কাজী আয়াজ

কাজী আয়াজ (৪৭৬ হি: - ৫৪৪ হি:) (আরবি: القاضي عياض بن موسى; তার পূর্ণনাম : ইমাম আল্লামা কাজী আবুল ফজল আয়াজ বিন আমর বিন ইয়াহসাবি, সংক্ষেপে নামটি এভাবেও পরিলক্ষিত হয় ইমাম কাজী আয়াজ আন্দলুসী (রাহ)) হিজরি পঞ্চ শতকের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। তিনি ছিলেন হাফিজুল হাদিস ।[2] এবং ফকিহগণেরও অন্যতম। হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর প্রসংশা-স্তুতি ও মর্যাদা বর্ণনাকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম সারির আলিম। তার গোটাজীবন হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর দ্বীনের খেদমত এবং তার গুণকীর্তনে অতিবাহিত করেন। এরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় তার আল-শিফা গ্রন্থ অধ্যায়নের মাধ্যমে। সিরাতে রাসুলের উপর এই অনবদ্য গ্রন্থের জন্য ইলমি মহলে তিনি বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন বহু গ্রন্থ প্রণেতা। ফকিহ মুহাম্মদ বিন হামাদাহ সাবতি (রাহ) বলেল, কাজী আয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সময়কালে তার মতো এতো বিপুল গ্রন্থের সংকলক আর কেউ ছিলনা । তিনি নিজের নগরে এতোই সন্মানের অধিকারী ছিলেন, যা আর কারো ছিলনা । তার সেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তাকে আরো অধিক মাত্রায় বিনয়ী করে তোলে ।[3] ইবনে খাল্লিকান বলেন, - কাজী আয়াজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি হাদিস ও হাদিস শাস্ত্র, নাহু ও অভিধান-বিজ্ঞান, আরবি ভাষা এবং আরবের ইতিহাস ও বংশধারা সংক্রাত জ্ঞানে সমসাময়িক কালের ইমাম ছিলেন । [4]

কাজী আয়াজ
ধর্মইসলাম
ব্যক্তিগত
জন্ম১০৮৩
সাবতাহ
মৃত্যু১১৪৯
মারাকেশ, মরক্কো[1]

জন্ম ও বংশধারা

তিনি স্পেন ও মরক্কোর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত 'সাবতাহ' নগরীতে ৪৭৬ হিজরিতে [5][6] ইংরেজি সালের হিসেব অনুযায়ী ১০৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। তার জন্ম সাল সম্পর্কে একাধিক বর্ণনা পাওয়া যায়। এক বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে তিনি ৪৪৬ হিজরিতে জন্ম গ্রহণ করেন।[7] অপর আরেকটি বর্ণনার অভিমত হলো - ৪৯৬ হিজরির শাবান মাসের মধ্য ভাগে তার জন্ম হয়। [8] 'কাজী আয়াজ-এর পূর্বপুরুষ স্পেনের অধিবাসী ছিল। তার দাদা প্রথমে মরক্কোর 'ফেজ' নগরীতে স্থানান্তরিত হন। পরবর্তীতে 'সাবতাহ'-এ বসবাস করতে শুরু করেন। [9] জন্মের পর কাজী আয়াজ এখানেই লালিত পালিত হন। এজন্য তাকে 'সাবাতী'-ও বলা হয়।

শিক্ষার্জন

প্রথম জীবনে তিনি তার শহরের উলামা মাশায়েখদের থেকে 'ইলম' অর্জন করেন।[10] জ্ঞানার্জনের জন্য তিনি হাফিজে হাদিস কাজী আবু আলী গাসসানী (রাহ) এর সান্নিধ্য গ্রহণ করেন।, গভীর অধ্যাবসায়ে তার থেকে তিনি জ্ঞান অর্জন করেন। কাজী আবু আলী গাসসানীর ইন্তেকালের পর কাজী আয়াজ জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে স্পেনে চলে যান। সেখানকার তৎকালীন বড় বড় মনীষীদের কাছ থেকে ইলমে হাদিস ও অন্যান্য জ্ঞান অর্জন করে তার জ্ঞানের ভান্ডারকে আরও সমৃদ্ধিশীল করতে সক্ষম হন। কাজী আয়াজের শিক্ষক যারা ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন -

