আর্-রাহীকুল মাখতূম
আর্-রাহীকুল মাখতূম (আরবী/উর্দূতে: الرحيق المختوم ; অর্থ: মোহরান্কিত জান্নাতী সুধা) আরবী এবং উর্দূ ভাষায় সফিউর রহমান মোবারকপুরী রচিত মুসলমানদের নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লা-হু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-য়ের জীবনীগ্রন্হ। আধুনিক যুগে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা: এর জীবনী নিয়ে আরবী ভাষায় লেখা অন্যতম একটি সীরাত গ্রন্থ। আরবী বইটি ১৯৭৯ সালে রাবেতায়ে আলাম আল ইসলামী কর্তৃক আয়োজিত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লা-হু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবনীর উপর আয়োজিত প্রথম উন্মুক্ত সিরাত গ্রন্হ প্রতিযোগিতায় ১১৮৭ টি পান্ডুলিপির মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। [1][2] এ গ্রন্থটি মূলতঃ সীরাত এর ওপর রচিত অতীতের শত শত গ্রন্থের মৌলিক ও নির্ভরযোগ্য উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। এক কথায় সীরাত সংক্রান্ত বিশাল সংগ্রহসালার একটি নির্যাস গ্রন্থ।
![]() তাওহিদ পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত আর্-রাহীকুল মাখতূমের বাংলা সংস্করণের প্রচ্ছদ | |
লেখক | সফিউর রহমান মোবারকপুরী |
---|---|
দেশ | ভারত |
ভাষা | বাংলা |
ধরন | জীবনী |
প্রকাশিত | ১৯৭৯(দারুস-সালাম প্রকাশনী) |
মিডিয়া ধরন | মুদ্রণ |
পৃষ্ঠাসংখ্যা | ৪৪০ পৃ. |
আইএসবিএন | 1-59144-070-X |
বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল (সাঃ)-কে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন-ই উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। যিনি স্বয়ং তার ফেরেশতাদের নিয়ে রাসূলের নামে দরূদ ও সালাম পাঠান। তিনিই তার প্রিয় রাসূলকে ভালোবাসার জন্য আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলের আনুগত্যের মাধ্যমেই মহান আল্লাহ তা’য়ালাকে ভালোবাসার প্রমাণ এবং মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি বলে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন কুরআনুল কারীম-এ ঘোষণা দিয়েছেন।
রাসূলের সুন্নাহ হচ্ছে এক জীবন্ত ও সর্বোত্তম আদর্শ। কিয়ামত পর্যন্ত এ আদর্শের আবেদন, এ আদর্শের বর্ণনা এবং এ আদর্শ সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা অব্যাহত থাকবে। কারণ, রাসূলের আদর্শের মাঝে রয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতের আলো। আল্লাহর রাসূলের কাজ ও চরিত্রই হচ্ছে তাঁর সীরাত। কুরআনের প্রতিচ্ছবি, সকল মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও পরিপূর্ণ, সমগ্র মাখলুকের ভালোবাসা পাওয়ার উপযুক্ত এমন মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি যুগে যুগে মুসলিমরা ভালোবাসার প্রমাণ দিয়ে এসেছে।
তারই ধারাবাহিকতায় হিজরী ১৩৯৬ সনে রাবেতায়ে আ’লামে ইসলামী সীরাতুন্নবী (সাঃ) সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। বিশ্বব্যাপী এ প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দেশের বহু লেখক আগ্রহসহ অংশগ্রহণ করেন। ১১৮২টি পাণ্ডুলিপির মধ্যে ‘আর রাহীকুল মাখতূম’ গ্রন্থটিকে প্রথম পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে এক বিরল সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। আর এ দুর্লভ সম্মানের কৃতিত্ব, অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার সমস্ত প্রশংসা শুধুমাত্র তারই প্রাপ্য যাঁর আদর্শকে কেন্দ্র করে এ গ্রন্থ রচিত হয়েছে।
সাহিত্যকর্মের রূপ-রস, সৌন্দর্য, মাধুর্য, শোভনতা, সাবলীলতা ও প্রাঞ্জলতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে উক্ত সাহিত্যকর্মের প্রকৃত মূল্য। ‘আর রাহীকুল মাখতূম’ গ্রন্থের সুন্দর ও সাবলীল প্রকাশ ভঙ্গি এবং লেখকের মোহনীয় শক্তি জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বে কোটি কোটি মানুষের অন্তরে। পাঠকের কথা বিবেচনায় রেখে লেখক গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে গ্রন্থের কলেবর অস্বাভাবিক দীর্ঘ করেননি, আবার খুব বেশি সংক্ষিপ্তও করেননি। অথচ এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সীরাত গ্রন্থও বটে।
