সৌরজগতের জন্ম ও বিবর্তন
আমাদের এই সৌরজগতের জন্ম ও বিবর্তন আনুমানিক ৪৫০ কোটি বছর পূর্বে কোন বিরাট আণবিক মেঘের একটি ছোট অংশের মহাকর্ষীয় ধ্বসের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।[1] ধ্বসে পড়া অংশের অধিকাংশ ভরই কেন্দ্রের একটি ছোট স্থানে কেন্দ্রীভূত হয়ে সূর্য গঠন করে, বাকি অংশগুলো চ্যাপ্টা হয়ে জন্ম দেয় একটি ভ্রূণগ্রহীয় চাকতির যা থেকে সৌরজগতের সকল গ্রহ, প্রাকৃতিক উপগ্রহ, গ্রহাণু এবং অন্যান্য ছোট ছোট বস্তু গঠিত হয়।

নীহারিকা অনুকল্প নামের এই বহুল পরিচিত ও সর্বজনগৃহীত মডেলটি প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন Emanuel Swedenborg, ইমানুয়েল কান্ট এবং পিয়ের সিমোঁ লাপ্লাস, সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে। পরবর্তীতে বিজ্ঞানের অনেকগুলো শাখার সক্রিয় অংশগ্রহণে মডেলটির উন্নতি ঘটেছে যার মধ্যে রয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব এবং গ্রহ বিজ্ঞান। ১৯৫০-এর দশকে মহাকাশ যুগের সূচনা ঘটা এবং ১৯৯০-এর দশকে বহির্গ্রহ আবিষ্কৃত হতে শুরু হওয়ার পর অনেকেই এই মডেলের পুনর্বিশ্লেষণ বা সমালোচনা করছেন। নতুন আবিষ্কারগুলোকেও এই অনুকল্পের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় কিনা সেটিই তাদের প্রশ্ন।
প্রাথমিক অবস্থা থেকে সৌরজগৎ অনেক বিবর্তিত হয়েছে। কোন গ্রহের চারদিকে আবর্তনরত গ্যাস ও ধূলিকনার চাকতি থেকে তার উপগ্রহ তৈরি হয়ে থাকতে পারে, আবার কিছু উপগ্রহ ভিন্ন জায়গায় উৎপন্ন হয়ে পরবর্তীতে গ্রহের মহাকর্ষীয় বন্ধনে ধরা দিতে পারে। কিছু উপগ্রহ আবার হতে পারে বিশাল কোন সংঘর্ষের ফল, যেমন পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ সংঘর্ষের ফলে জন্ম নিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। সৌরজগতের বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে সংঘর্ষ একটি স্বাভাবিক ঘটনা যা এখনও বিভিন্ন স্থানে ও সময়ে ঘটে চলেছে, এসব সংঘর্ষ সৌরজগতের বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়। অনেক সময় গ্রহের অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে, এক গ্রহ আরেক গ্রহের সাথে স্থান বদল করেও থাকতে পারে।[2] সৌরজগতের আদি বিবর্তনের অন্যতম কারণ হিসেবে বর্তমানে এই গ্রহীয় অভিপ্রয়াণকেই দায়ী করা হয়।
আজ থেকে প্রায় ৫০০ কোটি বছর পর সূর্য শীতল হয়ে যাবে, তার এনভেলপ তথা বহিরাংশ বহুগুণ সম্প্রসারিত হওয়ায় ব্যাস বর্তমানের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়ে যাবে এবং সে একটি লোহিত দানবে পরিণত হবে। একসময় বহিরাংশটি সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি গ্রহ নীহারিকা তৈরি করবে এবং কেন্দ্রভাগটি শ্বেত বামন নামক এক ধরনের নাক্ষত্রিক অবশিষ্টাংশে পরিণত হবে। সুদূর ভবিষ্যতে সূর্যের কাছ দিয়ে অতিক্রমকারী তারাগুলো তার সাথে তার ভ্রমণসঙ্গী গ্রহগুলোর বন্ধনকে কমিয়ে দেবে। এর ফলে কিছু গ্রহ ধ্বংস হয়ে যাবে, কিছু আবার আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমে ছিটকে পড়বে। ধারণা করা হয় কয়েক ট্রিলিয়ন বছর পর সূর্যের অবশিষ্টাংশের চারদিকে আর কোন গ্রহই থাকবে না।[3]
গবেষণার ইতিহাস

বিশ্বজগতের উদ্ভব এবং পরিণতি নিয়ে বহুকাল পূর্বের অনেক রচনাতেও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সেই আলোচনাগুলোকে সৌরজগতের একটি মডেলের সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা প্রাচীন কালে কখনোই করা হয়নি, কারণ বর্তমানে আমরা সৌরজগৎ বলতে যা বুঝি সেটির অস্তিত্বই তখন মানুষের জানা ছিল না। সৌরজগতের জন্ম ও বিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে প্রথম বড় পদক্ষেপ ছিল সৌরকেন্দ্রিক মতবাদের প্রতিষ্ঠা যাতে বলা হয়েছিল, সূর্য মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত যাকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘোরে। গ্রিক দার্শনিক আরিস্তারকোস এ ধরনের একটি ধারণা আনুমানিক ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে উত্থাপন করলেও ধারণাটি গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করে মাত্র অষ্টাদশ শতকে। Solar System শব্দ দুটো প্রথম কোন রচনায় ব্যবহার করা হয়েছিল ১৭০৪ সালে।[4]
