থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী

আর্চবিশপ থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী (আর্চবিশপ টি এ গাঙ্গুলী নামে অধিক পরিচিত) বাঙালি ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রথম আর্চবিশপ ছিলেন। ২০০৬ সালে ভ্যাটিকান থেকে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট তাকে ‘ঈশ্বরের সেবক’ উপাধি প্রদান করেন। ধর্মীয়ভাবে সর্বোচ্চ ত্যাগের ও অবদানের জন্য পোপ মৃত ব্যক্তিত্বদের সাধু ঘোষণা করে থাকেন। আর সাধু শ্রেণীভুক্তকরণের প্রথম ধাপ হলো ‘ঈশ্বরের সেবক’ পদ। এই পদে তারাই সম্মানিত হন যারা সেবা, ভালবাসা, ক্ষমা, সততা ও পবিত্র জীবন যাপন করে থাকেন। এশিয়া মহাদেশে এর আগে মাদার টেরিজা, কেরেলার ফাদার আগস্টিন কোচান ও জাপানের ফাদার পেট্রো কাসুই কইবকে এ পদে সম্মানিত করা হয়েছে।

শৈশব

তিনি ১৯২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার হাসনাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নিকোলাস কমল গাঙ্গুলী ও মাতা রোমানা কমলা গাঙ্গুলী। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।

শিক্ষা জীবন

১৯৪০ সালে তিনি নবাবগঞ্জ এর বান্দুরা হলিক্রস হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে তৎকালীন প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ফাদার হওয়ার জন্য বিহারের রাঁচি সেমিনারিতে যোগদান করেন। তিনি ১৯৪৬ সালে ৬ই জুন ফাদার হন। ১৯৪৭ সালের ১৭ই আগস্ট উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি ১৯৫১ সালে দর্শনে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি 'মহর্ষি পতঞ্জলি’র যোগ বিষয়ের উপর গবেষণা করেন। ‘পুরুষ ও প্রকৃতি: পতঞ্জলি, সংখ্যা ও যোগ- এর আলোকে একটি দার্শনিক মূল্যায়ন’ ছিল তার থিসিস বিষয়। তিনি বাংলা, ইংরেজি ভাষা ছাড়াও লাতিন, ফরাসি, জার্মান, ইতালীয়, উর্দু, হিন্দিসংস্কৃত ভাষায় দক্ষ ছিলেন।

পেশা জীবন

টি. এ. গাঙ্গুলী ছিলেন প্রথম পিএইচডি ডিগ্রিধারী খ্রিস্টান বাঙালি। স্বল্পভাষী কিন্তু বহুভাষাবিদ, সুশিক্ষিত, সুলেখক, সুবক্তা, সুগায়ক, সুরসিক ও সুচিন্তাবিদ। উচ্চ শিক্ষা ও জ্ঞানের অহংকার কোন দিনই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ১৯৪৬ সালের ৬ জুন রাঁচির সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রালে ধর্মপ্রদেশীয় যাজক পদে অভিষিক্ত হন।[1] এরপর ১৯৫২ সাল থেকে তিনি নটর ডেম কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। নটর ডেম কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জেমস মার্টিনের মৃত্যুর পর ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ কলেজটির প্রথম বাঙালি অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন। কিন্তু বেশিদিন এ পদে থাকতে পারেন নি। ঢাকা ধর্মমহাপ্রদেশের আর্চবিশপ লরেন্স লিও গ্রেনারের সহকারী নিযুক্ত হওয়ায় সে বছরেরই ৩ সেপ্টেম্বর অধ্যক্ষের পদ ছেড়ে দেন।

১৯৬৭ সালে তিনি তার নেতৃত্ব, জ্ঞান, প্রজ্ঞার যোগ্যতা বলে বাংলাদেশের খ্রিস্টান প্রধান ‘আর্চবিশপ’ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি আর্চবিশপ লরেন্স লিও গ্রেনার, সিএসসি’র স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধে অবদান

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি খ্রিস্টানদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য। তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পায়ে হেঁটে, সাইকেলে চেপে টাকা পয়সা ও খাবার পৌঁছে দিয়েছেন।

১৯৭২ সালে ২ ফেব্রুয়ারি আর্চবিশপ টি এ গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান মন্ডলীর ছয়জন নেতা সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর অফিসে সাক্ষাৎ করেন এবং এদেশের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য দু’লক্ষ টাকার একটি চেক এবং এদেশের উপর ঈশ্বরের আশির্বাদের প্রতীকস্বরূপ একটি স্বর্ণের ক্রুশ ও তাঁর গলার চেইন প্রদান করেন।

স্বীকৃতি

ফাদার টি. এ. গাঙ্গুলীর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সংঘ ও সমিতি। ঢাকা খ্রিস্টান ছাত্র কল্যাণ সংঘ প্রতি বছর তাঁর নামে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগে “দি আর্চবিশপ টি এ গাঙ্গুলী লাইব্রেরী” যাত্রা শুরু করে। একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে তাকে সাধু শ্রেণিভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। তার স্মৃতিকে অমর করে রাখতে ঢাকার নটর ডেম কলেজের একটি ভবনের নামকরণ করা হয়েছে "আর্চবিশপ গাঙ্গুলী ভবন"।

মৃত্যু

১৯৭৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তার শোক বাণীতে বলেন, “প্রখ্যাত ক্যাথলিক নেতা আর্চবিশপ টি এ গাঙ্গুলীর দুঃখজনক মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে ব্যথিত। বাংলাদেশ ও তার জনগণের জন্য তাঁর অবদানের কথা গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়ে থাকে।”

রমনা আর্চবিশপ প্রাঙ্গনে তাকে সমাহিত করা হয়।[1] তার মৃত্যুর পর আর্চবিশপ মাইকেল তার স্থলাভিষিক্ত হন।

তথ্যসূত্র

  1. সরেজমিন দোহার-নবাবগঞ্জ (শেষ): মিলেমিশে আছে ওরা; থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলি প্রথম বাঙালি আর্চবিশপ, প্রথম আলো, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আরো পড়ুন

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.