ক্রোমোজোম
ক্রোমোজোম হচ্ছে বংশগতির প্রধান উপাদান। ক্রোমাটিন তন্তু কোষ বিভাজনের প্রোফেজ দশায় দণ্ডাকার গঠনে রূপান্তরিত হয়ে ক্রোমোজোমে পরিণত হয় যা জীবের সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং এর মাধ্যমেই বৈশিষ্ট্যসমূহ বংশ পরস্পরায় সঞ্চারিত হয়।[1] ক্রোমোজোম ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড বা ডিএনএ বা জীন অণু ধারণ করে এবং ডিএনএ-এর মাধ্যমে প্রোটিন সংশ্লেষ করে। ইহা নিউক্লিয়াসের মধ্যে অবস্থিত থাকে।

ক্রোমোজোম আবিষ্কার
বিজ্ঞানী স্ট্রাসবার্গার (Strasburger) (১৮৭৫) সর্বপ্রথম ক্রোমোজোম আবিষ্কার করেন। ১৮৮৮ সালে বিজ্ঞানী ওয়ালডেয়ার (Waldeyer) কোষ বিভাজনের প্রোফেজ দশায় প্রাপ্ত দণ্ডাকার গঠনের ক্রোমাটিনের নাম দেন ক্রোমোজোম। ১৯৩৩ সালে বিজ্ঞানী বোভেরি (Bovery) প্রমাণ করেন যে ক্রোমোজোমই বংশগতির ধারক ও বাহক। ১৯৩৫ সালে বিজ্ঞানী হেইজ (Heitz) সর্বপ্রথম ক্রোমোজোমের গঠনের বিস্তারিত বর্ণনা দেন। ১৯৬৬ সালে বিজ্ঞানী ডুপ্রো (Dupraw) ক্রোমোজোমের সূক্ষ্ম গঠন বর্ণনা করেন।
আকার
দৈর্ঘ্যে ক্রোমোজোম ০.২ – ৫০ মাইক্রন (µ) বা মাইক্রোমিটার (µm) এবং প্রস্থ ০.২ – ২ মাইক্রন (µ) বা মাইক্রোমিটার (µm)। মানুষের ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ্য ৬ মাইক্রন (µ) বা মাইক্রোমিটার (µm)।
ক্রোমোজোমের প্রকারভেদ
কাজের উপর ভিত্তিকরে ক্রোমোজোম দুই প্রকার, দেহজ বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী ক্রোমোজোমকে অটোজম (Autosome) এবং যৌন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী ক্রোমোজোমকে যৌন বা লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোম (Sex chromosome) বলে। মানুষের দেহকোষে অটোজমের সংখ্যা ৪৪টি (২২ জোড়া) এবং যৌন বা লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোমের সংখ্যা ২টি (১ জোড়া) এবং জনন কোষে (শুক্রাণু বা ডিম্বাণু) অটোজমের সংখ্যা ২২টি এবং যৌন বা লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোমের সংখ্যা ১টি।[2]
কোষ বিভাজনের বিভিন্ন দশায় ক্রোমোজোম
কোষ বিভাজনের বিভিন্ন দশায় ক্রোমোজোমের আকৃতিতে পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। ইন্টারফেজ দশায় ক্রোমোজোম সরু ও প্যাঁচানো অবস্থায় থাকে অন্যদিকে প্রোফেজ দশায় এটি দণ্ডাকার হয়ে থাকে। মেটাফেজ ও অ্যানাফেজ দশায় এর আকৃতি সেন্ট্রোমেয়ারের অবস্থানের উপর নির্ভরশীল। মেটাসেন্ট্রিক ক্রোমোজোমে সেন্ট্রোমেয়ার ক্রোমোজোমের মাঝামাঝি