কালাশ জনগোষ্ঠী
কালাশা বা কালাশ (কালাশা-মুন: Kaĺaśa; নুরিস্তানি: Kasivo; উর্দু: کالاش) হচ্ছে একটি দার্দীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠী যারা পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া রাজ্যের চিত্রাল জেলায় বসবাস করে। তারা কালাশা ভাষায় কথা বলে যা ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর দার্দীয় পরিবারের অন্তর্গত। এদেরকে পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে অনন্য ধরা হয়।[1] এদেরকে পাকিস্তানের ক্ষুদ্রতম নৃ-ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবেও বিবেচনা করা হয়,[2] যারা পণ্ডিতদের মতে সর্বপ্রাণবাদ এর একটি রূপ অনুসরণ করে,[3][4][5] আবার অন্য পণ্ডিতদের মতে তারা প্রাচীন হিন্দুধর্মের একটি রূপ অনুসরণ করে।[6]
পার্শবর্তী আফগানিস্তানের নুরিস্তান প্রদেশের (ঐতিহাসিকভাবে কাফিরিস্তান নামে পরিচিত) নুরিস্তানি জনগোষ্ঠী একসময় কালাশদের ধর্মবিশ্বাসের সংলগ্ন একটি ধর্মবিশ্বাস চর্চা করত।[6] ১৯ শতকের শেষের দিকে নুরিস্তানের বেশিরভাগ লোকই ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়, যদিও কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ অনুসারে নুরিস্তানি জনগণ তাদের নিজস্ব রীতিনীতির চর্চা চালিয়ে যেত। পরবর্তিতে নুরিস্তান অঞ্চল যুদ্ধের অঞ্চলে পরিণত হয় যার ফলে অনেক আদি নুরিস্তানির মৃত্যু হয়, এবং আশপাশের আফগানরা সেই শূন্যস্থানে বসবাস শুরু করে যারা নুরিস্তানের আদিবাসীদের সাথে মিশে যায়।[3][4][5] চিত্রালের কালাশেরা তাদের নিজেদের ভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছে।[7]
ইতিহাস ও সামাজিক মর্যাদা
কালাশদেরকে আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে তাদের পূর্বপুরুষগণ মধ্য এশিয়া থেকে চিত্রালে অভিপ্রায়ণ করেছিল।[1] ১৮ শতক থেকে কালাশরা চিত্রালের মেহতারদের দ্বারা শাসিত হয়ে এসেছে। চিত্রালের প্রধান নৃগোষ্ঠী খো-দের সাথে এদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, যেখানে খো জনগোষ্ঠী হচ্ছে সুন্নি ও ইসমাইলি মুসলিম। এদের অঞ্চলের পশ্চিমে সীমান্তের পর আফগানিস্তানের নুরিস্তানিদের বাস, সেই প্রদেশটির নাম নুরিস্তান প্রদেশ যা পূর্বে কাফিরিস্তান নামে পরিচিত ছিল। ১৮৯০ এর দশকে আফগানিস্তানের আমির আব্দুর-রহমান নুরিস্তানিদেরকে হত্যা ও যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে জোড়পূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত করেন এবং অঞ্চলটির নাম পরিবর্তন করে নুরিস্তান রাখেন।[8][9]
এই ঘটনার পূর্বে, কাফিরিস্তানের অধিবাসীগণ চিত্রালের মেহতারের কাছে রাজস্ব দান করত এবং তার অধিরাজ্য স্বীকার করত। কিন্তু ডুরান্ড চুক্তির পর এই অবস্থার সমাপ্তি ঘটে এবং এর ফলে কাফিরিস্তান আফগান প্রভাবাধীনে চলে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে কালাশরা তাদের জনসংখ্যাগত ও সাংস্কৃতিক বিলুপ্তি বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে, এবং গত ৩০ বছর ধরে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ধিত আন্তর্জাতিক সচেতনতা, অধিকতর সহিষ্ণু সরকার, এবং অর্থনৈতিক সাহায্যের কারণে তারা তাদের নিজেদের জীবনধারা চালিয়ে যেতে পারছে। তাদের সংখ্যা ৩,০০০ এ স্থিতিশীল রয়েছে। যদিও অনেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে, তাদের উচ্চ জন্মহার সেই জনসংখ্যা হ্রাসকে পুষিয়ে দিয়েছে, এবং চিকিৎসা-সংক্রান্ত সুবিধার জন্য (যেটা পূর্বে একেবারেই ছিল না) তারা বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারছে।
মুসলিম অঞ্চলে একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হওয়া, কালাশরা পূর্বের চেয়েও অধিক হারে ধর্মান্তরকারী মুসলিমদের লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছে। কিছু মুসলিম কালাশদেরকে কোরান পড়তে উৎসাহিত করছে যাতে তারা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়।[10][11][12] আধুনিকতার হুমকি, বহিরাগতদের ভূমিকা, এবং এনজিওগুলো কালাশ উপত্যকার পরিবেশ পরিবর্তন করছে, এবং এটাও কালাশদের জন্য একটি বাস্তব হুমকি।[13]
১৯৭০ এর দশকে, স্থানীয় মুসলিম এবং জঙ্গিরা কালাশদের উপর অত্যাচার চালায় কারণ কালাশদের ধর্ম ভিন্ন ছিল, এবং এদের উপর তালিবানরা অনেক আক্রমণ চালায় যার ফলে অনেক কালাশ জনগোষ্ঠীর অনেকেরই মৃত্যু হয় এবং তাদের সংখ্যা কমে দুই হাজারে নেমে আসে।[14] যাই হোক সরকারের দ্বারা প্রতিরক্ষার কারণে তালিবান আক্রমণের পরিমাণ ও স্থানীয় অত্যাচার কমে গেছে, সেই সাথে এই জনগোষ্ঠীতে শিশু মৃত্যুর হারও কমে গেছে। গত দুই দশকে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।[15]
