কৃষ্ণগহ্বর গবেষণার ইতিহাস

তাত্ত্বিক গবেষণা

প্রাথমিক গবেষণা ও সমস্যাসমূহ

কৃষ্ণগহ্বর বিজ্ঞানের বিরল কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে অন্যতম একটি যা আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বেই তাত্ত্বিক গবেষণায় প্রমাণিত এবং বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এর সূচনা নিউটনের সময় থেকেই। তখন আলো সম্বন্ধে দুটি তত্ত্ব প্রচলিত ছিল। একটিতে বলা হয়েছিল আলো তরঙ্গ দ্বারা গঠিত। কিন্তু নিউটন যে তত্ত্বটিকে বেশী সমর্থন করতেন তাতে বলা হয়েছিল, আলো কণা দ্বারা গঠিত। বর্তমানে আমরা জানি, উভয় তত্ত্বই সঠিক যা কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের তরঙ্গ-কণা দ্বৈততা অংশে ব্যাখ্যা করা হয়। যাহোক, তরঙ্গ হলে আলোর উপর মহাকর্ষের কোন প্রভাব থাকতে পারেনা। কিন্তু কণা দ্বারা গঠিত হলে এটি মহাকর্ষ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে ঠিক যেমন অন্য যেকোন বস্তু প্রভাবিত হয়। এ বিষয়টির কথা চিন্তা করেই কেমব্রিজের ডন জন মিশেল ১৭৮৩ সালে লন্ডনের রয়েল সোসাইটির "ফিলোসফিক্যাল ট্রানজ্যাকশনে" একটি গবেষণাপত্র লিখেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, এমন তারা থাকতে পারে যার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এতোই শক্তিশালী যে, আলোও তা থেকে মুক্তি পেতে পারেনা অর্থাৎ বেরোতে পারেনা। অর্থাৎ তার মুক্তিবেগ আলোর বেএর চেয়েও বেশী। তিনি এ ধরনের অনেক তারা থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছিলেন।

এই আবিষ্কারের সমসাময়িক কালে ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়ের-সিমোঁ লাপলাস একই ধরনের প্রস্তাবনা পেশ করেন। তবে তিনি তার "দ্য সিস্টেম অফ দ্য ওয়ার্ল্ড" বইয়ের কেবল ১ম ও ২য় সংস্করণেই এটি উল্লেখ করেছিলেন, পরবর্তী সংস্করণ থেকে তা বাদ দেন। তিনি হয়তো এটিকে অতিরিক্ত পাগলাটে ধারণা হিসেবে ভেবে থাকবেন। দুইটি কারণে এই চিন্তা পাগলের প্রলাপের মত শোনাচ্ছিল; প্রথমত, আলোর বেগ অসীম হলে তার উপর মহাকর্ষের কোন প্রভাব থাকতে পারেনা; দ্বিতীয়ত, আলোর বেগ সসীম এবং ধ্রুবক হলেও তাতে নিউটনীয় মহাকর্ষ কোন প্রভাব ফেলতে পারবেনা, কারণ নিউটনীয় মহাকর্ষে আলোকে কখনই ক্যানন বল হিসেবে বিবেচনা করা যাবেনা। প্রথম কারণটি অপসারিত হয় যখন ওলন্দাজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওলে রোমাঁ ১৬৭৬ সালে আলোর নির্দিষ্ট বেগ নির্ণয় করেন। আর দ্বিতীয় কারণটি অপসারিত হয় যখন আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে সাধারণ আপেক্ষিকতা আবিষ্কার করেন। ১৯১৫ সালের পর কৃষ্ণগহ্বর সংক্রান্ত সকল গবেষণা আবর্তিত হয় সাধারণ আপেক্ষিকতাকে কেন্দ্র করে।

