শরাইঘাটের যুদ্ধ

শরাইঘাটের যুদ্ধ (ইংরেজি: Battle of Saraighat, অসমীয়া: শরাইঘাটর যুদ্ধ) আহোম সেনাপতি লাচিত ররফুকনের নেতৃত্বে ও মোগল সেনাপতি রাম সিংহের নেতৃত্বে ১৬৭১ সালে অসমের গুয়াহাটিতে হয়েছিল। মোগলেরা ৩০, ০০০ সৈন্য, ১৫০০০ ধনুর্বিদ, ১৮, ০০০টি ঘোড়া, ১০০০ অধিক কামান ও বিশাল নৌকা নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল।আহোম সেনার তুলনায় মোগল সেনারা বেশী শক্তিশালী ছিল কিন্তু গেরিলা যুদ্ধ কৌশলের ফলে মোগলেরা এই যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। মোগলের নৌ-সেনা দুর্বল থাকায় আহোমেরা ইহার যথেষ্টে সুবিধা পেয়েছিল। এই যুদ্ধের দ্বারা মোগলেরা অন্তিম বারের জন্য অসমে সাম্রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন।

পটভূমি

১৬০২ সালে ঢাকার নবাব পশ্চিম আসাম ধুবরীর রাজা পরীক্ষিত নারায়নকে আক্রমণ করেন। ধুবরী আক্রমণ করার পর মোগল সম্রাটদের অসমে মোগল সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্য আগ্রহ জন্মেছিল। ১৬১৫ সালে আহোম রাজা প্রতাপ সিংহের রাজত্বকালে মোগলেরা অসম আক্রমণ করেন। ১৬৩৯ সালে এই যুদ্ধের মীমাংসা রুপে আহোম-মোগলের মধ্যে অসুরর আলি নামক একটি সন্ধি হয়েছিল। এই সন্ধির দ্বারা আহোম ও মোগলের সিমানা নির্ধারন করা হয়েছিল। ১৬৪১ সালে কোচ রাজা পান্ডুতে পরাজিত হয়েছিল ফলে গুয়াহাটী ও হাজো মোগলের অধীন হয়েছিল। ১৬৫৮ সালে মোগল সম্রাট শ্বাহ জাহানের পতন ঘটে। এই সুযোগে কোচ বিহারের রাজা প্রাননারায়ন হাজো দখল করার চেষ্টা করেন কিন্তু আহোম রাজা জয়ধ্বজ সিংহ কোচ বিহারের রাজা প্রাননারায়নকে পরাজিত করে গুয়াহাটী ও হাজো দখল করেন। শ্বাহ জাহানের পতনের পতনের পর ঔরংগজেব ক্ষমতায় আসেন। ১৬৬০ সালে মীরজুমলা বেঙ্গলের সুবেদার পদে নিযুক্তি হন। মীরজুমলাকে অসম দখল করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়। ১৬৬১ সালে মীরজুমলা অসম আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে তিনি আহোমের সৈন্যকে পরাস্ত করে গুয়াহাটী ও আহোমের রাজধানি গড়গাও দখল করেন কিন্তু অতন বুঢ়াগোহাইয়ের গেরিলা যুদ্ধ ও বৃষ্টির ফলে মোগল সেনার মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় শেষ পর্যন্ত মীরজুমলা অসম দখল করিতে পারেন নাই। আহোম রাজা জয়ধ্বজ সিংহ এই ঘটনা না জেনে মীরজুমলাকে শান্তির জন্য তিনি প্রস্তাব দেন। অবশেষে ১৬৬৩ মোগল ও আহোমের মধ্যে ঘিলাঝারীঘাট সন্ধি হয়। এই সন্ধিমধতে আহোমের রাজধানী গড়গাও পুনরায় আহোমের অধীনে আসে।

