ঢাকায় আর্মেনী সম্প্রদায়

আর্মেনী সম্প্রদায় অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের প্রথমদিকের ঢাকা শহরে বসবাসকারী একটি সম্প্রদায়। এ সম্প্রদায়টি অন্যান্যদের তুলনায় ছিল অতি ক্ষুদ্র কিন্তু কালীন প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের অন্যতম একটি। বিত্ত বৈভব তাদের প্রভাবশালীত্বের অন্যতম কারণ। ঢাকায় তাদের অনেকেরই জমিদারি ছিল, অনেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর লবণ উৎপাদন ও বিতরণের ঠিকাদারি করতেন। উনিশ শতকে ঢাকায় প্রভাবশালী ও পরিচিত আর্মেনীয় পরিবারের মধ্যে পোগজ, আরাতুন, পানিয়াটি, কোজা, মাইকেল, মানুক, হার্নি এবং সার্কিস অন্যতম।[1]

ঢাকার আর্মানীটোলায় আর্মেনীয় গীর্জা
আর্মেনীয় গীর্জার প্রবেশপথ
১৭৮১ সালে নির্মিত গীর্জাটির ভিত্তিপ্রস্তরের ফলক
নিকি পোগোজের বাড়ি

ঢাকায় আগমন ও বসবাস

সাফাভি রাজবংশ কর্তৃক ককেশাসের পূর্ব আর্মেনিয়া বিজয়ের পরে শাহ আব্বাস প্রায় ৪০,০০০ আর্মেনীয় ব্যবসায়ীদেরকে ইস্পাহান ও নয়া জাফাতে নির্বাসনে পাঠান। সেখান থেকে ইরানী অভিযাত্রীদের সাথে এই ব্যবসায়ীদের অনেকে প্রথম বাংলায় আগমন করেন। ষোড়শ শতক থেকেই বাংলায় আর্মেনীয় ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি শুরু হয়। এই ব্যবসায়ী সম্প্রদায় মূলত আমদানী-রপ্তানী ব্যবসায় জড়িত ছিলো। ঢাকায় কবে আর্মেনীয় ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটে তা নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি, তবে আর্মেনীয়দের কবরস্থানের শিলালিপি হতে ধারণা করা যায় যে, এই উপস্থিতির সূচনা অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে।[2]

আর্মেনীয়রা অষ্টাদশ শতকে ঢাকায় বস্ত্র ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তার করে। রেশম বাণিজ্যে আর্মেনীয়রা গুজরাতি ও উত্তর ভারতীয় ব্যবসায়ীদের প্রধান প্রতিযোগী ছিলেন। পাট ব্যবসাতেও তাদের আধিপত্য ছিলো।[3]

শুরুতে আর্মেনীয়রা সবাই আরমানিটোলাতে বাস করতেন না, বরং মৌলভিবাজার ও নলগোলা এলাকাতে অনেকেই বাস করতেন।[4] আরমানিটোলার গির্জা নির্মাণের পূর্বে তারা একই এলাকায় একটি ক্ষুদ্র উপাসনালয়ে প্রার্থনা করতেন। তাদের কবরস্থান ছিলো তেজগাঁর রোমান ক্যাথলিক চার্চে। সেখানকার অনেকগুলো কবরের শিলালিপিতে ১৭৪১ হতে ১৭৯৫ পর্যন্ত বিভিন্ন তারিখ দেখা যায়। [2] ১৮৩৭ সালে আর্মেনীয় গির্জায় একটি ঘড়ির টাওয়ার নির্মাণ করা হয়, যা ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ধ্সে পড়ে।[5] ১৮৬৮ সাল নাগাদ ঢাকার ছয় জন ইউরোপীয় জমিদারের পাঁচজনই ছিলেন আর্মেনীয় - এঁরা হলেন জে জি নিকোলাস পোগোজ (নিকি পোগোজ নামে পরিচিত), জিসি পানাতি, জে স্টেফান, জেটি লুকাস, এবং ডব্লু হারনি।[6]

