সাগরময় ঘোষ

সাগরময় ঘোষ (২২ জুন, ১৯১২ - ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯) একজন স্বনামখ্যাত ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক যিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালন করে জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন।[1][2] ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুতে লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত শোকসংবাদে তাকে বাংলার ‘সাহিত্য ব্যাঘ্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। মৃত্যুর কিছু পূর্বে ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে দীর্ঘজীবী বাংলা সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।[3][4]

জীবন বৃত্তান্ত

তার জন্ম ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব বঙ্গে, বর্তমান বাংলাদেশের চাঁদপুরে, ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে জুন তারিখে। চাঁদপুরেই ছিল তাদের পৈতৃক ভিটা। কালক্রমে নদী ভাঙনে হারিয়ে গেছে সেই পৈতৃক ভিটা। তার পিতা কালিমোহন ঘোষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ সহচর। মায়ের নাম মনোরমা দেবী। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শান্তিদেব ঘোষ ছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীতের বিশিষ্ট সাধক এবং ভারতের জাতীয় পণ্ডিত হিসেবে স্বীকৃত। সাগরময় ঘোষ শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেন, তিনি রবীন্দ্রনাথের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। শান্তিনিকেতনে অধ্যয়নকালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে সাহিত্য ও সঙ্গীত, সর্বোপরি শিল্পের প্রতি তার গভীর অনুরাগ জন্মে যা প্রয়াণাবধি তার মানসপ্রতিভাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।[3]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন তিনি। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ’আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে এই পৃথিবীতে জন্মে তুমি কী পেলে? আমার উত্তর রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথ।’ দেশ পত্রিকায় যোগদানের তার ওপর অর্পিত প্রথম দায়িত্ব ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে একটা কবিতা আর গল্প সংগ্রহ করা। সেটি ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে কবিগুরুর মৃত্যুর কয়েক মাস আগে মাত্র। যে গল্পটি তিনি সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন তা হলো শেষ কথা

তিনি ছিলেন একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তানের জনক। গুরুগম্ভীর স্বভাবের মানুষ হলেও তিনি ছিলেন ব্যবহারে ছিলেন অমায়িক ও বিনয়ী। ব্যক্তি জীবনে নিয়মনিষ্ঠতা তাকে দিয়েছিল সুস্বাস্থ্য ও প্রসন্নতা। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছড়া কেটে বলেছিলেন, ‘সাগরদাদা আপনি বুড়ো হলেন না বিলকুল,/ পঁচাত্তরেও তরতাজা মন, ভ্রমরকৃষ্ণ চুল’। [5]

১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি ৮৬ বছর বয়সে সাগরময় ঘোষ মারা যান। তার মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য হারায় এক অসামান্য সম্পাদককে।

দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় দায়িত্ব

তার জীবনের প্রারম্ভ ঘটনার ঘনঘটায় পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য, কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে কারাবরণ, সরকারি চাকরি, বেঙ্গল ইমিউনিটি এবং দু-একটি পত্রিকায় কিছুকাল কাজ করার পর তিনি ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে দেশ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত এক নাগাড়ে তিনি এ সাহিত্যমুখী পত্রিকাটির হাল দৃঢ়তা এবং দক্ষতার সঙ্গে ধরে রেখেছিলেন। ঔপন্যাসিক সুবোধ ঘোষের তিলাঞ্জলি, সমরেশ বসুর দুটি উপন্যাস বিবর এবং প্রজাপতি সহ নানা বিতর্কিত রচনা মুদ্রণের দায়ে তিনি অভিযুক্ত হলেও লক্ষ্যে একাগ্র এবং কাজে একনিষ্ঠ থেকেছেন, থেকেছেন নিরাপোষ। নিজে অন্তরালে থেকে নতুন নতুন লেখক-কবি-কথাসাহিত্যিককে আবিষ্কার করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দীর্ঘ দিন একই পদের দায়িত্ব পালন করেও তিনি জ্বরাগ্রস্ত হন নি, বরং সমকালীনতাকে আশ্রয় করে পত্রিকা সাজানোর কাজটি করে গেছেন, দেশকে রেখেছেন চির-আধুনিক। তার সম্বন্ধে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘সাগরদাদা আপনি বুড়ো হলেন না বিলকুল/ পঁচাত্তরেও তরতাজা মন, ভ্রমরকৃষ্ণ চুল’। তার রাশভারী ব্যক্তিত্ব এবং মেজাজের নবীনতা তাকে দিয়েছে তুলনারহিত সাফল্য।[1]

