বিধুশেখর শাস্ত্রী
বিধুশেখর শাস্ত্রী (১০ অক্টোবর ১৮৭৮ - ৪ এপ্রিল ১৯৫৯) ছিলেন একজন প্রখ্যাত পন্ডিত ও হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি।
Bidhushekhar Shastri | |
---|---|
জন্ম | টেমপ্লেট:Birth year Harishchandrapur, Maldah, British India |
মৃত্যু | ১৯৫৭ (বয়স ৭৮–৭৯) |
মালদহ জেলার হরিশ্চন্দ্রপুর গ্রামে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতামহ ছিলেন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ও সাধক। পিতা শ্রী ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্য চেয়েছিলেন বিধুশেখরকে সংস্কৃত পড়াতে।
গ্রামের মধ্য-ইংরেজি বিদ্যালয়ে বিধুশেখরের লেখাপড়ার সূচনা হয়---তারপর টোলে সংস্কৃত শিক্ষা। সতেরো বছর বয়সে হন কাব্যতীর্থ। এই সময়ে রচনা করেছিলেন তিনটি সংস্কৃত কাব্য-- চন্দ্রপ্রভা', 'হরিশ্চন্দ্র-চরিত', আর 'পার্বতী পরিণয়। কাব্যতীর্থ উপাধী লাভের পর বিধুশেখর সংস্কৃতে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য কাশী যান। সেখানে তিনি সান্নিধ্যে আসেন সপ্ত মহামহোপাধ্যায়ের (এঁরা হলেন-- বালশাস্ত্রী, তারারত্ন বাচস্পতি, বিশুদ্ধানন্দ সরস্বতী, কৈলাসচন্দ্র শিরোমণি, রাম-মিশ্র শাস্ত্রী, গঙ্গাধর শাস্ত্রী ও শিবকুমার শাস্ত্রী) জ্ঞানচর্চা ও জীবনসাধনা তাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। কাশীবাস কালেই আঠারো বছর বয়সে রচনা করেন যৌবন বিলাস এবং মেঘদূতের অনুকরণে চিত্তদূত নামে দুখানি কাব্য। বিধুশেখর কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রকাশ করেছিলেন মিত্রগোষ্ঠী পত্রিকা নামে সংস্কৃত সাময়িকী। এই উপলক্ষেই তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনের---যিনি পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে সহকর্মী হন বিধুশেখরের। ১৮৯৫-১৯০৫ প্রায় দশ বছর সংস্কৃত অনুশীলনে কাশীতে কাটান শাস্ত্রীমশাই। শাস্ত্রী উপাধী পান সে সময়েই। ইতিমধ্যে অ্যানি বেসান্ত প্রতিষ্ঠিত থিয়োজফিকাল সোসাইটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নিয়মিত যাতায়াত করতেন সেখানে। ঠিক এই সময়েই তার কাছে পৌঁছয় শান্তিনিকেতনের আহ্বান।
তখন রবীন্দ্রনাথ তার পুত্রের জন্য একজন সংস্কৃতজ্ঞের সন্ধান করছিলেন। কবির অনুমতি নিয়ে ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল শাস্ত্রীমশাইকে শান্তিনিকেতনে আসার আমন্ত্রণ জানান। শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক পরিবেশের বর্ণনা শুনে তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন---সেই আকর্ষণই তাকে এখানকার কাজে যোগ দিতে প্রেরণা যোগায়। তিনি যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্—এই বেদমন্ত্রটির সঙ্কলক। ১৩১১ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে (ইং ১৯০৬) বোলপুরে আসেন বিধুশেখর। তখন রবীন্দ্রনাথের পিতৃবিয়োগ ঘটেছে--ফলে আশ্রমগুরু অনুপস্থিত, অবশ্য ভূপেন্দ্রনাথ আতিথ্যের ত্রুটি রাখেননি--বিধুশেখরের বাসস্থান হিসাবে নির্বাচিত হল আদিকুঠির (বর্তমানে পাঠভবনের শমীন্দ্র পাঠাগার)। শান্তিনিকেতনের কাজে আত্মোৎসর্গ করেছেন নিজেকে। সংস্কৃত সাহিত্যে তার পাণ্ডিত্য রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশেই আবার তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন পালিভাষা চর্চায়---অচিরেই রচনা করলেন পালিভাষার প্রথম ব্যকরণ পালি প্রকাশ। অন্যদিকে ছাত্র-ছাত্রীদের সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া চলতে লাগলো সমান তালে। তার সরল অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা আশ্রমবাসীদের কাছে ছিল আদর্শস্বরূপ।
রবীন্দ্রনাথ ঠিক এই সময়েই উদ্যোগী হলেন বিশ্বভরতী প্রতিষ্ঠায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিদ্যার মিলনক্ষেত্ররূপে বিশ্বভরতী স্থাপিত হবার পর, এর প্রধান রূপকার হলেন বিধুশেখর। তারই প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে বিশ্বভরতীতে প্রবর্তিত হয় তিব্বতী ও চীনা ভাষার চর্চা, বৌদ্ধ দর্শনের পাশাপাশি জরোয়াস্টিয়ান ধর্মশাস্ত্রের অনুশীলন। তার মনীষার স্বীকৃতিস্বরূপ ইংরেজ সরকার তাকে মহামহোপাধ্যায় উপাধী দান করেছেন।
মহাত্মাজির অনুরাগী ছিলেন তিনি--চরকা আন্দোলনের সময় আশ্রমে চরকা কেটেছেন। ১৯৩৪ সালের ১৯ শে নভেম্বর তিনি বিশ্বভারতী থেকে অবসর নিয়ে যোগ দেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-এর সংস্কৃতের আশুতোষ অধ্যাপক পদে। শোনা যায় বিশ্বভারতীর তৎকালীন পরিচালকদের সঙ্গে মতবিরোধ তার অবসর গ্রহণের প্রধান কারণ। বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কায়িক বন্ধন ছিন্ন হলেও আত্মিক বন্ধন আমৃত্যু অটুট রেখেছিলেন বিধুশেখর।
তার ঐকান্তিক অনুরাগ ও আনুগত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৫৭ সালের ১৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বার্ষিক সমাবর্তনে বিশ্বভারতী দেশিকোত্তম উপাধিতে ভূষিত করে তাকে। কলকাতার বাসভবনে ১৯৫৯ সালের ৪ এপ্রিল বিধুশেখর লোকান্তরিত হন।[1]
তথ্যসূত্র
- রবীন্দ্র পরিকর--পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স, কোলকাতা-৭০০০০৯, পৃষ্ঠা : ১৬-২২ দ্রষ্টব্য।