থাকে ফলে এর উভয় বাহু সমান বা প্রায় সমান হয় যা অ্যানাফেজ দশায় দেখতে ইংরেজির ভি (V) অক্ষরের মত। সাব-মেটাসেন্ট্রিক ক্রোমোজোমে সেন্ট্রোমেয়ার ক্রোমোজোমের মাঝামাঝি না থেকে সামান্য পাশের দিকে থাকে ফলে এর উভয় বাহু অসমান হয় যা অ্যানাফেজ দশায় দেখতে ইংরেজির এল (L) অক্ষরের মত। অ্যাক্রোসেন্ট্রিক ক্রোমোজোমে সেন্ট্রোমেয়ার ক্রোমোজোমের প্রায় প্রান্তের দিকে থাকে ফলে এর উভয় বাহু অনেক বেশি ছোট-বড় হয় যা অ্যানাফেজ দশায় দেখতে ইংরেজির জে (J) অক্ষরের মত। টেলোসেন্ট্রিক ক্রোমোজোমে সেন্ট্রোমেয়ার ক্রোমোজোমের প্রান্তের দিকে থাকে ফলে এর ধরনের ক্রোমোজোমে একটিমাত্র বাহু দেখা যায় যা অ্যানাফেজ দশায় দেখতে ইংরেজির আই (I) অক্ষরের মত। এ ধরনের ক্রোমোজোম দুর্লভ। অ্যাসেন্ট্রিক ক্রোমোজোমে সেন্ট্রোমেয়ার থাকে না।[3]
ক্রোমোজোমের সংখ্যা
একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির ক্ষেত্রে ক্রোমোজোম সংখ্যা নির্দিষ্ট। একই প্রজাতির ক্ষেত্রে জনন (শুক্রাণু ও ডিম্বাণু) কোষের ক্রোমোজোম সংখ্যা দেহকোষের ক্রোমোজোম সংখ্যার অর্ধেক হয়ে থাকে যাকে গ্যামেটিক একক সংখ্যক বা হ্যাপ্লয়েড সেট (যা n দিয়ে প্রকাশ করা হয়) বলে। অন্যদিকে দেহকোষে গ্যামেটিক দ্বি-সংখ্যক বা ডিপ্লয়েড সেট (যা 2n দিয়ে প্রকাশ করা হয়) ক্রোমোজোম থাকে ফলে দেহকোষে ক্রোমোজোম জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করে। সবচেয়ে কম সংখ্যক ক্রোমোজোম পাওয়া যায় গোল কৃমিতে (Ascaris univalens) মাত্র ১ জোড়া (অর্থাৎ 2n = ২ ও n = ১)। অন্যদিকে অ্যামিবাতে (Amoeba proteus) ক্রোমোজোম সংখ্যা ২৫০ জোড়া (অর্থাৎ 2n = ৫০০ ও n = ২৫০)।
ক্রোমোজোমের কাজ
ক্রোমোজোমের কাজ হলো মাতাপিতা হতে জিন সন্তানসন্ততিতে বহন করে নিয়ে যাওয়া। মানুষের চোখের রং, চুলের প্রকৃতি, চামড়ার গঠন ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য ক্রোমোজোম কর্তৃক বাহিত হয়ে বংশগতির ধারা অক্ষুন্ন রাখে।[4] এ কারণে ক্রোমোজোমকে বংশগতির ভৌতভিত্তি (Physical basis of heredity) বলে আখ্যায়িত করা হয়।
তথ্যসূত্র
- সাদিয়া খান, ড. হালিমা; ইসলাম, ড. এম সাইফুল। "ক্রোমোজোম"। জৈবপ্রযুক্তি এবং জীন প্রকৌশল। আগামী প্রকাশনী।
- এটেনবরো, ডেভিড। "জিন"। পৃথিবীতে জীবনের উদ্ভব। অনুপম প্রকাশনী।
- মাধ্যমিক জীববিজ্ঞান: জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত(নভেম্বর ২০১২);পৃষ্ঠা- ১৬৮
- চৌধুরী, আবেদ। "মানুষের জিন"। মানবজিনোম : মানুষের জিন জিনের মানুষ। সময় প্রকাশন।