দেশ পত্রিকার সঙ্গে সাগরময় ঘোষ-এর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিলো ৫০ বছরের। সাগরময় ঘোষের এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, দেশ পত্রিকায় যোগ দিয়ে প্রথম যে এসাইনমেন্টটি করেছিলাম তা ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে একটা কবিতা আর গল্প সংগ্রহ করা। সেটা কবিগুরুর মৃত্যুর কয়েক মাস আগে মাত্র। স্বদেশি আন্দোলন করার জন্য একবার জেলে গিয়েছিলেন তিনি। তখন জেলখানায় আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অশোক সরকারের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তিনিও তখন জেল খাটছিলেন। তাকে তিনটি পদের কথা বলা হয়েছিল। তিনি দেশ পত্রিকায় চাকরির কাজ বাছাই করেছিলেন। [6][7]

সাহিত্যকৃতি ও প্রকাশনা

পত্রিকার সম্পাদনায় একনিষ্ঠ হলেও নিজের লেখালিখির বিষয়ে উদাসীন ছিলেন সাগরময় ঘোষ। লেখালেখির চেয়েও তিনি সাহিত্যের আড্ডায় অনেক সময় ব্যয় করতে পছন্দ করতেন। এ কারণে দীর্ঘ জীবনের তুলনায় তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা কম।

ক্ষিতীশ সরকার জলসা পত্রিকার জন্য সাগরময় ঘোষের লেখা চেয়েছিলেন। এর উত্তরে তিনি প্রথমবারের মতো লিখতে শুরু করেন্ তার লেখা প্রতি মাসে ‘সম্পাদকের বৈঠকে’ শিরোনামে তিন বছর একাদিক্রমে মুদ্রিত হয়েছে। এভাবেই তার লেখক জীবনের গোড়াপত্তন। অতঃপর কানাইলাল সরকার জলসা পত্রিকা প্রকাশিত নিবন্ধগুলো ১৩৬৮ বঙ্গাব্দে গ্রন্থাকরে প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থটি একজন দক্ষ গদ্যশিল্পীর রচনা বলে স্বীকৃত।

তার লেখক হওয়া বিষয়ে সাগরময় ঘোষ বলেছেন, ‘লেখক হবার দুর্মতি আমার হয়েছিল শ্রদ্ধেয় শিল্পীস্রষ্টা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্ররোচনায়।’ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় একবার প্রশ্ন করেছিলেন, “সাগর কি লেখক? সে কি এক লাইন কখনও কিছু লিখেছে যে তাকে লেখক শ্রেণীভুক্ত করে আমন্ত্রণ জানাতে হবে?”[8]

তিনি দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্পের চার খণ্ড সংকলন গ্রন্থের সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে:

  • পরম রমণীয়
  • সম্পাদকের বৈঠকে
  • এক পেরেকের কাহিনী
  • দণ্ডকারণ্যের বাঘ
  • হীরের নাকছাবি
  • রচনা সংগ্রহ
  • শত বর্ষের শত গল্প
  • অনেক দিনের অনেক কথা

সম্মাননা

১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ড. বিধান রায়কে নিয়ে লেখা একটি পেরেকের কাহিনী গ্রন্থের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে প্রথমবারের মতো ‘নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় পুরস্কার’-এ ভূষিত করে। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সর্বোচ্চ সম্মাননা দেশিকোত্তম-এ ভূষিত করে।[9]

তথ্যসূত্র

  1. আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ-১
  2. আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ-২
  3. Bengal's literary tiger
  4. আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ-৩
  5. কড়চা
  6. http://www.bd-pratidin.com/various/2014/09/12/29836
  7. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৩ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জানুয়ারি ২০১৭
  8. নাজমুস সাকিব রহমান লিখিত ‘হীরের নাকছাবি ও অন্যান্’য
  9. আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ-৩

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.