মাহবুব আনাম

মহবুব আনাম বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলাম লেখক। ১৯৩১ খ্রীস্টাব্দের ২৮ মার্চ ময়মনসিংহের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম হয়। তার পিতা বিখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ। তার অনুজ মাহফুজ আনাম একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক।২০০১ সালের ৯ জুলাই তিনি ৭০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি একাধারে সম্পাদক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও ক্ষুরধার কলাম লেখক হিসেবে বাংলাদেশের সংবাদপত্র পাঠকসমাজে তিনি ছিলেন সুপরিচিত। চল্লিশের দশকে দৈনিক কৃষকের চাঁদেরহাট, দৈনিক নবযুগের ফুলকী, দৈনিক আজাদের মুকুলের মহফিল, দৈনিক ইত্তেহাদের মিতালী মজলিস প্রভৃতি নামে ছোটদের পাতায় তার লেখালেখির সূত্রপাত ঘটে। স্কুলে পড়ার সময় (কলকাতা মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ইংরেজি বিভাগ) তিনি ছাত্র সংসদের সহকারী সেক্রেটারি ও মুসলিম ছাত্রলীগের ইউনিট সেক্রেটারি ছিলেন। এ সময় আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন রশিদ আলীর মুক্তি আন্দোলনে প্রথমবারের মতো কারাবরণ করেন। ১৯৫০-৫১ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ-এ (বর্তমানে মাওলানা আজাদ কলেজ) ছাত্র সংসদ সম্পাদক ও পত্রিকা সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫২-৫৩ সালে তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪-৫৫ সালে নির্বাচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫৫ সালে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাস করেন দর্শন বিভাগ থেকে। এরপর যুক্তরাজ্যে বার-এট-ল অধ্যয়ন এবং লন্ডন স্কুল অব জার্নালিজম থেকে সাংবাদিকতায় প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন। মহবুব আনাম ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট কর্মী। সে সময় তিনি ময়মনসিংহ জেলা তমদ্দুন মজলিস-এর সাধারণ সম্পাদক ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কারাবরণ করেন। একই কারণে মুসলিম হলের সাধারণ সম্পাদক থাকার সময় আবার কারাবরণ করেন। ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষে যুক্তফ্রণ্টের ভারপ্রাপ্ত প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ব্রিটেনে সাংবাদিকতায় প্রশিক্ষণ লাভের পর দেশে ফিরে তিনি ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দেন। বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, বাসস পরিচালনা বোর্ড, চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড, বাংলাদেশ পাবলিক লাইব্রেরি বিশেষ কমিটি, শিল্পকলা একাডেমী প্রকাশনা কমিটি এবং বাংলাদেশ এডিটরস্ কাউন্সিলের সিনিয়র সহসভাপতি ও নির্বাহী সদস্য হিসেবে দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেছেন। অধুনালুপ্ত ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস-এ সম্পাদক পদে বেশ কিছু দিন থেকে ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে অবসর গ্রহণ করেন। কর্মজীবনে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্খার ঊর্ধ্বতন পদে। সমসাময়িক সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে মহবুব আনামের বহু লেখা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ও ইংরেজি, দুই ভাষাতেই তিনি ছিলেন পারদর্শী। পিতার মতো ব্যঙ্গ রচনায় পারদর্শিতার গুণ তিনি অর্জন করেছিলেন। দৈনিক দিনকালে তিনি "যষ্টিমধু" নামে রাজনৈতিক নকশার বিদ্রূপাত্মক কলাম লিখতেন। তার লেখা বহুল আলোচিত গ্রন্থের নাম আমরা বাংলাদেশী আমরা বাঙ্গালী। ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে এটি প্রকাশ করেছিল খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান খোশরোজ কিতাব মহল। বইটিতে তিনি বলেছেন, "জীবন এত ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে যে, বই ছাপার জন্য রচনাগুলো নির্বাচন করার মতো পর্যাপ্ত সময়ই করে উঠতে পারিনি।" পেশাগত ও সাংস্কৃতিক জগতে অনন্য ভূমিকার জন্য তিনি স্বাধীনতা পদক, শেরেবাংলা স্বর্ণপদক, মাওলানা আকরম খাঁ স্বর্ণপদক ইত্যাদি বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮০ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান তাকে স্বহস্তে "ভাষা আন্দোলনের বীর সৈনিক" পুরস্কারে ভূষিত করেন। জীবনের শেষ দিকে রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও কলাম লেখক হিসেবে বেশ ক’টি পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও জীবনচেতনাকে ভালোবাসতেন গভীরভাবে। বেশ কিছু দিন অসুস্খ থাকার পর ২০০১ সালের ৯ জুলাই ঢাকার মিলেনিয়াম হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন।

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.