  • মুহাম্মদ বিন হামদাইন আবু আলী বিন সাকরাহ
  • আবুল হুসাইন সিরাজ
  • আবু মুহাম্মদ বিন ওসমান
  • হিশাম বিন আহমদ
  • আবু বাহর বিন আল-আস প্রমুখ।

এছাড়া আরও উল্লেখ্য যে, তিনি ফিকহ শাস্ত্রে আবু আবদুল্লাহ বিন ঈসা তামিমী ও কাজী আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল মুসবিল-এর নিকট থেকে জ্ঞান অর্জনে ফায়দা লাভ করেন।[11] উল্লেখযোগ্যের তালিকায় তার আরও কয়েকজন শিক্ষকের নাম পাওয়া যায় - যাদের কাছ থেকে তিনি ইলমে হাদিস সহ বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করেন  :

  • আবু মুহাম্মদ বিন ইতাব[11] (ইবন আত্তাব)[10]
  • ইবনে আরশাদ[12] (ইবন রুশদ) [13]
  • ইবনুল হজ্জ ও
  • আবু আলী সাদাফী[13]

বিচারকের পদ

কাজী আয়াজ (রাহ) সাবতায় বিচারকের পদ লাভ করেন এবং সেখানে তিনি কিছুকাল বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি গ্রানাডার বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন।[14] সুবিজ্ঞ ফকিহ মুহাম্মদ বিন হামাদাহ সাবতি বলেন, কাজী আয়াজ ২৮ বছর বয়সে বিতর্কে অংশ নেন। আর তার বয়স যখন ৩৫, তখন তিনি বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত হন।[15]

প্রণীত গ্রন্থ সমুহ

  • আশ-শিফা বিতা'রিফি হুকুকিল মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
  • তারতিবুল মাদারিক ওয়া তাকরিবিল মাসালিক ফি যিকরি ফুকাহায়ি মাযহাবি মালিক
  • আল-আকিদাহ
  • শারহু হাদিসি উম্মি জারই
  • জামেউত তারিখ

এই পুস্তকটি স্পেন ও পাশ্চাত্যের নৃপতিদের ইতিহাস সম্বলিত। এতে 'সাবতাহ'-এর ইতিহাস সহ সেখানকার আলিমদের কথাও লিপিবদ্ধ হয়েছে।

  • মাশারিকুল আনওয়ার ফি ইকতিফায়ি সহিহিল আসার

এই বইটি মুয়াত্তা ইমাম মালেক, বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফের ব্যাখ্যা গ্রন্থের সমার্থক।

  • ইকমালুল মুয়াল্লিম ফি শারহি মুসলিম

এটা ইমাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ বিন আলী আল মা-জরি (মৃত্যুঃ ৫৩৬ হি:) এর প্রণীত মুসলিম শরিফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ - আল মুয়াল্লিম বি ফাওয়ায়িদি কিতাবি মুসলিম ।

  • আত-তানবিহুল মুসতানবিতাহ ফি শারহি মুশকিলাতিল মুদাভভিনাহ ওয়াল মুখতালিতাহ

এটি হাদিস শাস্ত্রে প্রণীত। এতে ইমাম আবু আবদুল্লাহ আবদুর রহমান বিন আল-কাসিম (৯১ হি:) এর রচিত - আল মাদুনাহ ফি ফুরুয়িল মালেকিয়া গ্রন্থের কিছু কিছু বিষয়ে আপত্ত্বিও বর্ণিত হয়েছে।[] গ্রন্থটি তামবিহাত নামেও প্রসিদ্ধি লাভ করে। শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভি (রাহ) বলেন, - এই শাস্ত্রে এটার মতো আর কোনো গ্রন্থ রচিত হয়নি । [ ]

  • আল-ই'লাম বিহুদুদি কাওয়ায়িদিল ইসলাম
  • আল-গুনিয়াহ

এটি কাজী আয়াজের শায়খ ও শিক্ষাগুরুদের আলোচনা সম্বলিত।

  • আল-ইলমা'উ ফি যবতির রিওয়ায়াতি ওয়া তাকায়্যিদুস সিমাই
  • আল-মু'জামু ফি শারহি ইবনি সাকরা

