মঙ্গল শোভাযাত্রা

মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে আয়োজিত একটি তুলনামূলকভাবে নতুন বর্ষবরণ উৎসব। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে এটি প্রবর্তিত হয়। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসাবে সারাদেশে এটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।[1]

মঙ্গল শোভাযাত্রা
মঙ্গল শোভাযাত্রা (২০১৫)।
অবস্থাসক্রিয়
ধরণশোভাযাত্রা
তারিখ (সমূহ)১৪ এপ্রিল (বাংলা পঞ্জিকার ১ম দিন)
পুনরাবৃত্তিবার্ষিক
অবস্থান (সমূহ)ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস
স্থানাঙ্ক২৩.৭৩৩২৪২° উত্তর ৯০.৩৯০৯২১৮° পূর্ব / 23.733242; 90.3909218
দেশ বাংলাদেশ
কার্যকাল১৯৮৯- বর্তমান
আয়োজকঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ
পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা
ইউনেস্কো অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
দেশবাংলাদেশ
ধরনসামাজিক চর্চা, অনুষ্ঠান এবং উত্সব ঘটনা
মানদণ্ড???
সূত্র01091
ইউনেস্কো অঞ্চলAP
অন্তর্ভূক্তির ইতিহাস
অন্তর্ভূক্তি২০১৬ (১১তম অধিবেশন)
তালিকাপ্রতিনিধিত্বমূলক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখে ঢাকা শহরের শাহবাগ-রমনা এলকায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।[2] এই শোভাযাত্রায় চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়। এছাড়াও বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ, বিভিন্ন রঙ-এর মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়। তবে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে প্রায় প্রতি জেলাসদরে এবং বেশ কিছু উপজেলা সদরে পহেলা বৈশাখে ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ আয়োজিত হওয়ায় ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ বাংলাদেশের নবতর সর্বজনীন সংস্কৃতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর মানবতার অধরা বা অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে।[3][4]

ইতিহাস

মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত প্রতিকৃতি।

প্রতি বছর বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে ঢাকার রমনা পার্কে ছায়ানট আয়োজিত প্রাত্যোষিক সঙ্গীতানুষ্ঠান এবং একে ঘিরে আয়োজিত অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলা সাধারণ মানুষকে নিবিড়ভাবে আকৃষ্ট করতে থাকে এবং নাগরিক আবহে সার্বজনীন পহেলা বৈশাখ উদযাপনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরূদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়।[5] ঐ বছরই ঢাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এই আনন্দ শোভাযাত্রা। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এই আনন্দ শোভাযাত্রা বের করার উদ্যোগ প্রতি বছর অব্যাহত রাখে।

শোভাযাত্রার অনতম আকর্ষণ - বিশালকায় চারুকর্ম পুতুল, হাতি, কুমীর, লক্ষ্মীপেঁচা, ঘোড়াসহ বিচিত্র মুখোশ এবং সাজসজ্জ্বা, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য।[6] পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু থেকেই জনপ্রিয়তা পেয়ে আসছে। পরের বছরও চারুকলার সামনে থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়। তবে সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী জানা যায়, ঐ বছর চারুশিল্পী সংসদ নববর্ষের সকালে চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে বর্ণাঢ্য আনন্দ মিছিল বের করে।[7] শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না।

মাহবুব জামাল শামীম নামক শুরুরদিকের একজন অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকে জানা যায়, পূর্বে এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। সেই সময়ের সংবাদপত্রের খবর থেকেও এমনটা নিশ্চিত হওয়া যায়। সংবাদপত্র থেকে যতোটা ধারণা পাওয়া যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে।[8] তবে বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরো কয়েক বছরের পুরানো।

১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে চারুপীঠ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল - পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।[9]

মঙ্গল শোভাযাত্রার বিবর্তন

১৯৮৯ সালে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের আনন্দ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিল্পীদের উদ্যোগে হওয়া সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীগণ-সহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেয়।

শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকার্ডসহ মিছিলটি নাচে গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দ শোভাযাত্রার সম্মুখে রং বেরংয়ের পোশাক পরিহিত ছাত্র-ছাত্রীদের কাঁধে ছিল বিরাট আকারের কুমির। বাঁশ এবং বহু বর্ণের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কুমিরটি। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। চারুকলার সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় দিয়ে শিশু একাডেমি হয়ে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হয়।

ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ‌্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি

জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ‌্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।[3][4] ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা’য় অনুষ্ঠিত ২৮ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর সংশিষ্ট আন্তজাতিক পর্ষদ (INTERGOVERNMENTAL COMMITTEE FOR THE SAFEGUARDING OF THE INTANGIBLE CULTURAL HERITAGE) বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবটি Nomination file no. 01091 হিসেবে চিহ্নিত ছিল। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলা একাডেমী এই প্রস্তাবনাটি প্রণয়ন করে। পরবর্তীকালে ইউনেস্কোর চাহিদা অনুযায়ী এই প্রস্তাবনাকে গ্রহণযোগ্যরূপে পুনঃপ্রণয়ন করা হয়। ২০১৫ এর ১লা জুন প্যারিসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম. শহিদুল ইসলাম এই পুনঃপ্রণীত প্রস্তবনাটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পুনরায় ইউনেস্কোর নিকট দাখিল করেন। [10]

২০০৫-০৬ অর্থবৎসরে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি তালিকা প্রণয়নের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং এশিয়াটিক সোসাইটিকে এর দায়িত্ব দেয়া হয়। ১২ খণ্ডে প্রকাশিত এই তালিকা তথা সমীক্ষা প্রতিবেদনের ১১ খণ্ডে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সর্বপ্রথম ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কোর প্যারিসে অবস্থিত সদর দপ্তরে আবেদন করেছিল যে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে শান্তি, গণতন্ত্র ও বাঙ্গালী জাতিসত্বার ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে বছরের প্রথম দিনে ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’’ মাধ্যমে অপশক্তির অবসান এবং বাংলাদেশের মানুষ কল্যাণময় ভবিষ্যতের আশা ব্যক্ত করে চলেছে।[11]

চিত্রশালা

তথ্যসূত্র

  1. Habib, Haroon। "Dramatic dawn"The Hindu। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১১-৩০
  2. "মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০১৮
  3. হোসেন, মোছাব্বের (১৪ এপ্রিল ২০১৭)। "মঙ্গল শোভাযাত্রার বিশ্ব স্বীকৃতি এল যেভাবে"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১৪ এপ্রিল ২০১৮
  4. "২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর ইউনেসকো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে"unesco official site। ২০১৬-১১-৩০। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১১-৩০
  5. রমনার বটমূলে জাতীয় উৎসবে, নওয়াজেশ আহমদ, দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০০৮
  6. পহেলা বৈশাখ উদযাপিত, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ এপ্রিল ১৯৮৯। পৃ ৭
  7. পহেলা বৈশাখ উদযাপিত, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ এপ্রিল ১৯৯০। পৃ ২
  8. বাঙালির বর্ষবরণ মিলন মেলায়, দৈনিক আজকের কাগজ, ১৬ এপ্রিল ১৯৯৬। পৃ ২
  9. মাহবুব জামাল শামীম, একান্ত সাক্ষাৎকার, ৩১ মার্চ ২০০৯।
  10. বাংলাদেশের মনোনয়নের ফাইল নং 01091
  11. ইউনেস্কো লিখেছে: Mangal Shobhajatra is a festival for the public that celebrates Pahela Baishakh (New Year’s Day) on April 14, organized by students and teachers of Dhaka University’s Faculty of Fine Art. The tradition began in 1989 when students, frustrated by living under military rule, wanted to bring the community hope for a better future. It features floats and masks symbolizing strength, peace and a driving away of evil to allow for progress. With knowledge of the element shared by the school, it promotes public solidarity and democracy.
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.