শাহ কারামত আলী জৌনপুরী
হাদিয়ে বাঙ্গাল হযরত মাওলানা শাহ কারামত আলী জৌনপুরী (রহ.) ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দির উল্লেখযোগ্য সমাজ সংস্কারক, হানাফি মাযহাবের অনুসারী বিশিষ্ট ফকিহ ও সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী রহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তরিকায়ে মুহাম্মদিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রচারক। তিনি ওয়াজ নসীহত করে মানুষকে প্রকৃত ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি আহবান করতেন। তিনি মূলত বাংলা ও আসাম অঞ্চলে ধর্মপ্রচার করেন। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ৪০-এরও বেশি।
শাহ কারামত আলী জৌনপুরী | |
---|---|
জন্ম | ১২ জুন, ১৮০০ খ্রি. (১৮ মুহররম, ১২১৫ হিজরী) জৌনপুর, উত্তর প্রদেশ, ভারত |
মৃত্যু | ৩০ মে, ১৮৭৩ খ্রি. (৩ রবিউস সানি, ১২৯০ হিজরী) |
অন্যান্য নাম | মোহাম্মাদ আলী জৌনপুরী |
পেশা | ধর্ম প্রচারক ও সমাজ সংস্কারক |
উপাধি | হাদিয়ে বাঙ্গাল |
জন্ম ও বংশ
মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী ভারতের উত্তর প্রদেশের জৌনপুরের মোল্লাটোলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবু ইব্রাহিম শেখ মোহাম্মদ ইমাম বখশ (রহ.)। তিনি একজন তাপস ও ধর্মপ্রাণ লোক ছিলেন। তিনি ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র বংশধর ছিলেন। [1] তিনি ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুন, ১২১৫ হিজরীর ১৮ মুহাররাম জন্মগ্রহন করেন। জন্মের পর তার পিতা তার নাম রেখেছিলেন আল, কথিত আছে পরবর্তীতে তাঁর কারামত দেখে জনসাধারন তাকে কারামত আলী নামে অভিহিত করে। [2] তিনি তাঁর নিজের বইসমূহে নাম লিখতেন ‘আলী জৌনপুরী’ অথবা ‘আলী জৌনপুর মশহুর (খ্যাত) কারামআলী’ [3]
শিক্ষাজীবন
কারামত আলী জৌনপুরী তার পিতার নিকট প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর মওলানা কুদরতউল্লাহ রুদলভী ও আহমদউল্লাহ আল্লামীর নিকট নিকট পবিত্র হাদিস শরীফ ও অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেন। আঠারো বছর বয়সে কারামত আলী জৌনপুরী রহ. তাসাউফ (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) শাস্ত্রে আগ্রহী হয়ে রায়বেরিলীতে তরিকায়ে মুহাম্মদিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী রহ. এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার নিকট বাই’য়াত গ্রহণ করেন। [1]
কর্মজীবন
সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.) ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত মুজাহিদ। কারামত আলীও তার সাথে জিহাদে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু সাইয়েদ আহমাদ তাকে সশস্ত্র সংগ্রামের বদলে বাংলা ও আসাম অঞ্চলে ওয়াজ-নসীহত ও লেখনীর মাধ্যমে সমাজ সংস্কার ও ধর্মপ্রচারের নির্দেশ দেন। কারণ তৎকালীন সময়ে এসব অঞ্চলের সাধারণ মুসলমানরা ইসলাম ধর্মের আবশ্যকীয় কার্যক্রম যেমন নামাজ, রোজা ভুলে অন্য ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত। মুর্শিদের নির্দেশে কারামত আলী বাংলা ও আসাম অঞ্চলে ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারের কাজে লিপ্ত হন। [1][2] ইসলামের বিস্তারের লক্ষে তার একান্ন বছরের দাওয়াতী কাজের ফলে প্রায় ১ কোটি মানুষ ইসলামের ছায়াতলে এসেছেন বলে বর্ণিত হয়েছে।[4] এ দেশের ইসুলামী ও আরবী শিক্ষার ক্ষেত্রে তার অনন্য ভুমীকা রয়েছে। এ প্রসংগে বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে-
