বংশগতি

বংশগতি হল বাবা-মা হতে সন্তান-সন্ততিতে জীনগত বৈশিষ্ট স্থানান্তরিত হওয়া যার মাধ্যমে বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের অনেক সামঞ্জস্যতা দেখা যায়। জীবের বংশগতি নিয়ে যে শাখায় আলোচনা করা হয় তাকে বলা হয় জেনেটিক্স বা বংশগতিবিদ্যা। মানবদেহে আমরা সবসময় দেখি যে সন্তানের চেহারা বাবা/মায়ের মত হয় ,বা বাবার মত ছেলেমেয়ের চুল, নাক বা শরীরের অন্য যে কোন অংশ বাবা-মা/দাদা-দাদির সাথে মিলে যায়। বংশগতির জন্যই এমনটা হয়ে থাকে।স্বকীয় বৈশিস্ট্যগুলি পরবর্তী প্রজন্মে প্রায় অবিকলভাবে স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। এই কারনেই বংশানুক্রমে প্রজাতির বৈশিস্ট্য বজায় থাকে।

বংশগতিবস্তু ( ডি.এন.এ)
বংশগতিবস্তু ( ক্রোমোসোম)

বংশগতির উপাদান

বংশগতির এই ধারা নিয়ন্ত্রিত হয় জীন দ্বারা। কোন প্রজাতির জিনোমে (জিনোম হল যেখানে বংশগতির উপাদান থাকে, যেমন ক্রোমোসোম/ ডি.এন.এ) বিভিন্ন বৈশিস্টের জীন থাকে।মাতাপিতার বৈশিস্ট্যাবলি তাদের সন্তানসন্ততিতে এসব উপাদানের মাধ্যমে সঞ্চারিত হয় বলে এসব কে বলে বংশগতিবস্তু।

ক্রোমোজোম

বংশগতির প্রধান উপাদান হল ক্রোমোজোম। বিজ্ঞানী স্ট্রাসবুরগার ১৮৭৫ সালে সর্বপ্রথম এটি আবিস্কার করেন। এটি কোষের নিউক্লিয়াসের নিউক্লিওপ্লাজমে পাওয়া যায় এবং ক্রোমাটিন তন্তু দ্বারা গঠিত।প্রজাতির বৈশিস্ট্যভেদে ২-১৬০০ পর্যন্ত ক্রোমোজোম পাওয়া যায়। সাধারনত দৈর্ঘ্য ৩.৫ থেকে ৩০ মাইক্রন এবং প্রস্থ ০.২-২.০ মাইক্রন হয়ে থাকে (১ মাইক্রন=১/১০০০ মিমি)।ক্রোমোজোমের কাজ হল মাতা-পিতা থেকে জীন সন্তানসন্তুতিতে বহন করা।

ক্রমোজোম হল ডিএনএ এর প্যাকেজ আকার যেখানে ডি.এন.এ সুস্থিত অবস্থায় থাকে। মানুষের দেহে ৪৬ টি ক্রমোজোম পাওয়া যায় যার মধ্যে ৪৪ টি অটোসোম এবং বাকি ২ টি সেক্স ক্রোমোজোম।দুটি ক্রোমাটিন জালিকা মিলিত হয়ে দিসুত্রক ক্রমোজোম গঠন করে। ক্রোমোজোমের যে স্থানে দুটি ক্রোমাটিন জালিকা মিলিত হয় তাকে সেন্ট্রমিয়ার বলে। প্রায় প্রতি কোষে ক্রোমাটিন থাকে কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম যেমন, লোহিত রক্তকণিকায় ক্রোমাটিন থাকে না।

ডি.এন.এ (DNA)

ডিএনএ (DNA) হল ডিওক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড (Deoxyribo Nucleic Acid).প্রায় সকল প্রাণী,উদ্ভিদ,প্রোক্যারিওটে ডি.এন.এ পাওয়া যায়। ইউক্যারিওট এ ডিএনএ সাধারণত নিওক্লিয়াসে পাওয়া যায় ( কিছু ডি.এন.এ মাইটকন্ডিয়া এবং ক্লোরোপ্লাস্টে পাওয়া যায়)। এটি সাধারণত দ্বিসুত্রক পলিনিউক্লিওটাইড এর সর্পিলাকার গঠন।এর একটি সুত্র অন্যটির বিপরীত ও পরিপূরক।এর একটি সুত্রক ৩'-৫' এবং অন্যটি ৫'-৩' পর্যন্ত বিস্তৃত। এতে পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট শর্করা,নাইট্রোজেন বেস, ও অজৈব ফসফেট দ্বারা গঠিত। নাইট্রোজেন বেস ২ প্রকার, পিউরিন ও পাইরিমিডিন। এডিনিন(A) ও গুয়ানিন(G) বেস হল পিউরিন থায়মিন(T) ও সাইটোসিন(C) হল পাইরিমিডিন। একটি সুত্রের এডিনিন অন্য সুত্রের থাইমিন এর সাথে ২ টি হাইড্রোজেন বন্ড দ্বারা যুক্ত এবং একটি সুত্রের গুয়ানিন অন্য সুত্রের সাইটোসিনের সাথে ৩ টি হাইড্রোজেন বন্ড দ্বারা যুক্ত।১৯৫৩ সালে ওয়াটসন ও ক্রিক সর্বপ্রথম ডি.এন.এ (DNA) এর দ্বি সুত্রক কাঠামো এর বর্ণনা দেন।হেলিক্সের প্রতিটি পূর্ণ ঘূর্ণন ৩.৪ nm (৩৪Å)

