নুসরাত হত্যা
নুসরাত জাহান রাফি একজন বাংলাদেশী বালিকা, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে তার গায়ে আগুন লাগিয়ে খুন করা হয়। নুসরাত হত্যার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সচেতন মহল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান।[1][2][3]
হত্যার কারণ
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করায় অধ্যক্ষ তার অনুসারীদের কে হত্যার প্ররোচণা দিয়ে নির্দেশনা প্রদান করে। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া এক হত্যাকারী স্বীকার করে যে এর আগে নুসরাত কে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে সে প্রত্যাখ্যাত হয় এবং পূর্ব রাগের জের ধরে সেও এই হত্যা পরিকল্পনায় অংশ নেয়।[4]
হত্যা পরিকল্পনাকারীরা এর আগে ২০১৬ সালে নুসরাতের চোখে চুন জাতীয় দাহ্য পদার্থ ছুঁড়ে মেরেছিল। তখন নুসরাতকে হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা নুসরাতকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যক্ষ এর বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করা হয়।[5]
হত্যার বর্ণনা
৬ এপ্রিল ২০১৯ সকালে মাদ্রাসায় আসে শাহাদত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, হাফেজ আব্দুল। ছাদের বাথরুমের পাশে শাহাদত হোসেন কেরোসিন তেল ও গ্লাস নিয়ে রেখে দেয় এবং সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় কামরুন্নাহার মনি তিনটি বোরকা ও চার জোড়া হাত মোজা রাখে। সাড়ে নয়টার দিকে শাহাদত হোসেন শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের বোরকা ও হাত মোজা পরিধান করে সেখানে অবস্থান গ্রহণ করে।সেদিন উচ্চ মাধ্যমিক সমমানের আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত। মাদ্রাসার এক ছাত্রী সহপাঠী নিশাতকে ছাদের ওপর কেউ মারধর করেছে, এমন সংবাদ দিলে তিনি ওই ভবনের তিন তলায় চলে যান। নুসরাত এর ভাষ্য মতে সেখানে হাত মোজা, পা মোজাসহ বোরকা পরিহিত ৪-৫ জন তাকে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। রাজি না হওয়ায় শাহাদত হোসেন শামীম নুসরাতের মুখ চেপে ধরে ও পপির দেওয়া ওড়না দিয়ে জুবায়ের নুসরাতের পা বাঁধে, পপি হাত বেঁধে ফেলে। পপি, মনি ও শাহাদাত তাকে শুইয়ে ফেলে। জাভেদ কেরোসিন তেল গ্লাসে করে নিয়ে নুসরাতের শরীরে ঢেলে দেয় এবং তাতে জুবায়ের আগুন দেয়। আগুন ধরানোর পর শম্পা মনি ও জাবেদ পরীক্ষার হলে পরীক্ষায় বসে। বাকিরা চলে যায়। নুসরাতের শরীরের ৮০% শতাংশই ঝলসে গিয়েছিল। ১০ এপ্রিল ২০১৯ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নুসরাত এর মৃত্যু ঘটে।[5][6]
হত্যার বিচার
আসামীর নাম | পরিচয় | বয়স | আদালতের রায় | ||
---|---|---|---|---|---|
১ | এস. এম সিরাজ উদ দৌলা | অধ্যক্ষ, ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা | ৫৭ | মৃত্যুদণ্ড | |
২ | রুহুল আমিন | সভাপতি, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ | ৫৫ | মৃত্যুদণ্ড | |
৩ | মাকসুদ আলম | কাউন্সিলর, সোনাগাজী পৌরসভা | ৫০ | মৃত্যুদণ্ড | |
৪ | হাফেজ আব্দুল কাদের | শিক্ষক, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা | ২৫ | মৃত্যুদণ্ড | |
৫ | আফসার উদ্দিন, | প্রভাষক, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা | ৩৩ | মৃত্যুদণ্ড | |
৬ | নুর উদ্দিন | মাদ্রাসার ছাত্র | ২০ | মৃত্যুদণ্ড | |
৭ | শাহাদাত হোসেন শামীম | মাদ্রাসার ছাত্র | ২০ | মৃত্যুদণ্ড | |
