বাসুদেব সার্বভৌম
বাসুদেব সার্বভৌম পঞ্চদশ শতাব্দীর একজন বেদান্ত ও ন্যায়শাস্ত্র বিশারদ ছিলেন।[1][2] বাংলায় প্রথম নব্যন্যায়ের প্রবর্তন করেন। চৈতন্যদেব পুরীতে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তবে তার নাম চির প্রসিদ্ধি লাভ করায় তার রচিত বেদান্তাদি শাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থসমূহ বিলুপ্ত হয়েছে। তার পিতা নরহরি বিশারদ ছিলেন তৎকালীন নদীয়ার একজন বিখ্যাত নৈয়ায়িক পন্ডিত।[2]
শিক্ষা জীবন
তিনি তার পিতার কাছে নব্যন্যায় অধ্যয়ন করেছিলেন। পরবর্তীকালে সেই সময়ের ন্যায় শাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য মিথিলায় যান। তিনি মিথিলার বিখ্যাত পন্ডিত পক্ষধর মিশ্রের নিকটও কিছুদিন ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং তারই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ‘সার্বভৌম’ উপাধি লাভ করেন। তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তিও ছিল। তিনি সম্পূর্ন গঙ্গেশোপাধ্যায়ের চিন্তামণি এবং ন্যায়কুসুমাঞ্জলির কণ্ঠস্থ করেছিলেন। সেই সময় বাংলায় নিরবচ্ছিন্ন নৈয়ায়িকের উদ্ভব হয় নি। ন্যায় শাস্ত্র ও বেদান্ত দর্শন ছাড়াও তিনি স্বয়ং ষড়দর্শনে কৃতবিদ্য ছিলেন। নব্যন্যায়ের টীকা রচনা করলেও বেদান্তেই তার স্বাভাবিক অনুরাগ ছিল।[3]
মিথিলায় বিদ্যালাভ
তৎকালীন সময়ে নব্যন্যায়ের চর্চা মিথিলা ছাড়া অন্য কোথাও তেমন হত না। আর সনাতন ন্যায় শাস্ত্রের থেকে বেরিয়ে নব্যন্যায়ের নতুন চিন্তা ধারণ করাই এক রকম অসম্ভব ছিল। নবদ্বীপে স্মৃতি, ন্যায়, কাব্য, অলঙ্কারের অসামান্য সব চিন্তকেরা নিজেদের গুরুকুল রক্ষা করতে করতেই তখন স্থির করলেন, চিন্তার সাম্রাজ্য বাড়াতেই হবে। কিন্তু মিথিলার পন্ডিতেরা পুঁথি আনতে রাজি ছিলেন না। তাই এমন একজনের প্রয়োজন হলো যিনি পুঁথি পড়ে জ্ঞানের সারটুকু মিথিলা থেকে নিয়ে চলে আসতে পারবেন।
কিংবদন্তি রয়েছে, বাসুদেব সার্বভৌম ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি প্রায় সব পুঁথি কণ্ঠস্থ করে নিয়ে এসেছিলেন। কিংবদন্তি রয়েছে,
“ | একবার তাঁর মা তাঁকে আগুন আনতে পাঠিয়েছিলেন। বালক বাসুদেব চলে যান একটি টোলে। টোলের পণ্ডিত তখন তাঁর পরীক্ষা নেন। তিনি বলেন, যেখানে আগুন জ্বলছে, সেখান থেকে আগুন নিয়ে নিতে। সবাই শিউরে উঠেছিলেন। ছোট বাসুদেব কী করে আগুন থেকে আগুন নেবেন? কিন্তু বাসুদেব জল ঢেলে মাটি কাদা করে পুরু করে সেই কাদা দুই হাতে নিয়ে তার উপরে রাখলেন একটি জ্বলন্ত কাঠ। | ” |
এই ঘটনার পর লোকমুখে তার বুদ্ধির কথা ছড়িয়ে পরে। তারপরেই নবদ্বীপের পণ্ডিতেরা বাসুদেবকেই দায়িত্ব দিলেন মিথিলা থেকে নব্যন্যায় শিখে আসতে। কিন্তু বাসুদেব মিথিলা গেলে, সেখানকার পণ্ডিতেরা তাকে কোনও পুঁথি নবদ্বীপে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেননি। বাসুদেব তখন পুথিগুলি মুখস্থ করে ফেললেন। নবদ্বীপে ফিরলে তার মুখ থেকে তত্ত্বের সার কথা শুনলেন গঙ্গার ধারের বিদ্যানগরীর চিন্তকেরা। শোনা যায়, তারপর থেকে নব্যন্যায় চর্চায় মিথিলাকেও পিছনে ফেলে দেয় নবদ্বীপ।[4]
কর্ম জীবন