সাধারণ আপেক্ষিকতা

এই তত্ত্ব অনুসারে অতি বৃহৎ কোন মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র স্থান-কালের বক্রকে বাঁকিয়ে দিতে পারে তথা আলোর গতিপথ পরিবর্তন করে দিতে পারে। নিউটনীয় মহাকর্ষে থেকে কৃষ্ণগহ্বরের কোন ব্যাখ্যা না পাওয়া গেলেও এবার সে সম্ভাবনা এসে যায়। তাই তারার জন্ম এবং বিবর্তন থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটনাগুলো পর্যারোচনার মাধ্যমে কৃষ্ণগহ্বর গবেষণা চলতে থাকে। এক্ষেত্রে তারার জীবনচক্র কিছুটা ব্যাখ্যা করে নিলে ভাল হবে। একটি বৃহৎ গ্যাসীয় (মূলত হাইড্রোজেন গ্যাস) মেঘ থেকে তারার জন্ম হয়। গ্যাসীয় মেঘটি যখন নিজের মহাকর্ষের চাপে নিজের কেন্দ্রের দিকে ধ্সে পড়তে শুরু করে তখন এর কণাগুলো একে অন্যকে আগের চেয়ে অনেক বেশি বেগে ধাক্কা দেয়। যার ফলে গ্যাস উত্তপ্ত হয়ে উঠে। একই সাথে মহাকর্ষের চাপে সংকোচন চলতে থাকে। তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেলে একটি সময় আসে যখন হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো একে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে আরও দূরে সরে না গিয়ে বরং একসাথে মিলে হিলিয়াম তৈরি করে ফেলে। এটি অনেকটা বড় ধরনের হাইড্রোজেন বোমার মত। এর ফলে শক্তি বিকিরিত হয় এবং এই শক্তির বিকিরণ চাপ ও তাপ শক্তি মহাকর্ষীয় সংকোচনকে বাঁধা দেয়। উভয়ের মধ্যে সাম্যাবস্থা আসলে প্রধান ধারার তারার সৃষ্টি হয়। অনেক দিন এভাবে চলার পর যখন তারার কেন্দ্রের সমস্ত জ্বালানি তথা হাইড্রোজেন নিঃশেষ হয়ে যায় তখন তারাটি ক্রমান্বয়ে শীতল হয়ে আবার সংকুচিত হতে থাকে। এ পর্যন্ত আসার পর কি ঘটে তা নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণার জন্যই বিজ্ঞানীরা সাধারণ আপেক্ষিকতার ক্ষেত্র সমীকরণের সমাধানসমূহ ব্যবহার করেন। এর মধ্যে চন্দ্রশেখরের গবেষণা ছিল বিশেষ তাৎপর্যময়।

চন্দ্রশেখর সীমা

১৯২৮ সালে ভারতীয় জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর ব্রিটেনের সনামধন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের অধীনে অধ্যয়নের জন্য কেমব্রিজে আসেন। ভারত থেকে ইংল্যান্ড আসার পথে জাহাজে বসে তিনি গাণিতিকভাবে চিন্তা করতে থাকেন, একটি তারার ভর সর্বোচ্চ কত হলে সব জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর তার মহাকর্ষীয় সংকোচন ঠেকানোর মত বল সৃষ্টি হতে পারে। তিনি দেখেন জ্বালানিবিহীন তারাটি সংকুচিত হতে হতে যখন অনেক ছোট হয়ে যাবে তখন এর কণাগুলো পরস্পরের অতি সন্নিকটে আসবে এবং একটি অপজাত অবস্থার সৃষ্টি হবে। পাউলির বর্জন নীতি অনুসারে একই অরবিটালের দুটি ইলেকট্রনের স্পিন ভিন্ন হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে যেহেতু পারমানবিক গঠন নেই, তাই অতি সন্নিকটে অবস্থিত অপজাত কণাই ইলেকট্রনের কাজটি করবে, অর্থাৎ তাদের গতিবেগ (স্পিনের বদলে) হতে হবে অনেক ভিন্ন। এর ফলে কণাগুলো একে অন্যের কাছ থেকে প্রবল বেগে দূরে সরে যাবে যা তারাকে প্রসারিত করার জন্য একটি বহির্মুখি বল প্রয়োগ করবে। এভাবে মহাকর্ষীয় সংকোচন ও অপজাত চাপের মধ্যে যে সাম্যাবস্থার সৃষ্টি হবে তার কারণে শ্বেত বামন তারার জন্ম হবে। অবশ্য চন্দ্র বুঝতে পেরেছিলেন, বর্জন নীতি একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্তই সাম্যাবস্থা রক্ষার মতো অপজাত চাপ সরবরাহ করতে পারে। সাধারণ আপেক্ষিকতা আলোর বেগকে সর্বোচ্চ বলে সব কণার বেগ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিল। তাই দেখা গেল, এক সময় বর্জন নীতির কারণে সৃষ্ট অপজাত চাপ মহাকর্ষীয় সংকোচন বলের কাছে হার মানবে। চন্দ্র হিসাব করে দেখেন, যে তারার ভর সূর্যের ভরের ১.৪ গুণের চেয়ে বেশী তার মহাকর্ষীয় সংকোচন বল অপজাত চাপের থেকে বেশী হবে এবং তারাটিকে রক্ষা করা সম্ভব হবেনা। এই সীমাটিকে চন্দ্রশেখর সীমা বলা হয়।

লান্দাউয়ের নিউট্রন তারা

ওপেনহাইমারের গবেষণা

পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আবিষ্কার

পর্যবেক্ষণ-উত্তর গবেষণা

তথ্যসূত্র

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.