শরাইঘাট যুদ্ধের সুচনা

মীরজুমলার হাতে পরাস্ত হওয়ার কিছুদিন পর জয়ধ্বজ সিংহের মৃত্যু হয়েছিল। জয়ধ্বজ সিংহের মৃত্যুর পর চক্রধ্বজ সিংহ সিংহাসালে বসেন। রাজার ক্ষমতায় এসে চক্রধ্বজ সিংহ আহোম সাম্রাজ্যের উন্নতি সাধন করেছিলেন। তিনি মীরজুমলার আক্রমণে ক্ষতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে পুন স্থাপনের ব্যাবস্থা করছিলেন। তিনি রাজ্যে খাদ্য ও সামরিক বাহিনীর উন্নতি করছিলেন। নতুন দুর্গ ও সুরক্ষিত স্থানের ব্যাবস্থা করেছিলেন। লাচিত বরফুকনের নেতৃত্বে তিনি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করেছিলেন। জয়ন্তীরা ও কছাড়ী রাজ্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলেন। এই সময়ে চক্রধ্বজ ঘিলাঝারীঘাট সন্ধির সর্তগুলো তিরস্কার করেন। ১৬৬৭ সালে গুয়াহাটির সুবেদার এই ঘটনায় গুরুত্ব দেয়। তিনি আহোম রাজা চক্রধ্বজকে সর্তগুলো পালন করার জন্য চাপ দেন। ১৬৬৭ সালে লাচিত বরফুকন ও অতন বুঢ়াগোহাই একত্রিত হয়ে পুনরায় গুয়াহাটি দখল করার জন্য প্রস্তুত হন।

গুয়াহাটি পুনরায় দখল

আহোম সেনাপতি প্রথমে কলিয়াবরে নিজেদের দুর্গ স্থাপন করে গুয়াহাটির দিকে রওনা হয়েছিলেন। ১৬৬৭ সালের সেপ্তেম্বর মাসে ডেকা ফুকন ব্রহ্মপুত্রের উত্তর পারে স্থিত বাহবারী অঞ্চল দখল করেন। ব্রহ্মপুত্র নদীর দক্ষিণ পার জলপথ ও স্থলপথে আক্রমণ করেন ফলে কপিলী নদী ও গুয়াহাটির মধ্যবর্তী অঞ্চলে স্থিত কাজলী, সোনাপুর, পানীখেতী ও তীরামারের দুর্গ দখল করিতে সক্ষম হন। আহমেরা গুয়াহাটির উত্তর ও দক্ষিণে স্থিত মোগলের ১০টি দুর্গ উত্তরে—কানাই-বরশী-বোয়া, হিল্লার,হিন্দুরিঘোপা, পাটদুয়ার করাই ও দক্ষিণে—লতাশিল, জয়দুয়ার, ধরমদুয়ার, দুয়ারগুরিয়া এবং পাণ্ডু ইত্যাদিতে সংঘর্শ হয়েছিল। এই যুদ্ধে আহোম সামান্য ক্ষতি হয়েছিল কিন্তু দুর্গ দখল করিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সময়ে নতুন সেনারা আহোমের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে মোগল সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন। আহোমেরা নৌ-সেনা ব্যবহার করে উমানন্দ ও বরহাট নিজের অধীনে আনেন। আহোমেরা ফিরোজ খানকে পরাস্ত করে মানাহমুখ অঞ্চল নিজেদের অধীনে আনেন ও ফিরোজ খানকে বন্দী করেছিলেন। এইভাবে আহোমেরা গুয়াহাটি পুনরায় দখল করেন ও মানাহমুখ পর্যন্ত নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করিতে সক্ষম হন। ইহার কিছুদিন পর রামসিংহ বিশাল মোগল সেনা নিয়ে আহোমকে আক্রমণ করেন ও গুয়াহাটিতে পুনরায় মোগল সাম্রাজ্য বিস্তার করিতে সক্ষম হয়েছিলেন কিন্তু অন্যান্য অঞ্চল আহোমের অধীনে ছিল।