তিনি নবদ্বীপে একটি চতুষ্পাঠী খুলে কিছুদিন ন্যায়শাস্ত্রে অধ্যাপনা করেন। কিন্তু চৈতন্যদেবের ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনের কারণে নবদ্বীপে মুসলিম সম্রাটদের অত্যাচার শুরু হলে তিনি পুরীতে চলে যান। সেখানে এক সময় চৈতন্যদেব তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাদের মধ্যে বেদান্তবিষয়ে গভীর আলোচনা হয়। কৃষ্ণদাস চৈতন্যচরিতামৃতের মধ্যলীলার ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে তাদের আলোচনা বিষয়ে লিখেছেন যে, বেদান্তের আলোচনায় চৈতন্যদেব বাসুদেবের মতামতকেই স্বীকার করে নেন। সেই আলোচনায় তিনি যে শ্লোক পাঠ করেছিলেন তাতে তার বেদান্তমতে আসক্তি স্পষ্ট হয়।[3]
পোড়ামা প্রতিষ্ঠা
পনেরো শতাব্দীতে বৃহদ্রথ নামে এক তন্ত্রসাধক ও সিদ্ধ সন্ন্যাসী নবদ্বীপে বাস করতেন। তিনি বনের মধ্যে একটি ঘটে দেবী কালিকাকে স্থাপন করেন। তিনি মারা গেলে তার মন্ত্রশিষ্যের নাতি বাসুদেব সার্বভৌম পূজার দ্বায়িত্ব পান। তিনি বন থেকে দেবীর ঘটটি নিয়ে এসে নবদ্বীপের কেন্দ্রস্থলে একটি বৃক্ষতলে পুনঃস্থাপন করেন এবং সেখানে তার নিজস্ব পরম্পরা বজায় রেখে চতুস্পাঠী প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে নদিয়ার রাজবংশ দেবীর সেবার অনুদান দিতেন। হঠাৎ একদিন বাজ পড়ে প্রচন্ড অগ্নিকাণ্ডে বৃক্ষটি পুড়ে গেলে বাসুদেব সার্বভৌম প্রতিষ্ঠিত দেবীর নাম হয় পোড়ামা।[5]
সাহিত্য রচনা
পুরীর শঙ্করমঠে বেদান্ত প্রকরণ অবৈতমকরন্দের ওপর তার রচিত টিকা গ্রন্থটি রাজেন্দ্রলাল মিত্র আবিষ্কার করে তার বিবরণ মুদ্রিত করেছিলেন। বেদান্তের এই টীকা-গ্রন্থটি উৎকল রাজ্যের সচিবের অনুগ্রহে ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে রচিত হয়েছিল। এছাড়াও তিনি নবদ্বীপে অবস্থানকালে ১৪৬০ - ৮০ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যে তিনি তত্ত্বচিন্তামণির টীকা রচনা করেন। উৎকলে থাকার সময় উৎকলাধিপতি পুরুষোত্তমদেব ও প্রতাপরুদ্রদেবের তিনি সভাপতি ছিলেন (১৪৬৫-১৫৩২)। জনশ্রুতি আছে যে তিনি চৈতন্য সম্বন্ধে অষ্টক, শতক বা সহস্র লিখেছেন। ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুরী ত্যাগ করে বারাণসীতে যান এবং সেখানেই মারা যান।[2][3]
উত্তর পুরুষ ও শিষ্য
তার জ্যেষ্ঠ পুত্র জলেশ্বর বাহিনীপতি মহাপাত্র ভট্টাচার্য ও পৌত্র স্বপ্নেশ্বরাচার্যেরও ন্যায় শাস্ত্রের পন্ডিত ছিলেন। তার শিষ্যদের মধ্যে রঘুনাথ শিরোমণি দেব ছাড়াও ‘অনুমানমণিব্যাখ্যা প্রণেতা কণাদ, রঘুনন্দন ভট্টাচার্য্য, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, চৈতন্যদেব প্রমুখ বিখ্যাত ছিলেন।[2][3]
বহিঃপঠন
https://bn.m.wikisource.org/wiki/পাতা:গোবিন্দ_দাসের_করচা.djvu/১৮১
https://bn.m.wikisource.org/wiki/পাতা:উৎকলে_শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্য.pdf/১২১
তথ্যসূত্র
- Chowdhury, IT Lab Solutions, Debojyoty। "রঘুনাথ শিরোমণি নৈয়ায়িক পন্ডিত ন্যায় শাস্ত্রের প্রবর্তক"। www.dibalok.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০১-০৬।
- বসু, অঞ্জলি; গুপ্ত, সুবোধ চন্দ্র সেন (২০১০)। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান: প্রায় চার সহস্রাধিক জীবনী-সংবলিত আকর গ্রণ্থ. প্রথম খন্ড। Sāhitya Saṃsada। আইএসবিএন 9788179551356।
- "বাসুদেব সার্বভৌম - বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০১-০৬।
- "Latest Bengali News - nabadwip was stated as oxford of the east"। www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০১-০৬।
- "বৈষ্ণব ধাম নবদ্বীপ ও "পোড়া-মা" ভবানী"। www.abasar.net। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০১-০৬।