গ্রন্থ রচনায় লেখক ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহের ধারাবাহিক বর্ণনা করেছেন এবং সেগুলোর বর্ণনায় তিনি বিভিন্ন অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়ে পর্যায়ক্রমিকভাবে বিন্যস্ত করেছেন। যেসব ঘটনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন গ্রন্থে মত পার্থক্য রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে লেখক সবকিছু পর্যালোচনা করে যেটি সঠিক মনে করেছেন সেটির উল্লেখ করেছেন। যেসব ক্ষেত্রে ভিন্ন মত পোষণকারীদের তথ্য লেখকের কাছে সঠিক মনে হয়নি সেসব ক্ষেত্রে তিনি যুক্তি প্রমাণের ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। আবার, তথ্যের উৎস হিসেবে গ্রন্থটিতে লেখক অসংখ্য গ্রন্থের নাম ও পৃষ্ঠা নম্বর উল্লেখ করেছেন।
গ্রন্থের শুরুতে লেখক রাসূল (সাঃ) এর আবির্ভাবের পূর্বে পৃথিবীতে বিরাজমান বিভিন্ন অবস্থা ও পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন। আরবের ভৌগোলিক পরিচয়, তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন জাতির অবস্থান, আরবের নেতৃত্ব ও শাসন ব্যবস্থা, আরবদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মতবাদ, জাহেলী সমাজের চারিত্রিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে লেখক এ পৃথিবীতে রাসূল (সাঃ) এর আবির্ভাবের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ) এর পবিত্র ও সংগ্রামী জীবনের প্রতিচ্ছবির এক অনবদ্য উপস্থাপনা গ্রন্থটিকে করেছে প্রাণবন্ত।
রাসূল (সাঃ) এর দাওয়াতের বিভিন্ন কৌশল ও পর্যায় বর্ণনা হতে শুরু করে, বদর, ওহুদসহ বিভিন্ন যুদ্ধ, মক্কা বিজয়, বিদায় হজ্জ, রাসূল (সাঃ) এর ওফাত পর্যন্ত সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনার পর রাসূল (সাঃ) এর পরিবারের পরিচিতি, রাসূল (সাঃ) এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও শারীরিক সৌন্দর্য বর্ণনার এক ব্যতিক্রমী উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে লেখক গ্রন্থটির পরিসমাপ্তি টানেন।
এই জীবনীগ্রন্হে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লা-হু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-য়ের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়েছে। রিয়াদভিত্তক প্রতিষ্ঠান দ্য কুরআন পাবলিশিং এন্ড প্রিন্টিং এর তত্ত্বাবধানে এর সম্পাদনা সম্পন্ন হয়। ১৯৯৯ সালে খাদিজা আখতার রেজায়ী বইটির বাংলা অনুবাদ করেন এবং আল কুরআন একাডেমী পাবলিকেশন্স বইটি প্রকাশ করে। বইটি বাংলা ভাষায় অনূদিত হবার পর অত্যন্ত পাঠক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মাত্র পঞ্চান্ন দিনের মাথায় বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ সহ এ পর্যন্ত পনের বছরে বইটির একুশটি সংস্করণ বের হয়েছে। পরবর্তীতে তাওহীদ পাবলিকেশন্স বইটির অনুবাদ বের করে। এ প্রকাশনী থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুল খালেক রাহমানী। বইটির নাম রাহিকূল মাখতূম এর অর্থ হল ছিপি আটা বোতল। লেখক এই জীবনীগ্রন্হের নামকরণ করেছেন পবিত্র কুরআনের সূরা মুতাফ্ফিফীনের আয়াত ২৫ থেকে । মূল বইটি প্রায় ৬০০ পৃষ্ঠা হলেও বাংলা অনুবাদে ৫৩০ পৃষ্ঠা হয়েছে। বইটির ইংরেজী অনুবাদের নাম The Sealed Nectar.[3]
বিশ্ব সীরাতুন্নাবী প্রতিযোগীতা