মোগলদের রাজকীয় অভিযান

১৬৬৭ সালের ১৯ ডিসেম্বরে মোগল সম্রাট ঔরংগজেবকে মোগল সেনার পরাজয়ের কথা জানানো হয়। তিনি তৎক্ষনাৎ রাজা রামসিংহকে অসম দখল করার আদেশ দেন। রাজা রামসিংহ পাটনার টেগ বাহাদুর ও রশিদ খার সাহায্যে বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন।মোগলেরা ৩০, ০০০ সৈন্য, ১৫০০০ ধনুর্বিদ, ১৮, ০০০টি ঘোড়া, ১০০০ অধিক কামান ও বিশাল নৌকা নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল।

আহোমদের কূটনৈতিক পরিকল্পনা

মোগলের তুলনায় আহোমেরা দুর্বল হওয়ায় আহোম সেনাপতি লাচিত বরফুকন কূটনিতীর প্রয়োগ করে গুয়াহাটির অসমতল অঞ্চল যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করেছিলেন। মোগলের গতিবিধীর প্রতি লক্ষ রাখার জন্য লাচিত আহোম সেনাকে বিশাল দেওয়াল বানানোর জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। নির্মানের দায়িত্ব তিনি মামাকে দিয়েছিলেন। লাচিতের মামা পর্যাপ্ত সময়ে কাজ সমাপ্ত করিতে পারেন নাই। পর্যাপ্ত সময়ে দেওয়াল নির্মানের কাজ অসম্পুর্ন দেখে তিনি মামার শিরশ্ছেদ করেছিলেন। আহোম সেনারা দলে বলে যোগদান করে দেওয়াল নির্মানের কাজ সম্পুর্ন করেছিলেন। মোগলের অসম আক্রমণের পথে এই দেওয়ালটি বাধার প্রধান কারণ হওয়ায় মোগলেরা নৌ-পথ ব্যবহার করিতে বাধ্য হয়েছিল। মোগলদের নৌ-সেনা দুর্বল হওয়ায় মোগলদের পরাস্ত করিতে সুবিধা হয়েছিল। যুদ্ধে অসফল হওয়ায় মোগল সেনাপতি রাম সিংহ লাচিতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। রাম সিংহ আহোম রাজা চক্রধ্বজ সিংহকে একটি পত্র প্রেরন করেছিলেন যেখানে লেখা ছিল যে লাচিত ১ লক্ষ টাকার বিনিময়ে গুয়াহাটিতে মোগল সাম্রাজ্য স্থাপনের অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু রাম সিংহের প্রচেষ্টা অসফল হয়েছিল কারণ রাজা চক্রধ্বজ লাচিতের সততা ও নিষ্ঠার প্রতি পূর্ন বিশ্বাস করিতেন ও আহোম সাম্রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী অতন বুরাগোহাই রাম সিংহের ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে রাজাকে এই বিষয়ে অবগত করেছিলেন। মোগলেরা ৩০, ০০০ সৈন্য, ১৫০০০ ধনুর্বিদ, ১৮, ০০০টি ঘোড়া, ১০০০'র অধিক কামান ও বিশাল নৌকা নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। মোগল সেনার বিরুদ্ধে আহোম সেনারা দুর্বল হওয়ায় আহোম সেনারা জয়লাভের আশা বাদ দিয়ে পিছিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করেছিল। নিজ সেনাকে পিছিয়ে যাওয়া দেখে সেনাপতি লাচিত বরফুকন বলেছিলেন, “তোমরা যদি পিছিয়ে যেতে চাও, যাও কিন্তু স্বর্গদেও আমাকে আদেশ করেছেন, আমি মৃত্যুর আগ মূহর্ত পর্যন্ত লড়ব, তোমরা স্বর্গদেওকে বলবা আমি জীবনের অন্তিম নিশ্বাস পর্যন্ত যুদ্ধ করেছি। লাচিতের এই বানি আহোম সেনার মধ্যে উত্তেজনা জাগায় ও সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে মোগল সেনাকে পরাস্ত করেন। এই যুদ্ধটি আহোম ও মোগলের অন্তিম যুদ্ধ ছিল। আহোম সাম্রাজ্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত অসম আহোম সাম্রাজ্যের অধীন ছিল।

শরাইঘাটের চূড়ান্ত যুদ্ধ

তথ্যসূত্র

    বহিঃসংযোগ

    This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.