"এদেশে আরবি চর্চার ক্ষেত্রে যাঁদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে তাঁদের মধ্যে মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী অগ্রগণ্য। তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রচারক ও সমাজ সংস্কারক। তাঁর চল্লিশটি গ্রন্থের মধ্যে দাওয়াত মাস্নূনা দোয়া-কালাম সম্পর্কীয় রচনা। আরবি ও উর্দু ভাষায় এটি রচিত। মুলাখ্খাস ও বরাহীন কাত‘ইয়্যা ফী মওলূদি খায়রিল-বরিয়্যা গ্রন্থদ্বয় মওলূদ সম্পর্কে লিখিত এবং নসীমুল-হরমায়ন গ্রন্থে ইসলামী চিন্তাধারা ও তৎসম্পর্কিত মতবিরোধ আলোচিত হয়েছে।।[5]
ভ্রাম্যমাণ মাদ্রসা
কারামত আলী জৌনপুরীর কর্মজীবনের সিংহভাগ সময় ধর্মীয় প্রচারণামূলক কাজের স্বার্থে বাংলা ও আসাম অঞ্চলে নৌভ্রমণ করতে হতো। এ জন্য তিনি একটি ভ্রাম্যমাণ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ মাদ্রাসাটি ছিল বড় একটি নৌকার মধ্যে। শিক্ষার্থীরা নৌকাতেই থাকতেন, কারামত আলী জৌনপুরী তাদের ব্যয়ভার বহন করতেন এবং নিয়মিত শিক্ষাদান করতেন। [6]
সমকালীন রাজনীতিতে অবস্থান
কারামত আলী হাজী শরীয়তউল্লাহ প্রবর্তিত ফরায়েজি আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। ফরায়েজিরা ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষকে দারুল হরব হওয়ার অজুহাতে জুমা ও ঈদের নামাজ আদায় করত না। পক্ষান্তরে কারামত আলী মনে করতেন ভারতবর্ষ যদিও দারুল ইসলাম নয়, তবে দারুল হরবও নয়। বরং ভারতবর্ষ হচ্ছে দারুল আমান। কারণ ব্রিটিশরা মুসলমানদেরকে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে দেয়। এ বিষয়ে তিনি ফরায়েজিদের সাথে বিতর্ক করে তার মত প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। [1]
ইন্তেকাল
ওয়াজ নসীহত ও ধর্মপ্রচারের সুবাদে কারামত আলী রহ. নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, আসাম, রংপুর এবং আরও অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল সফর করেন। সফরকালীন অবস্থায় ১৮৭৩ সালে রংপুরে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মে তার ইন্তেকাল হয়। রংপুরে মুনশিপাড়া জামে মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়। [1][2]
উত্তরসূরী
কারামত আলী জৌনপুরী খলিফার সংখ্যা শতাধিক। তার ১৪ জন সন্তান-সন্তুতি ছিলেন। তাদের মধ্যে দুই ছেলে পরবর্তীতে তার কার্যক্রম অব্যহত রেখে খ্যাতি অর্জন করেন। তারা হলেন:
- মাওলানা হাফিজ আহমদ জৌনপুরী: তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন, এবং ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার চকবাজার তার মাজার রয়েছে। তিনি একজন বিশেষজ্ঞ আলেম এবং সুফি সাধক ছিলেন।
- মাওলানা হাফিজ আব্দুল আওয়াল জৌনপুরী: তিনিেএকজন বিখ্যাত আলেম ও ধর্মপ্রচারক ছিলেন। কলকাতায় তার মৃত্যু হয়।এ প্রসংগে বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে-
১৮৬৭ সালে চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী ও বাতুল বিবির পুত্র। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি কুরআন শরীফ মুখস্থ করেন। লক্ষৌন ও কলকাতায় অধ্যয়ন শেষে তিনি ১৮৮৭ থেকে ১৮৮৯ সাল পর্যন্ত মক্কায় সওলাতিয়া মাদ্রাসায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮৮৯ সালে জৌনপুর প্রত্যাবর্তনের পর বাংলাদেশে সমাজ সংস্কার, ইসলাম প্রচার ও মুসলিম মানস পুনর্গঠনে তিনি আত্মনিয়োগ করেন এবং মুসলমান সমাজে অনুপ্রবিষ্ট শির্ক-বিদাত দূর করার জন্য শহর-বন্দর-গ্রামে পরিভ্রমণ করেন। ধর্মীয় বক্তৃতা প্রদানের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে কুসংস্কার ও সামাজিক কদাচার থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালান।
