দের পর তিনি বিনা বাধায় "দায়নাওয়ার" এর বিদ্রোহী বাহিনীকে দমন করতে সক্ষম হন । তারপর হযরত হুজাইফা বিনা যুদ্ধে একে একে মাহ্, হামাজান, ও রায় জয় করেন।[31]

নিহাওয়ান্দের প্রধান ধর্মগুরু হতে প্রাপ্ত পারস্য সম্রাটের অতিমূল্যবান মনি-মুক্তা বিক্রি করে ৪ কোটি দিরহামে মুদ্রা অর্জন করেন । এবং এর সমস্ত অর্থ সৈন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দেন ।[32]

মাহ্- এর অধিবাসীদের সাথে হযরত হুজাইফা রা. যে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তা হলঃ

‘‘হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান মাহবাসীদের জান, মাল ও বিষয়- সম্পত্তির এ নিরাপত্তা দান করছেন যে, তাদের ধর্মের ব্যাপারে কোন রকম হস্তক্ষেপ করা হবেনা। এবং ধর্ম ত্যাগের জন্য কোনরূপ জোর-জবরদস্তি করা হবে না। তাদের প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যতদিন বাৎসরিক জিযিয়া আদায় করবে, পথিকদের পথের সন্ধান দেবে, পথ চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, এখানে অবস্থানরত মুসলিম সৈনিকদের একদিন এক রাত আহার করাবে এবং মুসলমানদের শুভাকাংখী থাকবে, ততদিন তাদের এ নিরাপত্তা বলবৎ থাকবে। আর যদি তারা এ অঙ্গীকার ভঙ্গ করে বা তাদের আচরণে পরিবর্তন দেখা দেয়, তাহলে তাদের কোন দায়-দায়িত্ব মুসলমানদের ওপর থাকবে না।’’ হিজরী ১৯ সনের মুহাররাম মাসে এ চুক্তিপত্রটি লেখা হয় এবং তাতে কা’কা’, নু’য়াইম ইবন মুকাররিন ও মুয়ায়িদ ইবন মুকাররিন সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর দান করেন ।[33]

উল্লেখিত অভিযানসমূহ শেষ করে হযরত হুজাইফা তাঁর পূর্বের ভূমি বন্দোবস্তদানকারী অফিসার পদে ফিরে যান।[34]

বালাজুরীর বর্ণনা মতে হিজরী ২২ সনে আজারবাইজান অভিযানে হযরত হুজাইফা গোটা বাহিনীর পতাকাবাহী ছিলেন। তিনি নিহাওয়ান্দ থেকে আজারবাইজানের রাজধানী আরদাবীলে পৌঁছেন। এখানকার শাসক মাজেরওয়ান, মায়মন্দ, সুরাত, সাব্জ, মিয়াঞ্চ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বাহিনী সংগ্রহ করে প্রতিরোধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অতঃপর বাৎসরিক ৮ লাখ দিরহাম জিযিয়া দানের শর্তে সন্ধি করে। হযরত হুজাইফা সেখান থেকে মুকাম ও রুজাইলার দিকে অগ্রসর হন এবং বিজয় লাভ করেন। ইত্যবসরে মদীনার খলীফা উমার(রাঃ) থেকে তাঁর কাছে চিঠি পৌঁছে,তাঁর স্থলে উতবা ইবন ফারকাদকে নিয়োগ করা হয়েছে।[35]

হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে মাদায়েন বিজিত হওয়ার পর উমর(রাঃ) কিছু সৈন্য মাদায়েনে রেখে গিয়ে তাকে মাদায়েনের প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন । হুজাইফা তাঁদের বসবাসের জন্য পরিবেশ উপযোগি একটি জায়গা নির্বাচন করেন সেই স্থানই আজকে কুফা শহর নামে পরিচিত ।[36]

হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী(রহ.) থেকে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়,হুজাইফা ইবনুল ইয়ামন রা. মাদায়েনের প্রতিনিধি থাকাকালে এক রূপবতী এক জিম্মি ইহুদী নারীকে বিয়ে করেন । উমার(রা.) তাঁকে উক্ত মহিলা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার নির্দেশ দেন। [37]

মাদায়েনে ওয়ালী থাকাকালে একবার জনতার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষয়ে তিনি বলেনঃ ‘হে জনমন্ডলী! তোমরা তোমাদের দাসদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখ। দেখ, তারা কোথা থেকে কিভাবে উপার্জন করে তোমাদের নির্ধারিত মজুরী পরিশোধ করছে। কারণ, হারাম উপার্জন খেয়ে দেহে যে গোস্ত তৈরী হয় তা কক্ষনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আর এটাও জেনে রাখ, মদ বিক্রেতা, ক্রেতা ও তাঁর প্রস্তুতকারক, সকলেই তা পানকারীর সমান।[38]