ছায়াপথ

ছায়াপথ মহাকর্ষীয় শক্তি দ্বারা আবদ্ধ একটি অতি বৃহৎ সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা যা তারা, আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস ও ধূলিকণা, প্লাসমা এবং প্রচুর পরিমাণে অদৃশ্য বস্তু দ্বারা গঠিত। একটি আদর্শ ছায়াপথে ১০ মিলিয়ন থেকে এক ট্রিলিয়ন পর্যন্ত তারা থাকে যারা সবাই একটি সাধারণ মহাকর্ষীয় কেন্দ্রের চারদিকে ঘূর্ণায়মান। বিচ্ছিন্ন তারা ছাড়াও ছায়াপথে বহুতারা ব্যবস্থা, তারা স্তবক এবং বিভিন্ন ধরনের নীহারিকা থাকে। অধিকাংশ ছায়াপথের ব্যস কয়েকশ আলোকবর্ষ থেকে শুরু করে কয়েক হাজার আলোকবর্ষ পর্যন্ত এবং ছায়াপথসমূহের মধ্যবর্তী দূরত্ব মিলিয়ন আলোকবর্ষের পর্যায়ে।

এনজিসি ৪৪১৪, কোমা বারেনিসিসের মণ্ডল-এ অবস্থিত একটি কুণ্ডলাকার ছায়াপথ। এর ব্যাস প্রায় ১৭,০০০ পারসেক

ছায়াপথের শতকরা ৯০ ভাগ ভরের জন্য দায়ী করা হয় অদৃশ্য বস্তুকে যদিও এদের অস্তিত্ব এবং গঠন সম্পর্কে অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে। ছায়াপথের অভ্যন্তরে অতিবৃহৎ কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আন্তঃছায়াপথীয় স্থান হালকা প্লাসমা দ্বারা পূর্ণ। আমাদের পর্যবেক্ষণিক সীমার মধ্যে একশ বিলিয়নেরও বেশি ছায়াপথ রয়েছে। রাসেল

উৎপত্তি

ছায়াপথ শব্দটি ইংরেজি Galaxy শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে বাংলায় ব্যবহৃত হয়। Galaxy শব্দটি গ্রিক γαλαξίας (গালাক্সিয়াস) শব্দ থেকে উদ্ভূত। আমাদের সৌরজগত যে ছায়াপথে অবস্থিত তার গ্রিক নাম দেয়া হয়েছিল γαλαξίας যার অর্থ kyklos galaktikos বা "দুধালো বৃত্তপথ" (Milky circle)। পরবর্তীকালে এই নামটিকেই ছায়াপথের সাধারণ নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। গ্রিক পুরাণ অনুসারে জিউস তার সন্তান শিশু হারকিউলিসকে একজন মরণশীল নারীর সাহায্যে হেরার বুকে স্থাপন করেন। তখন হেরা ঘুমন্ত ছিল। জিউসের উদ্দেশ্য ছিল, হারকিউলিস যেন হেরার বুকের স্বর্গীয় স্তন্য পান করার মাধ্যমে অমরত্ব লাভ করতে পারে। স্তন্যপানের সময় হেরার ঘুম ভেঙে যায় এবং সে দেখে যে সে একটি অচেনা শিশুর সেবা করছে। সে শিশুটিকে ঠেলে দেয় যার ফলে তার স্তন থেকে দুধের একটি ক্ষীণ ধারা রাতের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ থেকেই সৃষ্টি হয় "দুধালো বৃত্তপথের"।

আগে বেশ কিছু মহাজাগতিক বস্তুকে কুণ্ডলীত নীহারিকা নামে অভিহিত করা হতো, কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখেন যে সেগুলো প্রকৃতপক্ষে প্রচুর তারার সমন্বয়ে গঠিত। একে ঘিরে গড়ে উঠে দ্বীপ মহাবিশ্ব তত্ত্ব। কিন্তু পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে এর নামকরণ ভুল হয়েছে কারণ প্রকৃত মহাবিশ্ব এর অন্তর্ভুক্ত সকল বস্তুরই সামষ্টিক নাম। তাই এর পর থেকে এধরনের তারার সমষ্টিকে সাধারণভাবে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ নামে অভিহিত করা হতে থাকে।

