মুজিববাদ
মুজিববাদ হল বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবর রহমানের চর্চিত ও প্রচারিত রাজনৈতিক দর্শন বা মূল্যবোধের সমষ্টি।[1][2][3][4][5][6] মুজিবের রাজনৈতিক দর্শনের মূল চারনীতি হল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।[7] ১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি বলেন, আগে স্লোগান ছিল ৬ দফা, এখন ৪টা স্তম্ভ।[7] ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হলে মুজিববাদের চার স্তম্ভ, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রপরিচালনার চার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়।
পটভূমি
উপনিবেশী আমলে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন। আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতে, মুজিবের 'রাজনৈতিক চরিত্র গড়ে উঠেছিল হক সাহেব, আবুল হাশেম, সুভাষ বসু ও মওলানা ভাসানীর রাজনীতির প্রভাব বলয়ে।'[8]
জাতীয়তাবাদ
শেখ মুজিবর রহমান ভাষাভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন বাংলাদেশের সকল অধিবাসী বাঙালি। তিনি ভেদাভেদে বিশ্বাসী ছিলেন না। বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম স্তম্ভ মনে করতেন।[7] 'বাংলা ভাষাকে, বাংলা ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতিকে এবং বাংলার মানুষের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা দানই ছিল' মুজিববাদের মূল লক্ষ্য।[9] বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় সর্বস্তরে বাংলা চালুর ব্যাপারে তাগিদ দেন এবং পরিভাষার জন্য অপেক্ষা না করে তা তখনই শুরু করার পরামর্শ দেন।[10] তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষার অপেক্ষা করব না, কারণ তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনোদিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না।[10] তিনি আরও বলেন, ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই বাংলা ভাষার উন্নয়ন হবে।[10] কেননা ভাষা সব সময় মুক্ত পরিবেশে বিস্তার লাভ করে।[10] ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিককরণে ভূমিকা রাখেন।[11] ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন।[11] রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারিকৃত এক আদেশে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’[11]
সমাজতন্ত্র
মুজিববাদের দ্বিতীয় স্তম্ভ সমাজতন্ত্র। তার মতে, বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র হবে দেশজ ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র।[7]
কুষ্টিয়ায় একটি বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘সম্পত্তি এখন সাড়ে সাতকোটি লোকের। যা উৎপাদন হবে সাড়ে সাত কোটি লোক ভোগ করবে। এদেশ শোষণহীন সমাজ হবে।‘
১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলে তিনি বলেন, ‘গরীব হবে এই রাষ্ট্র ও সম্পদের মালিক, শোষকরা হবে না।‘
গণতন্ত্র
শেখ মুজিবর রহমান বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রের বিশ্বাস করি। জনগণকে আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েই জনগণের মতামতের উপর আমরা বিশ্বাস করি। জনগণ যাদের নির্বাচন করবে, তারাই সরকার চালাবে।[7] তিনি আরো বলেন, ‘শক্তির উৎস বন্দুকের নল নয়। শক্তির উৎস হল জনগণ।‘ সরকারি কর্মচারী ও আমলাদের জনগণের সেবক হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন। সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, শুধু সামরিক বাহিনীতে দেশ রক্ষা হয় না। দেশ রক্ষা হয় জনগণকে দিয়ে।’ গণতন্ত্রের মাধ্যমে তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি বলেন, ‘ দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্র কায়েম করবো।‘
ধর্মনিরপেক্ষতা
মুজিববাদের চতুর্থ আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা। তার মতে, বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকবে; আর ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।[7] হিন্দুরা হিন্দু ধর্ম, মুসলমানেরা মুসলমানদের ধর্ম পালন করবে।
প্রভাব
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হলে শেখ মুজিবুর রহমানের চার স্তম্ভ, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রপরিচালনার চার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়।
তথ্যসূত্র
- Ilias, Khondakar Mohammad (১৯৭২)। Mujibbad। ঢাকা: সাম্য। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-১৫।
- "'Father' of Bangladesh"। The New York Times (ইংরেজি ভাষায়)। ১৯৭৫-০১-২৭। আইএসএসএন 0362-4331। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-১৫।
- Khan, Zillur R. (১৯৭৪-০২-০১)। "Leadership and political opposition in Bangladesh"। Asian Affairs। 5 (1): 41–50। doi:10.1080/03068377408729695। আইএসএসএন 0306-8374।
- Lifschultz, Lawrence; Bird, Kai (১৯৭৯)। "Bangladesh: Anatomy of a Coup"। Economic and Political Weekly। 14 (49): 1999–2014। আইএসএসএন 0012-9976।
- দস্তগীর, কে.এম গোলাম (২০১২)। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন। ঢাকা: আদর্শ। পৃষ্ঠা ১০। আইএসবিএন 978-984-8875-31-5।
- "আমি আশাবাদী—কথাটি বলতে পারছি না"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-১৫।
- হোসেন, আবু মোঃ দেলোয়ার; উল্লাহ, মোঃ রহমত, সম্পাদকগণ (২০১৩)। বঙ্গবন্ধুর মানবাধিকার-দর্শন। ঢাকা: জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। পৃষ্ঠা ১–১৯।
- "ভাষা আন্দোলনের হক সাহেব ও শেখ সাহেব ॥ দুই॥ || চতুরঙ্গ"। জনকন্ঠ (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৬-০৪।
- "বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা"। সমকাল। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-১৮।
- "বঙ্গবন্ধু যেভাবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর পরিকল্পনা করেছিলেন"। Jugantor। ২০১৯-০৩-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-১৫।
- "ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান"। দৈনিক আমাদের সময়। ২০১৯-০৫-০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-১৮।