স্বরবৃত্ত ছন্দ

স্বরবৃত্ত ছন্দ (দলবৃত্ত/ছড়ার ছন্দ/শ্বাসাঘাতপ্রধান ছন্দ) বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত প্রধান তিনটি ছন্দের একটি। অন্য দুটি হলো অক্ষরবৃত্ত ছন্দ এবং মাত্রাবৃত্ত ছন্দ।, স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চার মাত্রার চালে চলতে পছন্দ করে। প্রধানত ছড়া এবং গান লিখতেই এই ছন্দ সচরাচর ব্যবহৃত হয়। "প্রাচীন পয়ারের পাশাপাশি অবস্থান করেও এই বিশেষ ছন্দরীতিটি প্রাকৃত বাংলা বা লোকসাহিত্যের ছড়া, প্রবাদ, পাঁচালি প্রভৃতির বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবুও বাঙালির চিন্তা-চেতনায় এ ছন্দের প্রভাব অখণ্ড, অনন্ত।"[1] বাংলা ভাষা ও বাঙালির ধ্বনি উচ্চারণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছন্দ হচ্ছে স্বরবৃত্ত ছন্দ। এর কারণ, বাংলা শব্দ স্বভাবগতভাবেই হলন্ত বা ব্যঞ্জনান্ত উচ্চারণ প্রক্রিয়াবিশিষ্ট, যাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ‘হসন্তের ছাঁচ’। এ বৈশিষ্ট্য স্বরবৃত্ত ছন্দে রক্ষিত হয়েছে। চলিত বা প্রাকৃত বাংলার স্বভাব রক্ষা করে এ ছন্দের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। ফলে এ ছন্দকে সাধু বাংলার বাইরে বাউল গানে, লোককথায় ও ছড়ায় খুঁজে পাওয়া যায়। "[2]

বৈশিষ্ট্য

  • স্বরবৃত্তের মূল বিষয়টিই আবর্তিত হয় দুটি সিলেবল বা দলকে (মুক্ত ও বদ্ধ দল) ঘিরে।
  • স্বরবৃত্ত দ্রুত লয়ের ছন্দ।
  • এই ছন্দের মূলপর্ব বা পূর্ণপর্ব চার মাত্রাবিশিষ্ট।
  • মুক্তদল বা মুক্তাক্ষর এবং রুদ্ধদল বা বদ্ধাক্ষর উভয়ই একমাত্রাবিশিষ্ট।
  • পর্বগুলো ছোট এবং দ্রুতলয়বিশিষ্ট।
  • এই ছন্দে যতি এবং দল ঘন ঘন পড়ে বলে বাগযন্ত্র দ্রুততা লাভ করে।
  • প্রতি পর্বের প্রথম অক্ষর শ্বাসাঘাতযুক্ত।
  • এই ছন্দের প্রয়োজনে ৫ মাত্রাকে সংবৃত উচ্চারণে ৪ মাত্রার মত আবৃত্তি করা যায়, আবার কোথাও এক মাত্রা কম থাকলে বিবৃত উচ্চারণ করে এক মাত্রাকে দুই মাত্রায় টেনে নেয়া যায়। "[3]

নামকরণ

সুপ্রাচীন কাল থেকে বাংলা লোকসাহিত্যে প্রচলিত এই ছন্দোরীতিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম দিয়েছেন ‘বাংলা প্রাকৃত’। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এর নাম দিয়েছেন ‘চিত্রা’। ইংরেজির syllable এর মত বাংলা শব্দাংশ হিসাব করে এই ছন্দের সমতা নিরূপিত হয়। এই syllable কে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলতেন ‘শব্দ পাপড়ি’ , দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলতেন ‘মাত্রা’ আর প্রবোধচন্দ্র সেন বলতেন ‘দল’। আর তাই দ্বিজেন্দ্রলাল এই ছন্দকে ‘মাত্রিক’ এবং প্রবোধচন্দ্র ‘দলবৃত্ত’ নামে অভিহিত করেন। এই ছন্দে প্রতি পর্বের প্রথমেই শ্বাসাঘাত পড়ে বলে অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় এই ছন্দকে ‘শ্বাসাঘাতপ্রধান’ ছন্দ বলে নির্দেশ করেন। "[4] স্বরবৃত্ত নামটিও প্রবোধচন্দ্র সেন প্রদত্ত নাম, যদিও তিনি পরবর্তীকালে নিজেই এই ছন্দের নাম 'দলবৃত্ত' প্রস্তাব করেন। তবে এখন বাংলা ছন্দে 'স্বরবৃত্ত' নামটিই প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

