রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক মতাদর্শ
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারাটি অত্যন্ত জটিল। তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেন ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করেন।[1][2][3] ১৮৯০ সালে প্রকাশিত "মানসী" কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়।[4] হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ ও পরবর্তীকালের বিভিন্ন বিবরণী থেকে জানা যায় যে রবীন্দ্রনাথ গদর ষড়যন্ত্রের কথা শুধু জানতেনই না, বরং এই ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন।[5] অন্যদিকে ১৯২৫ সালের একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে "চরকা-সংস্কৃতি" বলে বিদ্রুপ করে রবীন্দ্রনাথ কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন।[6] ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার চোখে ছিল "আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলির রাজনৈতিক উপসর্গ"। এই কারণে বৈকল্পিক ব্যবস্থা হিসেবে তিনি বৃহত্তর জনসাধারণের স্বনির্ভরতা ও বৌদ্ধিক উন্নতির ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। ভারতবাসীকে অন্ধ বিপ্লবের পন্থা ত্যাগ করে বাস্তবসম্মত উপযোগমূলক শিক্ষার পন্থাটিকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান।[7][8]

এই ধরনের মতবাদ অনেককেই বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ১৯১৬ সালের শেষ দিকে সানফ্রানসিকোর একটি হোটেলে অবস্থানকালে একদল ভারতীয় চরমপন্থী রবীন্দ্রনাথকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধের কারণে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।[9] ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার ভূমিকা অবশ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড বর্জন করেন।[10] লর্ড চেমস্ফোর্ডকে তিনি জানালেন, "আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।" রবীন্দ্রনাথের কবিতা "চিত্ত যেথা ভয়শূন্য" ও গান "একলা চলো রে" রাজনৈতিক রচনা হিসেবে জনমানসে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। "একলা চলো রে" গানটি গান্ধীজির বিশেষ প্রিয় ছিল।[11] গান্ধীজির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। অস্পৃশ্যদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজি ও আম্বেডকরের মধ্যে যে বিরোধের সূত্রপাত হয় তার সমাধানেও রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গান্ধীজিও তার "আমরণ" অনশন প্রত্যাহার করে নেন।[12][13]
রবীন্দ্রনাথের "তোতাকাহিনী" গল্পের উপজীব্য একটি খাঁচায় আবদ্ধ পাখি। পাখিটিকে প্রতিদিন বলপূর্বক পুঁথির শুকনো পাতা খাওয়ানো হত। শেষ পর্যন্ত পাখিটি মারা যায়। এই গল্পে লেখক বিদ্রুপ করেন বিদ্যালয়ের মুখস্তসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থাকেই।[14][15] ১৯১৭ সালের ১১ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা বারবারা ভ্রমণের সময় এই সব চিন্তাধারণার ফলস্রুতিতে রবীন্দ্রনাথ এক নতুন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা করেন। শান্তিনিকেতনে তার আশ্রমটিকে দেশ ও ভূগোলের গণ্ডীর বাইরে ভারত ও বিশ্বকে এক সূত্রে বাঁধার এক বিশ্ব পাঠকেন্দ্রে পরিণত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।[9] বিশ্বভারতীη[›] নামাঙ্কিত তার এই বিদ্যালয়ের শিলান্যাস হয় ১৯১৮ সালের ২২ অক্টোবর। ১৯২২ সালের ২২ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয় এই বিদ্যালয়ের।[16] এই বিদ্যালয়ে সনাতন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্রহ্মচর্য ও গুরুপ্রথা-র পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই বিদ্যালয়ের জন্য অর্থসংগ্রহ করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে প্রাপ্ত সম্পূর্ণ অর্থ তিনি ঢেলে দেন এই বিদ্যালয়ের পরিচালনে।[17] শান্তিনিকেতনের অধ্যক্ষ ও শিক্ষক হিসেবেও অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতেন তিনি। সকালে ছাত্রদের ক্লাস নিতেন এবং বিকেল ও সন্ধ্যায় তাদের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করতেন।[18] ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে তিনি একাধিকবার ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণ করেন।[19]
পাদটীকা
- Dutta ও Robinson 1997, পৃ. 127
- Dutta ও Robinson 1997, পৃ. 210
- Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 304
- Scott, J., (2009.), Bengali Flower, পৃষ্ঠা 10 অজানা প্যারামিটার
|1=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য); এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:|তারিখ=
(সাহায্য) - Brown 1948, পৃ. 306
- Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 261
- Dutta ও Robinson 1997, পৃ. 239–240
- Chakravarty 1961, পৃ. 181
- Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 204
- Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 215–216
- Chakraborty, SK; Bhattacharya, P (২০০১), Leadership and Power: Ethical Explorations, Oxford University Press, পৃষ্ঠা 157, আইএসবিএন 0-1956-5591-5
- Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 306–307
- Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 339
- Dutta ও Robinson 1997, পৃ. 267
- Tagore, R; Pal, PB (translator) (২০০৪), "The Parrot's Tale", Parabaas, সংগ্রহের তারিখ ১৩ আগস্ট ২০০৯,
The King felt the bird. It didn't open its mouth and didn't utter a word. Only the pages of books, stuffed inside its stomach, raised a ruffling sound.
অজানা প্যারামিটার|day=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য); অজানা প্যারামিটার|month=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য) - Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 220
- Roy 1977, পৃ. 175
- Chakravarty 1961, পৃ. 27
- Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 221