এরিক ফন দানিকেন

এরিক আন্তন পল ভন ডেনিকেন (জ. এপ্রিল ১৪, ১৯৩৫) সুইজারল্যান্ডের একজন লেখক যিনি প্রাগৈতিহাসিক মানব সংস্কৃতিতে বহির্জাগতিকদের প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ লিখে বিখ্যাত হয়েছেন। তার এই বইগুলোর মাধ্যমেই বর্তমান যুগে নিউ এইজ আন্দোলনের গতিময়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কয়জন ব্যক্তি আধুনিক যুগে প্যালিওকনটাক্ট এবং প্রাচীন মহাকাশচারী তত্ত্বকে (ancient astronaut theory) জনপ্রিয় করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। দানিকেন ছাড়াও অনেকে এই বিষয় নিয়ে এখন লিখছেন। কিন্তু কেউই তার মত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি। এ বিষয়ে গবেষণার অন্যতম সংগঠন আরকিওলজি, অ্যাস্ট্রোনটিক্‌স অ্যান্ড সেটি রিসার্চ এসোসিয়েশন (Archaeology, Astronautics and SETI Research Association - AAS RA)-এর অন্যতম সহ-সংগঠক তিনি। সুইজারল্যান্ডের Interlaken নামক স্থানে তিনি একটি থিম পার্ক প্রতিষ্ঠা করেছেন যার নাম মিস্টারি পার্ক। এই পার্কটি ২০০৩ সালের মে ২৩ তারিখে উন্মুক্ত হয় এবং ২০০৬ সালের নভেম্বর ১৯ তারিখে আবার বন্ধ হয়ে যায়।

এরিক ফন ডেনিকেন

জীবনী

ফন দানিকেন ১৯৩৫ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখে সুইজারল্যান্ডের জোফিনজেন নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সেখানকার Fribourg-এ অবস্থিত সেন্ট-মিকেল কলেজে পড়াশোনা করেন। কলেজ জীবনেই তিনি প্রাচীন পবিত্র গ্রন্থ ও পুঁথি অধ্যয়ন শুরু করেছিলেন। পড়াশোনা শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কর্মজীবনের এক পর্যায়ে সুইস ফাইভ-স্টার হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পান। এই দায়িত্ব পালনকালে তিনি তার প্রথম বই লিখেন যার নাম ছিল চ্যারিয়ট্‌স অফ দ্য গড্‌স। এই বইটি অল্প সময়ের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং এর পরও আরও ৩৮টি দেশে সর্বোচ্চ বিক্রিত বইয়ের তালিকায় স্থান পেয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার এই বইয়ের উপর একটি টিভি অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয় যার নাম ছিল In Search of Ancient Astronauts। এর ফলে তার সুখ্যাতি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।[1]

১৯৯৩ সালে জার্মানির টিভি স্টেশন স্যাট-১ ২৫ পর্বের একটি টিভি ধারাবাহিক সম্প্রচার শুরু করে যার মূল চরিত্র ছিলেন দানিকেন এবং পরিচালনার ভারও ছিল তার উপর। এই ধারাবাহিকের নাম ছিল Auf den Spuren der All-Mächtigen (ঈশ্বরের চলাচলের পথসমূহ)। ১৯৯৬সালে আমেরিকার টিভি চ্যানেল এবিসি/কেইন এক ঘণ্টার একটি বিশেষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যার নাম ছিল Chariots of the Gods - The Mysteries Continue, সমগ্র বিশ্বব্যাপী এটি প্রচার করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর এটি সম্প্রচার করা হয়েছিল। ১৯৯৬-৯৭ সালে এবিসি/কেইন ফন দানিকেনকে নিয়ে আরেকটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করে যা ডিসকাভারি চ্যানেলেও দেখানো হয়েছিল। জার্মানির বৃহত্তম টিভি নেটওয়ার্ক আরটিএল ১৯৯৬ সালের ২৬ নভেম্বর তারিখে এই চলচ্চিত্রটি সম্প্রচার করে। শুধু জার্মানিতেই প্রায় ৭.৭ মিলিয়ন লোক এটি দেখেছিল। ফন দানিকেন বর্তমানে এবিসিআরটিএল-এর সাথে বিভিন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণ করে থাকে।