৮ | সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের | মাদ্রাসার ছাত্র | ২১ | মৃত্যুদণ্ড | |
৯ | জাবেদ হোসেন | মাদ্রাসার ছাত্র | ১৯ | মৃত্যুদণ্ড | |
১০ | কামরুন নাহার মনি | মাদ্রাসার ছাত্রী | ১৯ | মৃত্যুদণ্ড | |
১১ | উম্মে সুলতানা পপি | মাদ্রাসার ছাত্রী | ১৯ | মৃত্যুদণ্ড | |
১২ | আবদুর রহিম শরিফ | মাদ্রাসার ছাত্র | ২০ | মৃত্যুদণ্ড | |
১৩ | ইফতেখার উদ্দিন রানা | মাদ্রাসার ছাত্র | ২২ | মৃত্যুদণ্ড | |
১৪ | ইমরান হোসেন মামুন | মাদ্রাসার ছাত্র | ২২ | মৃত্যুদণ্ড | |
১৫ | মোহাম্মদ শামীম | মাদ্রাসার ছাত্র | ২০ | মৃত্যুদণ্ড | |
১৬ | মহি উদ্দিন শাকিল | মাদ্রাসার ছাত্র | ২০ | মৃত্যুদণ্ড |
এদের সবাইকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত
মামলার কার্যক্রম
২৪ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আলোচিত নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় ১৬জন আসামীর সবাইকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। আসামীদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে জানায় আদালত। ফেনী জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ এই রায় ঘোষণা করেন। অভিযুক্ত ১৬ জন আসামীর সবাইকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে। এই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ২১ ব্যক্তিকে। তাদের মধ্যে ৫ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আসামীদের মধ্যে ১২ জন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম, মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের, প্রভাষক আফসার উদ্দিন, মাদ্রাসার ছাত্র নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ যোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ওরফে তুহিন, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, মোহাম্মদ শামীম ও মহি উদ্দিন শাকিল।
মামলার সাত মাসেরও কম সময়ের মধ্যে, ৬১ কার্যদিবস শুনানির পর এ রায় ঘোষণা করা হয়। [7]
আরো দেখুন
তথ্যসূত্র
- "সবাইকে কাঁদিয়ে চিরনিদ্রায় নুসরাত"। প্রথম আলো। মতিউর রহমান। ১১ এপ্রিল ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১৪ এপ্রিল ২০১৯।
- ইসলাম, সায়েদুল (১১ এপ্রিল ২০১৯)। "নুসরাত জাহান: যে মৃত্যু নাড়া দিয়েছে সবাইকে"। বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ এপ্রিল ২০১৯।
- "Bangladesh: Ensure Justice for Murdered Student"। Human Rights Watch। সংগ্রহের তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০১৯।
- "কীভাবে নুসরাতকে মারা হয়েছিল - বাংলাদেশ পুলিশের ভাষ্য"। বিবিসি বাংলা। ১৩ এপ্রিল ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১৪ এপ্রিল ২০১৯।
- "নুসরাতকে হত্যার পেছনে খুনিদের 'দুই কারণ'"। প্রথম আলো। ১৩ এপ্রিল ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১৪ এপ্রিল ২০১৯।
- সময় নিউজ, পিবিআই এর বর্ননা (20/11/19)। "ফেনীর নুসরাত হত্যা ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলো পিবিআই"। ইউটিউব। ৩০/০৫/২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯/১১/১৯। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ=, |আর্কাইভের-তারিখ=
(সাহায্য) - জাহান রাফি, নুসরাত (২৪ অক্টোবর ২০১৯)। "নুসরাত জাহান রাফি হত্যা: ১৬ জন আসামীর সবার মৃত্যুদণ্ড"। বিবিসি নিউজ, বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০১৯।