কাঁকন বিবি

কাঁকন বিবি (২১ মার্চ, ২০১৮) ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীরযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও গুপ্তচর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি পাকিস্তানী বাহিনীর বিপক্ষে মুক্তিবাহিনীর হয়ে ৫ নং সেক্টরের গুপ্তচরের কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।[1][2] তবে এ বিষয়ে সরকারি ভাবে কোন গ্যাজেট প্রকাশিত হয়নি। তার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার লীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে।[3]

কাঁকন বিবি
মৃত্যুমার্চ ২১, ২০১৮(২০১৮-০৩-২১)
জাতীয়তাবাংলাদেশী
অন্যান্য নামকাঁকাত হেনিনচিতা
নাগরিকত্ব পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)
 বাংলাদেশ
পরিচিতির কারণবীরাঙ্গনা, মুক্তিযোদ্ধা
পুরস্কারবীর প্রতীক

ব্যক্তিজীবন

কাঁকন বিবি, আসল নাম কাঁকাত হেনিনচিতা। তিনি মুক্তিবেটি নামে পরিচিত।উপজাতি খাসিয়া। খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল বাড়ি ছিল ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশের এক গ্রামে। ১৯৭০ সালে দিরাই উপজেলার শহীদ আলীর সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার নাম পরিবর্তিত হয় এবং তার নতুন নাম হয় নুরজাহান বেগম। ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ তিনি এক কন্যাসন্তানের (সখিনা) জন্ম দেন। কন্যাসন্তান জন্মদেবার ফলে স্বামীর সাথে তার মনোমালিন্য দেখা দেয় এবং এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে মৌখিক ছাড়াছাড়ি হয়। পরবর্তীতে এপ্রিল মাসে তার সাথে ইপিআর সৈনিক মজিদ খানের বিয়ে হয়। মজিদ তখন কর্মসূত্রে সিলেট ইপিআর ক্যাম্পে থাকতেন। দুই মাস সিলেটে স্বামীর সাথে বসবাস করার পরে তিনি পূর্বের স্বামীর ঘর থেকে সখিনাকে আনতে যান। মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসার পরে তিনি স্বামীকে না পেয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তার স্বামী বদলি হয়ে দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকার কোন এক ক্যাম্পে আছেন।[1][4]

যুদ্ধকালীন জীবন

স্বামীকে খুঁজতে বের হন তিনি। সীমান্তবর্তী ঝিরাগাঁও গ্রামে জনৈক শহীদ আলীর আশ্রয়ে শিশুকন্যাকে রেখে দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলা ক্যাম্পে যান তিনি। ১৯৭১ সালের জুন মাস তখন। পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন, তাদের বাঙ্কারে দিনের পর দিন অমানুষিকভাবে নির্যাতন করে তাকে ছেড়ে দেয় তারা। এরপরেই কাকন বিবি স্বামীকে পাবার আশা ত্যাগ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হবার তাড়না লাভ করেন। জুলাই মাসে তার সাথে দেখা হয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে দেখা করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী তার সাথে সেক্টর কমাণ্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকতের সাথে দেখা করিয়ে দেন। তার উপর দায়িত্ব পড়ে গুপ্তচর হিসেবে বিভিন্ন তথ্য জোগাড় করার। তিনি অসমসাহসিকতার সাথে বিভিন্ন রূপে পাকিস্তানীদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ করেন। তার সংগৃহীত তথ্যের উপর ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সফল আক্রমণ চালান।[1]

গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়েই দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাক বাহিনীর হাতে পুনরায় ধরা পড়েন তিনি। এবারে একনাগাড়ে ৭ দিন পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকারেরা তাকে বিবস্ত্র করে তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। লোহার রড গরম করে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছেঁকা দেয়া হয়। মৃত ভেবে অজ্ঞান কাকন বিবিকে পাক বাহিনী ফেলে রেখে যায়। কয়েকদিন পরে জ্ঞান ফিরে আসলে তাকে উদ্ধার করে বালাট সাবসেক্টরে নিয়ে আসা হয়। সুস্থ হয়ে তিনি পুনরায় ফিরে আসেন বাংলাবাজারে। অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত হন মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে। এর পরবর্তীকালে তিনি সম্মুখ যুদ্ধ আর গুপ্তচর উভয় কাজই শুরু করেন।[1] এরপরে প্রায় ২০টি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি।[2] ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলায় পাক সেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। এই যুদ্ধে তার দেহে কয়েকটি গুলি বিদ্ধ হয়। আজও উড়ুতে কয়েকটি গুলির চিহ্ন রয়ে গেছে।[1]

পরবর্তী জীবন

দেশ স্বাধীন হলে কাকন বিবি দোয়ারাবাজার উপজেলার লীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে এক ব্যক্তির কুঁড়েঘরের বারান্দায় মেয়ে সখিনাসহ আশ্রয় নেন। এর পরের প্রায় ২ যুগ তিনি ছিলেন সবার চোখের অন্তরালে। ১৯৯৬ সালে স্থানীয় সাংবাদিক বিষয়টি সকলের গোচরে নিয়ে আসলে দেশব্যাপী এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে এক একর খাস জমি প্রদান করেন। সিলেটের মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান তাকে ঐ জায়গার ওপরে একটি ছোট কুঁড়েঘর নির্মাণ করে দেন। এরপরের কয়েক বছর মোটামুটি ভাল কাটলেও পরবর্তীকালে অর্থাভাবে নিয়মিত চিকিৎসা করাতেও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় তাকে।[1]

১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী তাকে বীরপ্রতীক উপাধীতে ভূষিত করার ঘোষণা দেন।[1] কিন্তু আজও তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি।[4]

মৃত্যু

ব্রেন স্ট্রোক করে ২০১৭ সালের ২১ জুলাই ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কাঁকন বিবি। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। ২০১৮ সালের ২০ মার্চ গুরুতর অসুস্থাবস্থায় তিনি ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন।মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর । [5] ২১ মার্চ বুধবার রাত ১১টা ৫ মিনিটে এখানেই মৃত্যুবরণ করেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা।[6]

বহিঃসংযোগ

  1. "গুপ্তচর কাকন বিবি"দৈনিক মানবজমিন
  2. "Constitutional recognition of indigenous people demanded"দ্য ডেইলি স্টার (বাংলাদেশ)। সংগ্রহের তারিখ ৩০ জুন ২০০৯
  3. "কাকন বিবির গল্প"দৈনিক জনকণ্ঠ। ২০১৬-০৩-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ জানুয়ারি ২০১২
  4. "বীরপ্রতীক উপাধির স্বীকৃতি চান কাকন বিবি"দৈনিক যুগান্তর। সংগ্রহের তারিখ ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪
  5. "মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি গুরুতর অসুস্থ"একুশে টিভি। ২০ মার্চ ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ২২ মার্চ ২০১৮
  6. "বীর মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি আর নেই"একুশে টিভি। ২২ মার্চ ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ২২ মার্চ ২০১৮
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.