বিশ্বনাথ সর্দার
বিশ্বনাথ সর্দার ছিলেন বাংলার নীল বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা তাকে 'বিশে ডাকাত' নামে আখ্যায়িত করেছেন। মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় তাকে মানবদরদী ও কৃষকবীর বলেছেন। তার দানশীলতা ও বীরোচিত চরিত্রের জন্যে 'বাবু' আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। দরিদ্র ও নীলকর দ্বারা শোষিত জনসাধারণের জন্যে রাজনৈতিক ডাকাতির পথ অবলম্বন করেছিলেন। অনেকের কাছে তিনি নীল বিদ্রোহের প্রথম শহীদ হিসেবে গণ্য হন।[1][2]
বিশ্বনাথ সর্দার | |
---|---|
জন্ম | ? |
আন্দোলন | নীল বিদ্রোহ |
বিদ্রোহী কর্মকান্ড ও রাজনৈতিক ডাকাতি
১৮০০ শতকের নীল বিদ্রোহের সাংগঠনিক রূপ দেন বিশ্বনাথ সর্দার। স্যামুয়েল ফেডি নামক অত্যাচারী নীলকরের বিরুদ্ধে গ্রামীন হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের একত্র করে বৃহৎ আন্দোলনের আকার দেন।[3] শান্তিপুর এলাকার তাঁত শ্রমিক ও নীলচাষীদের ওপর অত্যাচারে প্রতিশোধ নিতে বিশ্বনাথ শান্তিপুর কুঠি আক্রমন করে লুঠ করেন, ক্রমান্বয়ে চিত্রশালী নীলকুঠি ও নদীয়া ইন্ডিগো কনসার্নের নীলকর স্যামুয়েল ফেডির কুঠি ধ্বংস করার পর নীলকর গোষ্ঠী আতংকিত হয়ে ওঠে। তার একের পর এক সুসংগঠিত আক্রমনে ধুলিস্বাৎ হয়ে যায় খালিবোয়ালিয়া, নিশ্চিন্তপুর, বাঁশবেড়িয়া নীলকুঠি।
নীলকর স্যামুয়েল ফেডির কুঠি তিনি আক্রমন করেন ১৮০৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাত্রে। গ্রামবাসীরা ফেডিকে বন্দী করে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর হলেও বিশ্বনাথের দয়ায় সে রক্ষা পায় এবং প্রতিজ্ঞা করে নীলচাষ বন্ধ করে দেবে। যদিও মুক্তি পেয়ে জেলাশাসক ইলিয়টকে এ সংবাদ জানিয়ে দেয় ফেডি। এর কয়েকদিন পরে ইংরেজ সেনাপতি ব্ল্যাক ওয়ার ও ইলিয়টের পুলিশ বিশ্বনাথকে ঘেরাও করলে সাথীদের প্রান রক্ষার্থে মহানুভব বিশ্বনাথ সংঘর্ষ এড়িয়ে যান ও আত্মসমর্পণ করেন।[4]
বিচার ও ফাঁসি
বিশ্বনাথ ধরা পড়ার পর বিচারের প্রহসন শেষ করতে ব্রিটিশ সরকার খুব দেরি করেনি। তার হত্যা ও হত্যা পরবর্তী কর্মকান্ড ছিল ব্রিটিশ সরকারের বর্বরতার অন্যতম নিদর্শন। তাকে ফাঁসি দেওয়ার পর মৃতদেহটি লোহার খাঁচায় পুরে নদীয়ার কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী আসাননগরের একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয় ও চিল শকুন দিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল। শাসকরা চেয়েছিল বিদ্রোহীর এই বীভৎস পরিনতি দেখে কৃষকেরা শংকিত হোক। বিশ্বনাথ সর্দারের মা পুত্রের কংকালটি জলে ভাসিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন, তাতে কর্তৃপক্ষ কর্নপাত করেনি।[4]
সাহিত্যে ও ইতিহাসে
বিশ্বনাথের জীবনীকার বিমলেন্দু কয়াল তাকে শেরউড বনের রবিনহুডের সাথে তুলনা করেছেন। বামপন্থী ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় বলেছেন "যাহারা একক শক্তিতে বিদেশী নীলকর দস্যুদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পতাকা উড্ডীন করিয়াছিলেন তাহাদের মধ্যে বিশ্বনাথ সর্দার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ স্থানের অধিকারী"। যদিও অনেক ঐতিহাসিক বিশ্বনাথ ও তার সহচর বৈদ্যনাথ কে 'বিশে বদে' ডাকাত নাম দিয়ে হেয় করেছেন, এতদসত্ত্বেও নীল বিদ্রোহের ইতিহাসে ও কৃষক আন্দোলনে তাদের অবদান অপরিসীম।[2][4][5] শিশুসাহিত্যিক ধীরেন্দ্রলাল ধর তার 'নীলকর এলো দেশে' উপন্যাসে শহীদ বিশ্বনাথ সর্দারের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন।[6] শিশুসাহিত্যিক খগেন্দ্রনাথ মিত্র লিখেছেন বিশ্বনাথ ছিলেন বাগদি, তিনি নিজের প্রতাপে বাবু উপাধি ধারণ করেছিলেন।[7]
তথ্যসূত্র
- দ্বিতীয় খন্ড (জানুয়ারি ২০০২)। সংসদ বাংগালী চরিতাভিধান। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ৩৫৬। আইএসবিএন 81-85626-65-0।
- সুপ্রকাশ রায় (১৯৭২)। ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম। কলকাতা: ডি এন বি এ ব্রাদার্স। পৃষ্ঠা ২১১, ২১২।
- নদীয়া জেলা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা সমিতি (১৯৭৩)। স্বাধীনতা সংগ্রামে নদীয়া। নদীয়া জেলা পরিষদ।
- হিমালয়ের চাইতেও ভারী, পিনাকী বিশ্বাস (২০১৪)। সেইসব শহীদেরা। কলকাতা: অতিরিক্ত পাবলিকেশন। পৃষ্ঠা 13–14। আইএসবিএন 978-81-928741-0-4।
- আমিনুল ইসলাম (২০০৯)। হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক বিরোধ ও সমন্বয়। কলকাতা: পত্রলেখা। পৃষ্ঠা ২১৬।
- ধীরেন্দ্রলাল ধর (১৯৯০)। নীলকর এলো দেশে। কলকাতা: দেজ পাবলিশিং।
- খগেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯৯৯)। ডাকাত অমনিবাস। কলকাতা: ভারতী সাহিত্য প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ৮, ২৯।