ছায়াপথ গবেষণার ইতিহাস

পারস্যদেশীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী আল সুফি সর্বপ্রথম কুণ্ডলাকার ছায়াপথের বর্ণনা করেন। তার বর্ণনাটি ছিল ধ্রুবমাতা মণ্ডলের একটি ছায়াপথের। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলি একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা রাতের আকাশে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ পর্যবেক্ষণ করেন যা তখন আকাশে আলোর একটি উজ্জ্বল ব্যান্ড হিসেবে পরিচিত ছিল। তিনি দেখেন যে এটি অসংখ্য ক্ষীণ আলোকবিশিষ্ট তারার সমন্বয়ে গঠিত। ১৭৫৫ সালে ইমানুয়েল কান্ট টমাস রাইটকৃত প্রাচীন একটি গবেষণা উপর ভিত্তি করে কিছু ছবি আঁকার সময় উল্লেখ করেন যে ছায়াপথ অনেকগুলো তারার সমন্বয়ে গঠিত একটি ঘূর্ণায়মান জ্যোতিষ্ক হতে পারে, আর এতে অবস্থিত তারাগুলো মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে একীভূত হয়ে থাকে; এর সাথে সৌরজগতের তুলনা করা যেতে পারে যদিও ছায়াপথসমূহে তা একটি সুবৃহৎ পরিসরে থাকে। তার এই অনুমিতিটিকি সঠিক ছিল। এছাড়াও কান্ট বলেছিলেন, রাতের আকাশে দৃশ্যমান নীহারিকাগুলো পৃথক পৃথক ছায়াপথ হতে পারে। তার এই শেষোক্ত ধারণাটি অবশ্য বর্তমানকালে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আসলে নীহারিকা ও ছায়াপথ ভিন্ন দুটি বস্তু।

১৭৮০ সালে ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী চার্লস মেসিয়ার একটি তালিকা প্রণয়ন করেন যাতে ৩২ টি ছায়াপথ অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই ছায়াপথগুলোকে বর্তমানে মেসিয়ার (M) সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। যেমন ধ্রুবমাতা মণ্ডলের মেসিয়ার সংখ্যা হল এম৩১ (M31)। মেসিয়ার প্রকৃতপক্ষে ১০৯ টি উজ্জ্বলতম নীহারিকার তালিকা করেছিলেন, পরবর্তীকালে উইলিয়াম হার্শেল তা পরিবর্ধন করে ৫০০০ নীহারিকার তালিকা প্রণয়ন করেন। যা হোক মেসিয়ারের তালিকায় ৩২ টি ছায়াপথের নাম ছিল; কিন্তু ছায়াপথ ও নীহারিকার মধ্যে পার্থক্য জানা না থাকায় সম্ভবত সেগুলো আলাদা করা সম্ভব হয় নি। ১৭৮৫ সালে ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম হার্শেল প্রথম আকাশগঙ্গা ছায়াপথের আকৃতি সম্বন্ধে একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন, এর জন্য তিনি আকাশের বিভিন্ন অঞ্চলে দৃশ্যমান তারার সংখ্যা গণনা করেন। পরবর্তীকালে উইলিয়াম হার্শেল ৫০০০ নীহারিকার একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন যাতে তার বোন স্যার ক্যারোলিন হার্শেল এবং ছেলে স্যার জন হার্শেল সহায়তা করে। এই তালিকায় অনেকগুলো ছায়াপথ অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৮৪৫ সালে লর্ড রোস একটি নতুন দূরবীক্ষণ যন্ত্র গঠন করেন যা দ্বারা প্রথম উপবৃত্তাকার ও কুণ্ডলাকার নীহারিকার মধ্যে পার্থক্য প্রমাণ করেন। এর পাশাপাশি তিনি নীহারিকাগুলোর মধ্যে পৃথক পৃথক আলোর উৎস চিহ্নিত করতে সমর্থ হন।

বহিঃসংযোগ

আরও দেখুন

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.