উদ্ভব

অনেকের মতে, আধুনিক স্বরবৃত্ত ছন্দ মধ্যযুগীয় কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এর ধামালি ছন্দ থেকে উদ্ভূত, কেননা ধামালিকাব্য নামে পরিচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ধামালি ছন্দে স্বরবৃত্তের পূর্ববর্তী রূপটি পরিলক্ষিত হয়। এ কাব্যের শব্দে যেহেতু হসন্ত উচ্চারণ নেই এবং অকারান্ত শব্দ অকারান্ত রূপেই উচ্চারিত হয়, সেহেতু পর্বের আদিতে শ্বাসাঘাত স্পষ্ট না হলেও তার ইঙ্গিত আছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে এমন কতগুলি তৎসম শব্দ আছে যেগুলির আদিতে শ্বাসাঘাতের অস্তিত্ব লক্ষণীয়, যেমন: আসুখ (অসুখ), আনল (অনল), আন্তর (অন্তর), আধিক (অধিক) ইত্যাদি। মূলত উপর্যুক্ত শব্দগুলির আদিস্বরের বৃদ্ধি প্রবল শ্বাসাঘাতের জন্যই সম্ভব হয়েছে। তাই আদি স্বরের এ বৃদ্ধি দ্বারাই শব্দের আদি শ্বাসাঘাতকে বুঝে নিতে হয়, যা স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পরে বৈষ্ণব পদাবলির কবি লোচনদাসের পদাবলিতে স্বরবৃত্ত ছন্দের পর্বগত শ্বাসাঘাত অত্যন্ত স্পষ্ট, যাকে অতি সহজেই এ ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্যরূপে চিহ্নিত করা যায়: আর্ শুন্যাছ’/ আলো সই/ গোরা ভাবের/ কথা। কোণের্ ভিতর্/ কুলবধূ/ কান্দ্যা আকুল্/ তথা \

স্বরবৃত্ত ছন্দ পরবর্তী সময়ে লোচনদাস এর পদের ধারাবাহিকতায় অষ্টাদশ শতকের গোপীচন্দ্রের গান, শ্যামাসঙ্গীত, বাউল পদ, পাঁচালিমৈমনসিংহ-গীতিকার মধ্য দিয়ে পরিপুষ্টি লাভ করে আধুনিক যুগের ছড়ার ছন্দরূপে পরিপূর্ণ ও স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। "[2]

ছন্দবিশ্লেষণ

যদি "মুক্ত" শব্দটিকে মাত্রার জন্য ব্যবচ্ছেদ করা হয়, তবে এখানে সিলেবল আছে দুটি। প্রথমটি মুক (বদ্ধ) এবং ত(মুক্ত)। এখানে বর্ণ তিনটি কিন্তু উচ্চারণের সময় দুটিতে ভাগ হচ্ছে। আবার যদি ’আকাশ’ শব্দটি ব্যবচ্ছেদ করা হয় তবে আ(মুক্ত), কাশ (বদ্ধ)।

    • মা কেঁদে কয়/মঞ্জুলী মোর/ঐ তো কচি/ মেয়ে ৪+৪+৪+২
    • ওরি সঙ্গে/বিয়ে দিবে/বয়সে ওর/ চেয়ে ৪+৪+৪+২
    • পাঁচ গুণো সে /বড় ৪+২
    • তাকে দেখে/বাছা আমার/ভয়েই জড়/সড়। ৪+৪+৪+২