ডি.এন.এ অনুলিপন
ডি.এন.এ অনুলিপন (DNA Replication)

এই প্রক্রিয়ায় একটি DNA অনু থেকে আর একটি নতুন DNA অনু তৈরি হয়। DNA অর্ধ-রক্ষণশীল পদ্ধতিতে অনুলিপিত হয়। মাতৃ DNA এর একটি সুত্রে সাথে নতুন একটি সুত্র যুক্ত হয়ে নতুন দ্বি-সুত্রক DNA তৈরি হয় বলে একে অর্ধ-রক্ষণশীল বলে। এই পদ্ধতিতে DNA সূত্র দুটির হাইড্রোজেন বন্ধন ভেঙ্গে গিয়ে আলাদা হয় এবং তাদের পরিপূরক সূত্র তৈরি হয়। ১৯৫৬ সালে ওয়াটসন ও ক্রিক এ ধরনের ডি.এন.এ অনুলিপন পদ্ধতি বর্ণনা করেন।

আর.এন.এ (RNA)

আরএনএ (RNA) হল রাইবোনিউক্লিক এসিড। সাধারণত RNA হল একসুত্রক, কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ভাইরাস যেমনঃ TMV, Yellow Mosaic Virus, Influenza Virus হল দ্বিসুত্রক।এতে পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট রাইবোজ শর্করা, অজৈব ফসফেট, ও নাইট্রোজেন বেস (এডিনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন ও ইউরাসিল) থাকে। RNA তে থায়ামিন থাকে না এর পরিবর্তে ইউরাসিল থাকে।

জিন

জীবের সকল বৈশিস্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী এককের নাম জিন। জিনগুলো ক্রোমোজোম এর উপর অবস্থিত এবং সাধারণত ডি এন এ দিয়ে তৈরি। মানুষের জিনমে প্রোটিন তৈরি করে এমন জিনের সংখ্যা ১৯০০০। এছাড়া রয়েছে নন কোডিং জিন যা প্রোটিন তৈরি করে না কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে যুক্ত। সাধারণত একটি বৈশিষ্টের সাথে এক বা ততোধিক জিন যুক্ত থাকতে পারে। মাল্টি সাব ইউনিট প্রোটিন কমপ্লেক্স এর সাথে একাধিক জিন যুক্ত থাকে। ১৯০৯ সালে ডব্লিউ. জোহান্সন সর্বপ্রথম 'জিন' শব্দটি ব্যবহার করেন। বিভিন্ন জীবে জিনের সংখ্যা বিভিন্ন। তবে একই প্রকৃতির জীবে তা সাধারণত একই থাকে। মাতাপিতা থেকে প্রথম জেনারেশনে (F1) যে বৈশিষ্ট প্রকাশ পায় তাকে প্রকট (Dominant) বৈশিষ্ট এবং এই বৈশিষ্ট প্রকাশে দায়ী জিনকে প্রকট জিন বলে। তবে ২য় জেনারেশনে (F2) এক চতুর্থাংশ জীবে প্রচ্ছন্ন (Recessive) বৈশিষ্ট প্রকাশ পায়।

প্রায় ৫০০০ মটরশুঁটি গাছের উপর পরিক্ষা করেন। তিনি বিভিন্ন জেনারেশনের গাছের মধ্যে ক্রস করিয়ে ফলাফল পর্যবেক্ষণ করেন মেন্ডেল বংশগতির দুটি সূত্র প্রবর্তন করেন। প্রথম সূত্রটিসংকর জনন থেকে প্রাপ্ত এবং দ্বিতীয় সূত্রটি দ্বিসংকর জনন থেকে প্রাপ্ত ।

মেন্ডেলের প্রথম সূত্র

মেন্ডেলের প্রথম সূত্রটি ‘পৃথকীভবনের সূত্র (Law of Segregation) নামে পরিচিত। মনোহাইব্রিড ক্রসে প্রথম বংশধরের উদ্ভিদে বৈসাদৃশ্যময় দুটি ফ্যাক্টর মিশ্রিত না হয়ে পাশাপাশি অ্যালিলে অবস্থান করে এবং পরবর্তী গ্যামেট সৃষ্টিকালে ফ্যাক্টর দুটি পৃথক হয়ে ভিন্ন ভিন্ন গ্যামেটে গমন করে।

মেন্ডেলের দ্বিতীয় সূত্র

মেন্ডেলের দ্বিতীয় সূত্রটি ‘স্বাধীন বন্টনের সূত্র’ (Law of Independent Assortment) নামে পরিচিত। দুই বা ততোধিক জোড়া বৈসাদৃশ্যময় (বিপরীত) বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দুটি জীবের মধ্যে ক্রস (সংকরায়ন) ঘটালে প্রথম বংশধরে (ঋ১-জনুতে) কেবল প্রকট বৈশিষ্ট্যগুলোই প্রকাশিত হবে কিন্তু পরবর্তীতে জননকোষ উৎপাদনকালে বৈশিষ্ট্যগুলো জোড়া ভেঙে পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র বা স্বাধীনভাবে বিন্যসত্ম হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জননকোষে প্রবেশ করবে।

তথ্যসূত্র

    ১। A Textbook of Biotechnology, By R.C. Dubey 4th edition, page -(27-35) ২। মাধ্যমিক জীববিজ্ঞান: জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত(সেপ্টেম্বর ২০১৫);পৃষ্ঠা- ১৬৭-১৭০ ৩।principle of Genetics, by Taramin, 7th edition. page (15-30)

    This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.