ফন দানিকেন অদ্যাবধি পৃথিবীর ২৫টি দেশে সর্বমোট ৩,০০০টি বক্তৃতা দিয়েছেন যার মধ্যে ৫০০ টি বক্তৃতা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া। এছাড়া তিনি প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০০,০০০ মাইল ভ্রমণ করেন যা তার গবেষণার প্রমাণ সংগ্রহে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তিনি সুইস রাইটার্স এসোসিয়েশন, জার্মান রাইটার্স এসোসিয়েশন এবং আন্তর্জাতিক পেন-ক্লাব-এর সদস্য। তিনি বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের ছোট্ট পর্বতসংকুল গ্রাম Beatenberg-এ থাকেন। এই গ্রামটি বার্ন থেকে ৪০ মাইল দূরে এবং আন্টারলাকেন শহরের উপর অবস্থিত। ২০০৩ সালে এই ইন্টারলাকেন শহরেই ফন দানিকেনের উদ্যোগে Mysteries of the World Theme Park-এর যাত্রা শুরু হয়। এটি স্থাপিত হয়েছিল মূলত পৃথিবীর রহস্য নিয়ে গবেষণা করার একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে। এখানে প্যালিও-সেটি এবং প্রাচীন মহাকাশচারী তত্ত্ব নিয়েও গবেষণা হতো। কিন্তু ২০০৬ সালের ১৯শে নভেম্বর এই থিম পার্কটি বন্ধ হয়ে যায়।

এরিক ফন দানিকেন ওয়ার্ল্ড মিস্টারিস ফোরামে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে তিনি সহকর্মীদের সাথে মিলে আরকিওলজি, অ্যাস্ট্রোনটিক্‌স অ্যান্ড সেটি রিসার্চ এসোসিয়েশন (এএএস আরএ) নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠন থেকে নিয়মিত লিজেন্ডারি টাইম্‌স নামে একটি ইংরেজি সাময়িকী প্রকাশিত হয়। এতে প্যালিও-সেটির উপর সর্বশেষ গবেষণার সংবাদ পরিবেশন করা হয়। দানিকেন ১৯৬০ সালে Elisabeth Skaja-কে বিয়ে করেছিলেন। তার এক মেয়ে রয়েছে যে ১৯৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেছিল। তার মেয়ের ঘরের দুই নাতিও রয়েছে।

চিন্তাধারা ও রচনাসমূহ

এরিক ভন দানিকেনের সর্বশেষ যে বইটি প্রকাশিত হয়েছে তার নাম The Gods Were Astronauts: Evidence of the True Identities of the Old 'Gods"। এই বইটিতে ফন দারিকেন একটি বিশেষ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন যা তিনি বিভিন্ন প্রমাণাদির সাপেক্ষে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রশ্নটি ছিল, প্রাচীন ও আধুনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে যে ঈশ্বরের কথা বলা হয়, তিনি আসলে কে? ফন দানিকেনের উত্তর হচ্ছে ঈশ্বর এমন কোন অসীম সত্তা নয় যিনি মানব অনুভূতি ও কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন (সাধারণ পুরাণ ও ধর্মে যেভাবে বলা হয়), বরং ঈশ্বর হল সেইসব বহির্জাগিতকেরা যারা পৃথিবীতে তাদের ভ্রমণের প্রমাণ রেখে গেছ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে। অর্থাৎ অনেক আগে তারা অন্য কোন গ্রহ থেকে পৃথিবীতে এসেছিল। এই সিদ্ধান্ত উপনীত হওয়ার আগে দানিকেন পৃথিবীর প্রায় সকল পুরাণ ও ধর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন, এর পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো ছিটানো প্রমাণাদি সংগ্রহেও প্রভূত সময় ব্যয় করেছেন।

দানিকেনের বিভিন্ন গ্রন্থ পৃথিবীর ৩২ টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৬৩ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। তার বইগুলোর উপর ভিত্তি করে দুইটি পূর্ণদৈর্ঘ ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র নির্মীত হয়েছে: চ্যারিয়ট্‌স অফ দ্য গড্‌স এবং ম্যাসেজ অফ দ্য গড্‌স

এরিক ফন দানিকেনের অধিকাংশ বই বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন শ্রী অজিত দত্ত। যার মধ্যে "দেবতা কি গ্রহান্তরের মানুষ", "নক্ষত্রলোকে প্রত্যাবর্তন", "বীজ ও মহাবিশ্ব", "আমার পৃথিবী", "আবির্ভাব", "প্রমাণ", "প্রাগিতিহাসের ঋষি", "দেবতার গোধূলিবেলা", "দেবতার চাতুর্য" ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শ্রী অজিত দত্তের সহজবোধ্য অনুবাদের ফলে বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে এরিক ফন দানিকেনের তত্ত্ব খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে।

সমালোচনা

জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী কার্ল সেগান এবং Iosif Shklovsky প্রাগৈতিহাসিক কালে এলিয়েনদের পৃথিবী ভ্রমণ এবং তার বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে দানিকেনের রচনার সমালোচনা করেছেন। সেগান এলিয়েনদের ভ্রমণের বিষয়টিকে একেবারে উড়িয়ে দেননি, তার মতে এমন কিছু অতীতে ঘটে থাকতেই পারে, কিন্তু তার কোন প্রমাণ নেই। দানিকেন যেসব প্রমাণ সরবরাহ করেছেন সেগুলোকে সেগান অপ্রতুল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার বিখ্যাত উক্তি, "Extraordinary claim needs extraordinary evidence" এর আওতায় দানিকেনের লেখাগুলোও পড়ে। দানিকেনের দাবিগুলো সাধারণ বৈজ্ঞানিক চিন্তার বাইরে, অর্থাৎ প্রায় অতিলৌকিক কিছু, কিন্তু সেটা প্রমাণ করার জন্য যে ধরনের অনন্যসাধারণ নমুনা প্রয়োজন তা দানিকেন সরবরাহ করতে পারেননি।[2]