সৌরজগতের উৎপত্তি বিষয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হচ্ছে নীহারিকা অনুকল্প যা ঊনবিংশ শতকে Emanuel Swedenborg, ইমানুয়েল কান্ট এবং পিয়ের সিমোঁ লাপ্লাস পরষ্পর স্বাধীনভাবে প্রস্তাব করেছিলেন। কখনো এটি বিপুল সমর্থন পেয়েছে, কখনো আবার হয়েছে তীব্র সমালোচিত। সবচেয়ে বড় সমালোচনা ছিল, গ্রহদের তুলনায় সূর্যের কৌণিক ভরবেগ এতো কম কেন তা অনুকল্পটি ব্যাখ্যা করতে পারে বলে মনে হতো না।[5] কিন্তু ১৯৮০-র দশকে এমন সব নবীন তারা পর্যবেক্ষণ করা গেছে যারা ঠিক নীহারিকা অনুকল্পের বর্ণনা মতোই ধূলো ও গ্যাসের একটি শীতল চাকতি দিয়ে ঘেরা। এতে অনুকল্পটির গ্রহণযোগ্যতা পুনরায় বৃদ্ধি পেয়েছে।[6]
সূর্য ভবিষ্যতে কিভাবে বিবর্তিত হবে তা জানতে হলে তার শক্তির উৎস সম্পর্কে জানা প্রয়োজন ছিল। আর্থার স্ট্যানলি এডিংটন প্রথম ধারণা করতে পেরেছিলেন যে সূর্যের শক্তি কেন্দ্রীণ সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন হতে পারে।[7] ১৯৩৫ সালে তিনি আরও বলেন, অন্যান্য মৌলিক পদার্থগুলোও তারার অভ্যন্তরে উৎপন্ন হতে পারে।[8] ফ্রেড হয়েল এই গবেষণাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে বলেন, লোহিত দানব তারার অভ্যন্তরে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের চেয়ে ভারী মৌল উৎপন্ন হয়। লোহিত দানব যখন তার বহিরাংশ ছুঁড়ে ফেলে তখন অভ্যন্তরের ভারী মৌলগুলো আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং অন্যান্য তারা জগৎ গঠনে ভূমিকা রাখে।[8]
তথ্যসূত্র ও পাদটীকা
- Bouvier, Audrey and Meenakshi Wadhwa, "The age of the solar system redefined by the oldest Pb-Pb age of a meteoritic inclusion". Nature Geoscience, Nature Publishing Group, a division of Macmillan Publishers Limited. Published online 2010-08-22, retrieved 2010-08-26, doi: 10.1038/NGEO941.
Date based on oldest inclusions found to date in meteorites, thought to be among the first solid material to form in the collapsing solar nebula. - R. Gomes, H. F. Levison, K. Tsiganis, A. Morbidelli (২০০৫)। "Origin of the cataclysmic Late Heavy Bombardment period of the terrestrial planets" (PDF)। Nature। 435 (7041): 466–9। doi:10.1038/nature03676। PMID 15917802। বিবকোড:2005Natur.435..466G।
- Freeman Dyson (জুলাই ১৯৭৯)। "Time Without End: Physics and Biology in an open universe"। Reviews of Modern Physics। 51 (3): 447। doi:10.1103/RevModPhys.51.447। বিবকোড:1979RvMP...51..447D। একের অধিক
|কর্ম=
এবং|সাময়িকী=
উল্লেখ করা হয়েছে (সাহায্য) - "Solar system"। Merriam Webster Online Dictionary। ২০০৮। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৪-১৫।
- M. M. Woolfson (১৯৮৪)। "Rotation in the Solar System"। Philosophical Transactions of the Royal Society of London। 313 (1524): 5। doi:10.1098/rsta.1984.0078। বিবকোড:1984RSPTA.313....5W।
- Nigel Henbest (১৯৯১)। "Birth of the planets: The Earth and its fellow planets may be survivors from a time when planets ricocheted around the Sun like ball bearings on a pinball table"। New Scientist। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৪-১৮।
- David Whitehouse (২০০৫)। The Sun: A Biography। John Wiley and Sons। আইএসবিএন 978-0-470-09297-2।
- Simon Mitton (২০০৫)। "Origin of the Chemical Elements"। Fred Hoyle: A Life in Science। Aurum। পৃষ্ঠা 197–222। আইএসবিএন 978-1-85410-961-3।