এই উদাহরণে পূর্ণপর্ব চারমাত্রার, অপূর্ণপর্ব দুইমাত্রার। স্বরবৃত্তে সাধারণত পূর্ণপর্ব চারমাত্রার, এবং অপূর্ণপর্ব এক বা দুইমাত্রার হয়ে থাকে।

আরেকটি কবিতার ছন্দ, জসীম উদদীন

রাখাল ছেলে

'রাখাল ছেলে!/ রাখাল ছেলে! /বারেক ফিরে/ চাও,

বাঁকা গাঁয়ের/ পথটি বেয়ে /কোথায় চলে/ যাও?'


'ওই যে দেখ/ নীল-নোয়ান /সবুজ ঘেরা/ গাঁ,

কলার পাতা /দোলায় চামর /শিশির ধোয়ায়/ পা;

সেথায় আছে/ ছোট্ট কুটির/ সোনার পাতায়/ ছাওয়া,

সেই ঘরেতে /একলা বসে/ ডাকছে আমার/ মা সেথায় যাব, /ও ভাই এবার/ আমায় ছাড়/ না!'

রাখাল ছেলে!/ রাখাল ছেলে!/ আবার কোথায়/ ধাও, পূব আকাশে /ছাড়ল সবে/ রঙিন মেঘের/ নাও।'

'ঘুম হতে আজ/ জেগেই দেখি /শিশির-ঝরা/ ঘাসে,

সারা রাতের/ স্বপন আমার/ মিঠেল রোদে/ হাসে। আমার সাথে /করতে খেলা /প্রভাত হাওয়া /ভাই,


সরষে ফুলের /পাঁপড়ি নাড়ি/ ডাকছে মোরে/ তাই।

চলতে পথে /মটরশুঁটি/ জড়িয়ে দু-খান/ পা,

বলছে ডেকে/গাঁয়ের রাখাল/একটু খেলে/ যা!' 


সারা মাঠের /ডাক এসেছে, /খেলতে হবে/ ভাই! সাঁঝের বেলা/ কইব কথা /এখন তবে/ যাই!'

'রাখাল ছেলে! /রাখাল ছেলে/! সারাটা দিন/ খেলা, এ যে বড় /বাড়াবাড়ি,/ কাজ আছে যে/ মেলা!' 'কাজের কথা/ জানিনে ভাই/, লাঙল দিয়ে/ খেলি ,

নিড়িয়ে দেই /ধানের ক্ষেতের /সবিজ রঙের/ চেলি সরষে বালা /নুইয়ে গলা/ হলদে হওয়ার/ সুখে মটর বোনে /ঘোমটা খুলে /চুম দিয়ে যায় /মুখে!

ঝাউয়ের ঝাড়ে/ বাজায় বাঁশি/ পঊষ-পাগল/ বুড়ি, আমরা সেথা/ চষতে লাঙল/ মুর্শিদা-গান/ জুড়ি।

খেলা মোদের /গান গাওয়া ভাই/, খেলা লাঙল/-চষা ।

উদাহরণ


পক্ষীরাজের/ খেয়াল হল/ ঘাস খাবে ৪+৪+৩
স্বর্গে কোথায়/ ঘাস পাবে? ৪+৩
একদিন সে/ ইন্দ্র রাজার/ সুখের দেশ ৪+৪+৩
শূন্য করে/ নিরুদ্দেশ ৪+৩

তথ্যসূত্র

  1. ড. সুধাংশু শেখর শাসমল, নবছন্দ শৈলী, ১৯৯৮, মডার্ন বুক এজেন্সী, কলিকাতা
  2. http://bn.banglapedia.org/index.php?title=%E0%A6%9B%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6
  3. আধুনিক বাংলা ছন্দ ও অলঙ্কার, কাজী মুহম্মদ অলিউল্লাহ
  4. নূতন ছন্দ পরিক্রমা,প্রবোধচন্দ্র সেন

বহি:সংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.