এ আর্মেনী সম্প্রদায় ঢাকায় তাদের বসবাসের জন্য গড়েছিলেন বিশাল বিশাল ইমারত সহ বাড়ি। এদের মধ্যে আরাতুনের বাড়ি ছিল ফরাশগঞ্জের রূপলাল হাউস। বর্তমান বুলবুল ললিতকলা একাডেমী যে বাড়িতে তা ছিল জমিদার নিকি পোগজের। এছাড়া মানুকের বাড়ি ছিল সদরঘাটে। আনন্দ রায় স্ট্রিটে ছিল স্টেফানের বাড়ি, তাজমহল সিনেমাহলে ছিল পানিয়াটির অট্টালিকা, বাবুবাজার পুলের উত্তর পশ্চিমে ছিল কাঁচাতুরের বাড়ি।

ঢাকায় পেশা ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড

পরবর্তীকালে আর্মেনীরা ব্যবসা উদ্দেশ্যে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দোকান খুলেছিল। তার মধ্যে শাঁখারিবাজারের "সিরকো এন্ড সন্স" অন্যতম। এ দোকানে চা সহ বিভিন্ন ইউরোপীয় জিনিসপত্র বিক্রি হত।[1] মদ বিক্রির জন্য প্রতিষ্ঠিত ছিল "মেসার্স আনানিয়া এন্ড কোম্পানী"। ১৮৫৬ সালে সিরকোই প্রথম ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ীর প্রচলন করেন যা তখন "ঠিকা গাড়ি" নামে পরিচিত ছিল এবং তা ব্যপক সমাদ্রিত হয়েছিল।[1] পরবর্তীকালে এ ঘোড়ার গাড়ি বা ঠিকা গাড়িই ঢাকা শহরের প্রধান যানবাহনে পরিণত হয়েছিল। পাট ব্যবসায়ও আর্মেনীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।[3] ঢাকায় বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে ও সভাসমিতিতে আর্মেনীরা যুক্ত হয়েছিলেন। নিকি পোগজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পোগোজ হাই স্কুল[7] আরাতুন ঢাকা নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন। তার আমলে ঢাকা নর্মাল স্কুলের ছাত্ররা কলকাতা ও হুগলীর ছাত্রদের চেয়ে বাংলা ভাষায় বেশি নম্বর পেয়েছিল বলে স্কুলটি বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিল। ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটিতে ছিলেন সার্কিস। ১৮৭৪ - ১৮৭৫ সালে ঢাকার পৌরসভার সদস্য ছিলেন জে. জি. এন. পোগজ ও এন. পি. পোগজ। আর্মেনীটোলায় আর্মেনীরা ১৭৮১ সালে তৈরি করেছিলেন একটি গির্জা। গির্জার চারপাশের জমি আর্মেনীরা গোরস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হত। গির্জায় একটি বড় ঘণ্টা ছিল। যার শব্দ ঢাকা শহরের প্রায় সব জায়গা থেকে শোনা যেত।[1] তখন ঢাকাবাসীরা ঐ ঘণ্টার আওয়াজেই নিজেদের সময়ের হিসেব রাখতেন। ১৮৮০ সালে সেই ঘন্টাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

উনিশ শতকের শেষভাগে আর্মেনীদের প্রভাব কমতে শুরু করেছিল। তাদের অনেকেরই জমিদারি হাতছাড়া হয়েছিল, অনেকেই কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থাও দিন দিন খারাপ হয়ে পরেছিল। আরাতুনের উত্তরাধিকারীরা খাজা আজিমুল্লাহের কাছে জমিদারি বিক্রি করে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। লুকাস জমিদারি বিক্রি করেছিলেন আনন্দচন্দ্র রায়ের কাছে। পোগজ জমিদারি বিক্রি করে লন্ডন চলে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া অনেকেই তাদের পেশা পরিবর্তন করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুর দিক থেকেই ঢাকায় আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমতে থাকে। [8]