১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে করাচীতে প্রথম বিশ্ব মুসলিম সীরাত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মক্কার রাবেতায়ে আলাম আল ইসলামী এ সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে বিশ্বের সকল লেখকের প্রতি এক অভিনব আহবান জানানো হয়। রাবেতার পক্ষ থেকে প্রচারিত এই আহবানে বিশ্বের জীবন্ত ভাষাসমূহে রসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী রচনার কথা বলা হয়। এ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের প্রথম পাঁচজনকে পুরস্কার দেয়া হবে বলেও জানানো হয়। পুরস্কারের পরিমাণ যথাক্রমে ৫০, ৪০, ৩০, ২০ ও ১০ হাজার সৌদি রিয়াল। রাবেতায়ে আলামে ইসলামীর সরকারি মুখপত্র আখতার আল আলামুল ইসলামী পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যায় প্রতিযোগিতার ঘোষণা প্রকাশ করা হয়। রাবেতার ঘোষণার পর ১১৮২টি পাণ্ডুলিপি জমা পড়ে। চূড়ান্ত বাছাইয়ের জন্য সুনির্বাচিত একটি কমিটির ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়। এ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী শেখ হাসান ইবনে আবদুল্লাহ আল শেখ। কমিটির সদস্যরা ছিলেন জেদ্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়ত বিভাগের শিক্ষক সীরাতুন্নবী ও ইসলামের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ। তাদের নাম নিম্নরূপ, ডক্টর ইবরাহীম আলী সউত, ডক্টর আবদুর রহমান ফাহমি মোহাম্মদ, ডক্টর মোহাম্মদ সাঈদ সিদ্দিকী, ডক্টর ফিকরি আহমদ ওকায, ডক্টর আহমদ সাইয়েদ দারাজ, ডক্টর ফায়েক বকর সওয়াফ, ডক্টর শাকের মাহমুদ আবদুল মোনয়েম, ডক্টর আবদুল ফাত্তাহ মনসুর। এ কমিটির বিশেষজ্ঞরা পর্যায়ক্রমিক বাছাইয়ের পর এই ৫টি পান্ডুলিপির্ জন্য পাঁচজনকে পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত ঘোষণা করেন। ১. আর রাহীকুল মাখতুম, (আরবী) ছফিউর রহমান মোবারকপুরী, জামেয়া সালাফিয়া, বেনারস, ভারত-প্রথম ২. খাতামুন নবীইঈন (ইংরেজী) ডক্টর মাজেদ আলী খান, জামেয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া-দিল্লী, ভারত-দ্বিতীয়, ৩. পয়গাম্বরে আযম ওয়া আখের (উর্দু) ডক্টর নাসির আহমদ নাসের, ভাইস চ্যান্সেলর জামেয়া ইসলামিয়া, ভাওয়ালপুর, পাকিস্তান-তৃতীয়, ৪. মোনতাকাউন নকুল ফী সিরাতে আযামির রসূল (আরবী) শেখ হামেদ মাহমুদ ইবনে মোহাম্মদ মনসুর লেমুদ, জিজাহ মিসর-চতুর্থ, ৫. সীরাতুন নবীইল হাদীইর রহমত (আরবী) ওস্তাদ আবদুস সালাম হাসেম হাফেজ, মদিনা মোনাওয়ারা সউদী আরব-পঞ্চম।[4][5]
প্রকাশনা এবং অনুবাদ
‘আর রাহীকুল মাখতূম’ গ্রন্থটির বিশ্বব্যাপী আলোচিত ও প্রশংসিত হওয়া এবং অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তার কথা বিবেচনা করে সর্বপ্রথম খাদিজা আখতার রেজায়ী বাংলা ভাষা-ভাষীদের জন্য গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে আল কোরআন একাডেমী।
জীবনীগ্রন্হটি বিশ্ব মুসলিম লিগসহ অন্যান্য সংগঠনও প্রকাশ করে।[1] দারুস সালাম পাবলিকেশন্স লেখকের সম্মতিক্রমে বইটির ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করে। [1] লেখকের তত্ত্বাবধানে বইটির বাংলা অনুবাদ লেখকের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশে ছাপাচ্ছে তাওহিদ পাবলিকেশন্স। [6] এই জীবনীগ্রন্হের সকল ভাষার সংষ্করণ লেখকের উত্তরাধিকার কর্তৃক সংরক্ষিত। [6]
তথ্যসূত্র
- "দারুস সালাম পাবলিকেশন্স ওয়েবসাইট"। ৩ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ ডিসেম্বর ২০১৩।
- "আর রাহীকুল মাখতূম"। The Daily Sangram। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১১-১৫।
- Al-Mubarakpuri, Safi-ur-Rahman; Mubārakfūrī, Ṣafī al-Raḥmān (২০০২)। الرحيق المختوم: بحث في السيرة النبوية على صاحبها افضل الصلاة و السلام: Biography of the Noble Prophet (ইংরেজি ভাষায়)। Darussalam। আইএসবিএন 9789960899558।
- http://muslimwiki.com/mw/index.php/1976
- "আর রাহীকুল মাখতূম | Shibir Online Library"। Shibir Online Library (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৪-০৫-০৮। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৯-০১।
- মোবারকপুরী, সফিউর রহমান। আর্-রাহীকুল মাখতূম। আলকুরআন একাডেমী পাবলিকেশন্স।