আবদুল আউয়াল ছিলেন প্রতিভাবান লেখক। তিনি ইসলামের মৌল বিষয়সহ ইতিহাস, চরিতাভিধান, সুফিতত্ত্ব ও সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষায় মোট ১২১টি গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলির মধ্যে ৮৯টি প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে স্কুল ও মাদ্রাসা স্থাপন করেন। উনিশ শতকের প্রথমদিকে তিনি তাঁর পুত্র হাম্মাদ (মৃ. ১৩১৪ হি.)-এর নামানুসারে ঢাকার আরমানিটোলায় মাদ্রাসা-ই-হাম্মাদিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪০ সালে মাদ্রাসাটি স্কুলে রূপান্তরিত হয়। দেশ ও জাতির প্রতি কর্তব্য পালন ও অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ আবদুল আউয়াল ব্রিটিশ সরকার ও মুসলিম নওয়াবদের নিকট থেকে প্রশংসাপত্র লাভ করেন। ১৯২১ সালের ১৮ জুন তাঁর মৃত্যু হয় এবং কলকাতার মানিকতলায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।[7] [8]
রচনাবলী
হযরত মাওলানা কারামত আলী প্রায় ৪৬টি পুস্তক রচনা করেন। তন্মধ্যে মাত্র ১৯ টি পুস্তক তিন খন্ডে যখীরায়ে কারামত নামে প্রকাশিত হয়। অন্যান্য পুস্তকগুলো বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। তার রচিত যে সকল গ্রন্থ সম্পর্কে জানা যায়, তন্মধ্যে রয়েছে:
- মিফতাহুল জান্নাত
- জিনাতুল মুসল্লী
- জিনাতুল কারী
- শোরহে হিন্দি জজরি
- কাওকাবে দুররি
- তরজমায়ে শামায়েলে তিরমিজি
- তরজমায়ে মিশকাত
- আকায়েদে হাককা
- তাজকিরাতুল আকায়েদ
- মফিজুল হরূফ
- কাউলুচ্ছাবিত
- মাকামিউল মোবতাদিইন
- হাক্কুল ইয়াকিন
- বয়আত ও তাওবা
- কাউলুল আমীন
- মুরাদুল মুরীদীন
- কাউলুল হক
- মেরাতুল হক
- ইমতিনানুল কুলূব
- মোকাশিফাতে রহমাত
- মোলাখ্খাছ
- ফরজে আম
- হুজ্জাতে কাতেয়া
- নুরুল হুদা
- যা-দুত্তাকওয়া
- কিতাবে এস্তেকামাত
- নূরুন আলা নূর
- রাহাতে রূহ
- কুউওয়াতুল ঈমান
- ইহকাকুল হক
- রাফিকুচ্ছালিকীন
- তানবীরুল কুলূব
- তাজকিয়াতুন্নেছওয়ান
- নাছিমুল হারামাইন
- বারাহিনে কাতেয়া
- মৌলুদে খায়রুল বারিয়া
- কেরমাতুল হারামাইন
- কোররাতুল উইউয়ুন
- রেসালায়ে ফয়সোলা
- ওক্কাজাতুল মোমেনীন
- ফতহে বাবে ছবিয়ান
- দাওয়াতে মাজনুন। [2][3]
তথ্যসূত্র
- জৌনপুরী, কেরামত আলী, বাংলাপিডিয়া।
- উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলিমদের রাজনৈতিক জীবন, মাও. আবু বকর সিদ্দিক, খোশরোজ কিতাবমহল, পৃ.৩১-৪০)
- মুরাদুল মুরীদীন, আলহাজ্ব হযরত মাওলানা শাহ কারামত আলী জৌনপুরী রাহমাতুল্লাহ, কারা মতিয়া লাইব্রেরী এন্ড পাবলিকেশন চকবাজার ও বাংলাবাজার, ঢাকা। পৃ.৫-৬।
- Biographical encyclopedia of Sufis : South Asia, By N. Hanif, Page 189-190, Sarup & Sons Publishers,4740/23, Ansari Road, Daryaganj, New Delhi - 110002, India.2000
- http://bn.banglapedia.org/index.php?title=আরবি
- নদভী, মুজিবুল্লাহ (২০০৯)। তাযকেরায়ে হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (উর্দু ভাষায়)। রায়বেরেলি, ভারত: সায়্যিদ শহিদ একাডেমি। পৃষ্ঠা ৩৯–৪০।
- http://bn.banglapedia.org/index.php?title=জৌনপুরী,_আবদুল_আউয়াল
- নদভী, মুজিবুল্লাহ (২০০৯)। তাযকেরায়ে হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (উর্দু ভাষায়)। রায়বেরেলি, ভারত: সায়্যিদ শহিদ একাডেমি। পৃষ্ঠা ৫৫–৫৬।
- সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ১ম খন্ড, ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