সাম্প্রতিক সময়ে কালাশ এবং ইসমাইলিরা তালিবানদের দ্বারা মৃত্যুর হুমকি পাচ্ছে। এই হুমকি সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ক্রোধ ও ভয়ের কারণ হয়েছে, এবং পাকিস্তান সামরিক বিভাগ কালাশ গ্রামগুলোর আশেপাশে নিরাপত্তা বৃদ্ধির মাধ্যমে এর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।[16] পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত কালাশদেরকে নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু ধারা এবং পাকিস্তান এর শরিয়া আইন দণ্ডবিধি অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে, যেখানে শরিয়া আইনের দণ্ডবিধি অনুযায়ী ব্যক্তিগত বিশ্বাসের কারণে মুসলিমদের অন্য ধর্মের সমালোচনা করা এবং অন্য ধর্মের লোদেরকে আক্রমণ করা অবৈধ হিসেবে ঘোষিত।[17] সর্বোচ্চ আদালত তালিবান হুমকিকে ইসলামী শিক্ষার বিরুদ্ধে বলে ঘোষণা করেছে।[18] বিখ্যাত শান্তিবাদী পাকিস্তানী, যেমন ইমরান কান জোড়পূর্বক ধর্মান্তরণের হুমকিকে অনৈস্লামিক বলে নিন্দা করেছেন।[19]
২০১৭ সালে ওয়াজিরজাদা খাইবার-পাখতুনখোয়া আইনসভার একটি আসন জয়ী প্রথম কালাশ হবার মর্যাদা লাভ করেন। তিনি একটি সংরক্ষিত সঙ্ঘ্যালঘু আসনের ভিত্তিতে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য হন।[20][21]
তথ্যসূত্র
- "The Kalash - Protection and Conservation of an Endangered Minority in the Hindukush Mountain Belt of Chitral, Northern Pakistan" (PDF)। ৭ জুলাই ২০০৭ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা।
- "'Earthquake was Allah's wrath for Kalash community's immoral ways'"। The Express Tribune। ২০১৫-১১-১০। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-১১-১১।
- Mike Searle (২৮ মার্চ ২০১৩)। Colliding Continents: A geological exploration of the Himalaya, Karakoram, and Tibet। OUP Oxford। আইএসবিএন 978-0-19-165249-3।
- Camerapix (১৯৯৮)। Spectrum Guide to Pakistan। Interlink Books। আইএসবিএন 978-1-56656-240-9।
Nowhere is this more evident than among the pagan Kalash, a non-Islamic community living in the isolated valleys of Chitral whose faith is founded on animism.
- Sean Sheehan (১ অক্টোবর ১৯৯৩)। Pakistan। Marshall Cavendish। আইএসবিএন 978-1-85435-583-6।
The Kalash people are small in number, hardly exceeding 3,000, but they ... and as well as having their own language and costume, they practice animism (the worship of spirits in nature)...
- West, Barbara A. (১৯ মে ২০১০)। Encyclopedia of the Peoples of Asia and Oceania (English ভাষায়)। Infobase Publishing। পৃষ্ঠা 357। আইএসবিএন 9781438119137।
The Kalasha are a unique people living in just three valleys near Chitral, Pakistan, the capital of North-West Frontier Province, which borders Afghanistan. Unlike their neighbors in the Hindu Kush Mountains on both the Afghani and Pakistani sides of the border the Kalasha have not converted to Islam. During the mid-20th century a few Kalasha villages in Pakistan were forcibly converted to this dominant religion, but the people fought the conversion and once official pressure was removed the vast majority continued to practice their own religion. Their religion is a form of Hinduism that recognizes many gods and spirits ... given their Indo-Aryan language, ... the religion of the Kalasha is much more closely aligned to the Hinduism of their Indian neighbors that to the religion of Alexander the Great and his armies.
- Newby, Eric. A Short Walk in the Hindu Kush. 2008. আইএসবিএন ১৭৪১৭৯৫২৮১
- Nuristan on Encyclopaedia Iranica.
- William Dalrymple, Dancing in the hills: a journey to meet Pakistan’s Kalash people (Financial Times, March 21, 2018).
- Reuters: "Conversions to Islam threaten Pakistan’s "Macedonian" tribe" 20 October 2011
- International Business Times: "Descendants of Alexander the Great's Army in Pakistan Pressured to Convert to Islam" 22 October 2011
- The Guardian: "Taliban threat closes in on isolated Kalash tribe" 17 October 2011
- Zaheer-ud-Din, Muslim Impact on Religion and Culture of the Kalash, Al-Adwa 43:30, 2015
- Manzar, A. Taliban in Pakistan: A Chronicle of Resurgence (Terrorism, Hot Spots and Conflict-Related Issues). (2009). Nova Science Publishers.
- "The Kalash"। Wild Frontiers। ৫ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- "Security for Kalash tribe after Taliban threat"। pt। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
- "CJ takes suo moto notice of threats to Kalash, Chitral people"। The News। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
- "SC takes notice of TTP threats to Kalash, Ismaili communities"। The Express Tribune। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
- "Forcibly converting people un-Islamic, says Imran"। Dawn.com। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
- https://www.dawn.com/news/1416605
- https://tribune.com.pk/story/1768671/1-kalash-celebrate-wazirzada-makes-way-assembly/