ভূত্বকীয় পাত সংস্থান তত্ত্ব

ভূত্বকীয় পাত সংস্থান তত্ত্ব বা ভূত্বক গঠনের পাত তত্ত্ব বলতে একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে নির্দেশ করা হয়, যার দ্বারা পৃথিবীর অশ্মমণ্ডলে একে অপরের দিকে চলাচল করতে সক্ষম কিছু পাতলা, অনমনীয় খণ্ড তথা পাতের সমন্বয়ে তৈরি ভূত্বক বা পৃথিবীর উপরিতলের বর্ণনা দেয়া হয়। সর্বপ্রথম ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে জার্মান আবহাওয়াবিদ আলফ্রেড ভেগেনারের প্রস্তাবিত "মহীসঞ্চারণ তত্ত্ব"[1] (Continental Drift) থেকেই এই ধারণাটির জন্ম হয়। ভূত্বক গঠনের পাত তত্ত্ব (Plate tectonics) বিজ্ঞানের আধুনিকতম আবিষ্কার ও গবেষণার দৌলতে এটি এখন আর নিছক কোনো তত্ত্ব নয়, বরং বিজ্ঞানসম্মত একটি ঘটনা, যা পৃথিবীতে সংঘটিত ভূমিকম্পের জন্য দায়ী বলে ভূবিজ্ঞানীরা গ্রহণ করেছেন। বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বটিকে ব্যবহার করে ভূমিকম্প ছাড়াও আগ্নেয়গিরির উদগীরণ, পর্বত সৃষ্টি এবং মহাসাগরমহাদেশ সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন।[2]

১৯২০-এর দশকের দ্বিতীয় অর্ধাংশে ভূত্বকীয় পাতের অবস্থান নির্ণীত হয়।

ব্যুৎপত্তি

ইংরেজি পারিভাষিক নাম Tectonic plate-এর tectonic শব্দটি লাতিন ভাষা tectonicus হয়ে গ্রিক ভাষার গ্রিক: τεκτονικός ("গড়ার গুণসম্পন্ন") শব্দটি থেকে এসেছে।[3]

আবিষ্কারের সূত্র

আলফ্রেড ভেগেনার লক্ষ করেন, পৃথিবীর মানচিত্রে মহাদেশগুলোর পার্শ্বদেশ বা সীমানা বা তটরেখা একটি আরেকটির থেকে অনেক অনেক দূরে হলেও অদ্ভুতভাবে পরস্পরের সাথে মিলে যায়। তা দেখেই তিনি তার তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ব্যাখ্যা দেন যে, বহুকাল আগে সবগুলো মহাদেশ একত্রে একটি মহাদেশ ছিল (প্যানজিয়া), কালের আবর্তে যা ভূত্বকীয় পাত নামক পাতগুলির নড়াচড়ায় আলাদা আলাদা মহাদেশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই তত্ত্বটিকে বলা হয় মহীসঞ্চারণ তত্ত্ব (কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্‌ট)। তিনি তার তত্ত্বের সমর্থনে মাদাগাস্কার দ্বীপ ও ভারতে প্রাপ্ত ফসিলের সাদৃশ্য দেখান।[1] তার এই তত্ত্বটির উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা পরবর্তীতে বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে প্রতিষ্ঠিত করেন আধুনিকতম তত্ত্ব নব-বৈশ্বিক ভূত্বকীয় পাত, যা সাধারণ্যের কাছে ভূত্বকীয় পাত (টেকটনিক প্লেট) হিসেবে সমধিক পরিচিত।[2]

বিবরণ

ভূত্বকীয় পাত মূলত পৃথিবীর অভ্যন্তরের গলিত অংশটির সবচেয়ে বাইরের আবরণ, যা আসলে পাথরের একটি স্তর, যার উপরে পৃথিবীর উপরস্থ সবকিছু অবস্থান করছে।[2]