ইহা হযরত শায়খ আবু আলী আল-হুসাইন বিন মুহাম্মদ আস-সারকাসতি আল-আন্দলুসী আস-সাদাফি (মৃত্যু : ৫১৪ হিঃ) এবং তার শায়খগণের আলোচনা সম্বলিত পুস্তক। [16]

  • নিজামুল বুরহান আলা সুবহাতি জাযমিল আযান
  • মাকাসিদুল হাসসান ফি মা ইয়ালযিমুল ইনসান
  • গুনিয়াতুল কাতিব ওয়া বুগিয়াতুত তালিব ।[17]
  • আল উয়ুনুস সানাহ ফি আখবারিস সাবতাহ । [18]
  • আল আজওয়াবাতুল মুখায়্যারাহ আনিল আস আলাতিল মুহায়্যারাহ
  • আখবারুল কারতাবিয়্যিন
  • আস সাইফুল মাসলুল আলা মান সাব্বা আসহাবার রাসুল
  • আস সাফা বি তাজরীরিশ শিফা
  • মাতালিহুল আফহাম ফি শারহিল আহকাম ।[19]
  • গারীবুশ শিহাব । [20]

মৃত্যু

তিনি ৫৪৪ হিজরিতে - ইংরেজি ১১৪৯ খ্রিষ্টাব্দে মরক্কোয় পরলোক গমন করেন।

তথ্যসূত্র

  1. Mohammed Sijelmassi, André Miquel, Royal Illuminated manuscripts of Morocco, p.62,
  2. বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন - শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভি ।
  3. তাযকিরাতুল হুফফাজ ৪র্থ খন্ড, ৯৭ পৃ: - আয-যাহাবি ।
  4. ইবনে খাল্লিকান : ওয়াফাতুল আইয়ান, ৩য় খন্ড, ৪৮৩ পৃ:, দারুস সাকাফা, বইরুত থেকে মুদ্রিত ।
  5. মোল্লা আলী ক্বারী : শরহুস সিফাত ।
  6. আল্লামা হুফফাজি : নাসিমুর রিয়ায ।
  7. শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভি  : বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন, পৃ: ৩৪৬ ।
  8. ইমাম নববী : তাহযীবুল আসমায়ি ওয়াল লুগাত, পৃঃ ৪৪ ।
  9. শামসুদ্দিন আবু আব্দুল্লাহ আয-যাহাবী : তাযকিরাতুল হুফফাজ, ৪র্থ খন্ড, ৯৬ পৃঃ।
  10. আবদুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভি : বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন, বাংলা অনুবাদ : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃঃ
  11. শামসুদ্দীন আবু আবদুল্লাহ আয-যাহাবি : তাযকিরাতুল হুফফাজ ৪/৯৬।
  12. আশ শিফা বাংলা অনুবাদ
  13. আবদুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভি : বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন, বাংলা অনুবাদ : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃঃ ২৮৬ ।
  14. মুহাম্মদ ফরিদ ওয়াজদী : দায়েরায়ে মা'রিফুল কুরআন , ৬/৭৯৪ , বৈরুত থেকে মুদ্রিত ।
  15. ইমাম আয-যাহাবি : তাযকিরাতুল হুফফাজ, ৪/৯৭ ।
  16. হাজী খলিফা : কাশফুজ জুনুন, ২/১৭৩৬ ।
  17. আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিস দেহলভি  : বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন, পৃষ্ঠাঃ৩৪৫ ।
  18. উমর রেযা কুহহালা : মু'জামুল মুয়াল্লিফীন, ৮ম খন্ড, ১৬ পৃষ্ঠা, মাকতাবাতুল মুসান্না, বইরুত ।
  19. ইসমাঈল পাশা বাগদাদী : হাদিয়াতুল আরেফীন , ১ম খন্ড, ৮০৫ পৃষ্ঠা, মাকতাবাতুল মুসান্না, বইরুত ।
  20. হাজী খলীফা : কাশফুজ জুনুন, ২/১২০৭ ।
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.