খোজাফ ওয়াজিদ

খোজাফ ওয়াজিদ সালপেট্রে ব্যবসার জন্য, যা ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য বলে বিবেচিত হত, সমঝোতা করতেন। হুগলী থেকে তার ব্যবসাসমূহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তিনি তিন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর একজন হিসেবে বাংলার ব্যবসায়িক ক্ষেত্র পরিচালিত করতেন। বাকি দু’জন ছিলেন ফতেহ চাঁদ ও উমি চাঁদ। খোজাহ মাহমেট ফাজেলের সন্তান এই প্রভাবশালী আর্মেনীয় বণিক নবাবের দরবারে একজন “ভাকিল’ হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করেন এবং পরিশেষে নবাবের নিকটজনে পরিণত হন।

ফরাসি, ডাচ ও ইংরেজদের সাথে তার সফল ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। একবার কাসিমবাজারের ফ্রেঞ্চ ফ্যাক্টরির প্রধান জিয়ান ল ডি লরিসটন বলেছিলেন যে, ওয়াজিদ সবার সাথে ভাল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করতেন। তার কাছে কমপক্ষে ছয়টি জাহাজ - সালামাট রেসান, সালামাত মঞ্জিল, মোবারক, জেনসামেল, মেদিন বক্স ও মুবারক মঞ্জিল ছিল যা হুগলি থেকে জেদ্দাহ, মক্কা, বসরা, সুরাট ও মাসুলিপাটানামে যেত।

পলাশীর যুদ্ধের পর, তিনি মীর জাফরের কাছ থেকে একটি পরোয়ানা লাভ করেন যার অংশ হিসেবে তিনি “সমগ্র পাটনায় সালপেত্রে ব্যবসার অধিকার লাভ করেন। এই সুবিধার বিপরীতে তিনি কোম্পানিকে স্বল্পমূল্যে লবণ ব্যবহারের ব্যবস্থা করে দেন। এছাড়াও তার কাছ থেকে ডাচ পণ্য গ্রহণের সুবিধা দেখা হয়। ‌১৭৫৮ সালে কোম্পানী তার সালপেত্রে ব্যবসা দখল করে যা ১৭৭৩ সালে দশ লক্ষ রুপী লাভ করে। ১৭৫৯ সালে কোম্পানি তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠালে সেখানে তিনি বিষ পান করেন। তার মৃত্যুর পর, খোয়াজাহ পেট্রুস আরাটুন বাংলার আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন।

স্থাপনা

ঢাকায় আর্মেনীয়দের বর্তমানে যে কয়েকটা স্থাপনা আছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভিতরে অবস্থিত আর্মেনীয় গির্জা। টিএসসির ভিতরে খোলা মাঠের পূর্ব দিকে হলুদ বর্ণের ছোট এই স্থাপনার অবস্থান যা টি এস সির শোভা বর্ধন করে । এই স্পপনাকে অনেকে মোঘল স্থাপনা ভেবে ভুল করেন । এটি একটি গেইট আকৃতির স্থাপনা।

তথ্যসূত্র

  1. মুনতাসীর মামুন, "ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী", পরিবর্ধিত ৩য় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০০, অনন্যা প্রকাশনালয়, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২৮, আইএসবিএন ৯৮৪-৪১২-১০৪-৩।
  2. Firmiger, Walter (১৯১৭), "Some old graves at Dacca", Bengal Pat & Present, XV: 48–54
  3. "Indo-Armenian economic relations"। MENQ। ২০০৭-০৫-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-০৪
  4. Taifoor, Syed Muhammed (১৯৫২)। Glimpses of Old Dhaka। Dhaka: SM Perwez। পৃষ্ঠা 271–272। ASIN B0007K0SFK।
  5. "Architecture"। Banglapedia। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-০৪
  6. Clay, AL (১৮৯৮)। Leaves from a diary in East Bengal। London। পৃষ্ঠা 104–105।
  7. "Pogose School"। Banglapedia। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-০৪
  8. Hunter, WW (১৮৭৫)। A Statistical Account of Bengal (Vol. 5)। London: Truebner and Co.। পৃষ্ঠা 46।
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.