দানিকেন তার "চ্যারিয়টস অফ গডস?" বইয়ে দাবী করেছিলেন ভারতের ঐতিহাসিক কুতুন মিনারের পাশে অবস্থিত প্রাচীন কালের যে লৌহস্তম্ভটি রয়েছে তা মনুষ্য নির্মিত নয়, কারণ এতে কোন জং ধরে না। কিন্তু পরে এক সাময়িকীতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই স্বীকার করেন যে, লৌহস্তম্ভটি আসলে জং ধরা এবং তা মানুষের পক্ষেই বানানো সম্ভব ছিল।[3]

গ্রন্থ তালিকা

১৯৬৮, Chariots of the Gods? (পুন্টাম অ্যান্ড ব্যান্টাম বুক্‌স)
১৯৭০, Gods from Outer Space (পুন্টাম অ্যান্ড ব্যান্টাম বুক্‌স)
১৯৭২, The Gold of the Gods (পুন্টাম অ্যান্ড ব্যান্টাম বুক্‌স)
১৯৭৩, In Search of Ancient Gods (পুন্টাম অ্যান্ড ব্যান্টাম বুক্‌স)
১৯৭৪, Miracles of the Gods (পুন্টাম অ্যান্ড ব্যান্টাম বুক্‌স)
১৯৭৭, According to the Evidence (পুন্টাম অ্যান্ড ব্যান্টাম বুক্‌স)
১৯৭৮, Im Kreuzverhör
১৯৭৯, Signs of the Gods? (পুন্টাম অ্যান্ড ব্যান্টাম বুক্‌স)
১৯৮১, Pathways to the Gods (পুন্টাম অ্যান্ড ব্যান্টাম বুক্‌স)
১৯৮২, The Gods and Their Grand Design (পুন্টাম অ্যান্ড ব্যান্টাম বুক্‌স)
১৯৮৩, Ich liebe die ganze Welt
১৯৮৪, Der Tag an dem die Götter kamen
১৯৮৫, Habe ich mich geirrt?
১৯৮৭, Wir alle sind Kinder der Götter
১৯৯০, Die Spuren der Ausserirdischen
১৯৯১, Die Steinzeit war ganz anders
১৯৯১, Die Rätsel im alten Europa
১৯৯২, Der Götterschock
১৯৯৩, Raumfahrt im Altertum
১৯৯৩, Das Erbe von Kukulkan
১৯৯৪, Auf den Spuren der All-Mächtigen
১৯৯৬, The Eyes of the Sphinx (বার্কলি বুক্‌স, New York)
১৯৯৭, The Return of the Gods - Evidence of Extraterrestrial Visitations (এলিমেন্ট বুক্‌স, লন্ডন ও নিউইয়র্ক)
১৯৯৮, The Arrival of the Gods - Revealing the Alien Landing Sites of Nazca (এলিমেন্ট বুক্‌স, লন্ডন ও নিউইয়র্ক)
২০০০, Odyssey of the Gods - An Alien History of Ancient Greece (এলিমেন্ট বুক্‌স, লন্ডন ও নিউইয়র্ক)
২০০২, The Gods Were Astronauts: Evidence of the True Identities of the Old 'Gods" (Vega Books, London)
২০০৫, Astropolis feat Erich von Däniken Music CD
২০০৫, Mysteries Order now!
২০০৫, Tomy und der Planet der Lüge

পুরস্কার ও সম্মাননা

  • স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ বলিভিয়া কর্তৃক সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ।
  • পেরুর Ica এবং Nazca শহর দুইটি থেকে Huesped Illustre পুরস্কার লাভ।
  • ব্রজিলের সম্মানসূচক পুরস্কার Lourenço Filho
  • জার্মান সরকার কর্তৃক Order of Gordon Bleu du Saint Esprit (জার্মান মহাকাশচারী Ulf Merbold-এর সাথে যৌথভাবে)।
  • ২০০৩ সালে পৃথিবীর বিস্ময় খ্যাত থিম পার্ক বিনির্মাণের জন্য আইডিয়াস অস্কার

তথ্যসূত্র

  1. http://www.daniken.com/e/index.html ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৮ এপ্রিল ২০০৭ তারিখে, এরিক ফন দানিকেনের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে তার জীবনী অংশ থেকে। সেখান থেকে তথ্য নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে।
  2. Carl Sagan, Cosmos, অধ্যায় - Encyclopedia Galactica.
  3. Playboy magazine, Volume 21 Number 8, 1974

আরও দেখুন

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.