ভূত্বকীয় পাতসমূহের সীমানার ধরণ

পরিবর্তক সীমা
বিমুখগামী সীমা
অভিসারমুখী সীমা

তিন ধরনের ভূত্বকীয় পাত সীমানা লক্ষ্য করা যায়। সেগুলো হলঃ

  • পরিবর্তক সীমা: দুটি ভূত্বকীয় পাত যখন সমান্তরাল ভাবে একে অন্যের বিপরীতে সরতে থাকে, তখন তাদের মধ্যবর্তী স্থানকে পরিবর্তক সীমা (Transform boundaries) বলা হয়ে থাকে। এই ক্ষেত্রে ভূত্বকীয় পাত সৃষ্টি বা ধ্বংস হয়না, তাই এদের সংরক্ষণশীল ভূত্বকীয় পাতসীমাও বলা হয়।
  • বিমুখগামী সীমা: এই ক্ষেত্রে ভূত্বকীয় পাতে ফাটল ধরে এবং এরপর তারা পরস্পরের বিপরীতমুখী ভাবে অগ্রসর হতে থাকে। একে গঠনমূলক ভূত্বকীয় পাতসীমাও বলা হয়, কারণ এর ফলে নতুন ভূত্বকীয় পাতের উদ্ভব হয়।
  • অভিসারমুখী সীমা: এই ক্ষেত্রে একাধিক টেকটনিক পাত পরস্পরগামী থাকে এবং একসময় সম্মিলিত হইয়ে যায়। সাধারণত এইসকল ক্ষেত্রে পর্বতমালার সৃষ্টি হয়। একাধিক টেকটনিক পাত সম্মিলিত হয়ে একটাতে রুপান্তরিত হয় বলে একে বিধ্বংসীমূলক টেকটনিক সীমাও বলা হয়।

ভূত্বকীয় পাতসমূহ

পৃথিবীতে নিচের ভূত্বকীয় পাতসমূহ শনাক্ত করা হয়েছে।

প্রধান পাতসমূহ

সংজ্ঞাগত দিক দিয়ে এদের মধ্যে প্রধান ভূত্বকীয় পাত মোটামুটি 6টি:

অপ্রধান ভূত্বকীয় পাতসমূহ

ডজনখানেক অপ্রধান পাত থাকলেও মোটামুটি ৭টি হলো:

  • আরব পাত
  • ক্যারিবীয় পাত
  • হুয়ান দে ফুকা পাত
  • কোকাস পাত
  • নাজকা পাত
  • ফিলিপিনীয় পাত
  • স্কোশিয়া পাত

অন্যান্য জ্যোতিষ্কের ভূত্বকীয় পাত

ভূত্বকীয় পাত তত্ত্ব যদিও পৃথিবীকে ঘিরে শুরু হয়েছিল এবং পৃথিবীকেন্দ্রীকই আছে, কিন্তু বিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী ভূত্বকীয় পাত শুধু পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ নয়, এই তত্ত্ব অন্যান্য অনেক জ্যোতিষ্ক বা মহাকাশীয় বস্তুতে প্রযোজ্য। আমাদের সৌরজগতের শুক্র গ্রহ, মঙ্গল গ্রহ ছাড়াও বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহসমূহে, শনি গ্রহের উপগ্রহ টাইটানে ভূত্বকীয় পাত অস্তিত্ব দেখা যায়। এছাড়াও আমাদের সৌরজগতের বাইরের অন্যান্য জ্যোতিষ্ককে ঘিরে আবর্তিত পৃথিবীসদৃশ মহাকাশীয় বস্তুতেও, বিশেষ করে যেসকল মহাকাশীয় বস্তুতে পানির বিশাল উৎস বা সমুদ্র রয়েছে, সেগুলোতে ভূত্বকীয় পাতের অস্তিত্ব থাকতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন।[3]

তথ্যসূত্র

  1. ভূত্বকীয় পাত চলন, ভূমিকম্প-প্রবণতা ও সূচকীয় বিধি, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, আর্টস.বিডিনিউজ২৪.কম, ১৭ মার্চ ২০১১ খ্রিস্টাব্দ। পরিদর্শনের তারিখ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
  2. Plate Tectonics, Microsoft Encarta Encyclopedia Deluxe 2004, CD Version (13.0.0.0531)। পরিদর্শনের তারিখ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
  3. Little, W.; Fowler, H.W.; Coulson, J. (১৯৯০)। Onions C.T., সম্পাদক। The Shorter Oxford English Dictionary: on historical principlesII (3 সংস্করণ)। Clarendon Press। আইএসবিএন 9780198611264।

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.