ব্রাহ্ম সমাজ মন্দির, ঢাকা
ঢাকায় একটি ব্রাহ্ম সমাজ মন্দির রয়েছে, যা পাটুয়াটুলি এলাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত; এটি "পূর্ব বাঙ্গালা ব্রাহ্ম সমাজ মন্দির" নামেও পরিচিত।
ব্রাহ্ম সমাজ মন্দির | |
---|---|
![]() ব্রাহ্ম সমাজ এর উপাসনালয় ব্রাহ্ম সমাজ মন্দির, ঢাকা | |
বিকল্প নাম | পূর্ব বাঙ্গালা ব্রাহ্ম সমাজ মন্দির |
সাধারণ তথ্য | |
ধরন | উপাসনালয় |
ঠিকানা | পাটুয়াটুলী |
শহর | ঢাকা |
দেশ | বাংলাদেশ |
নির্মাণ শুরু হয়েছে | ১৮৬৬ |
সম্পূর্ণ | ২২ আগস্ট ১৮৬৯ |
উদ্বোধন | ৫ ডিসেম্বর ১৮৬৯ |
ব্যয় | দশ হাজার টাকা |
স্বত্বাধিকারী | ব্রাহ্ম সম্প্রদায় |
নকশা এবং নির্মান | |
স্থপতি | উমাকান্ত ঘোষ |
প্রকৌশলী | রামমাণিক্য সেন |
মন্দির নির্মাণের পটভূমি
১৮৬৬ সালে দীননাথ সেন ঢাকায় ব্রাহ্মদের নিজস্ব উপাসনালয় নির্মাণের প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ২৫ আগস্ট ১৮৬৬ সালে ৯ সদস্যের নির্মাণ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে ছিলেন- সাধারণ সম্পাদক দীননাথ সেন, অক্ষয়কুমার সেন (বিদ্যালয়ের পরিদর্শক), রাধিকামোহন রায় (জমিদার), উমেচন্দ্র দাস (কমিশনার অফিসের হেডক্লার্ক), গোপীমোহন বসাক (পোগোজ স্কুলের প্রধানশিক্ষক), রামকুমার বসু (ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট), অভয়চন্দ্র দাস (কমিশনারের ব্যক্তিগত সহকারি), কৈলাসচন্দ্র ঘোষ (কলেজিয়েট স্কুলের প্রধানশিক্ষক) ও বৈকুণ্ঠনাথ সেন প্রমুখ। মন্দিরটি স্থাপনের আগে ঢাকার ব্রাহ্মরা উপাসনার জন্য একত্রীত হত আরমানিটোলার ব্রাহ্মসমাজগৃহে। জনৈক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিজের বাড়িটি ব্রাহ্ম সামাজকে দান করেন। মতান্তরে এই জমির মালিক ছিলেন কলতাবাজারের জামিদাররা। এই জমিদারদের মধ্যে ছিলেন- শ্যামচাঁদ বসাক, জগন্নাথ বসাক, সনাতন ও কৃষ্ণদাস বসাক প্রমুখ। ব্রাহ্ম মন্দিরের জন্য মোট ৫,৮৭৫ জন চাঁদা দেয়। এই জমি রেজিস্ট্ররি করা হয় ১০ সেপ্টেম্বর ১৮৬৮ সালের দিকে। অবশ্য এপ্রিল ১৮৬৭ সালেই অভয় কুমার দত্ত পাটুয়াটুলির মোড়ে মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। উমাকান্ত ঘোষ এই মন্দির ভবনের নকশা প্রস্তুত করেন ; রামমাণিক্য সেন নির্মাণ কাজ পরিচালনা করেন। দোতলা সমান উচ্চতার একতলা এ মন্দিরটি নির্মাণ ব্যয় হয় প্রায় দশ হাজার টাকা। ডেভিড কফ এই মন্দিরটিকে সে সময়কার দক্ষিণ এশিয়ার ব্রাহ্ম মন্দিররের মধ্যে সর্ববৃহৎ ও আকর্ষণীয় বলে উল্লেখ করেন। ৭ ভাদ্র ১২৭৬ বঙ্গাব্দ/২২ আগস্ট ১৮৬৯ সালে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। শহরের প্রায় সকল ধর্মের লোকের উপস্থিতিতে ৫ ডিসেম্বর ১৮৬৯ সালে মন্দির উদ্বোধন হয়। এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য ব্যাপক আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন নবাব আবদুল গণি, নবাব আহসানুল্লাহ, ত্রিলোচন চক্রবর্তী, জোয়াকিন পোগোজ, বরদাকিঙ্কর রায়, লক্ষ্মীকান্ত দাস, ডেভিড, কৃষ্ণকুমার বসু প্রমুখ। প্রতি রবিবার সন্ধ্যার এখানে প্রায় তিনশ সভ্য উপাসনার জন্য উপস্থিত হত বলে জানা যায়। ১২৭৬ বঙ্গাব্দ/১৮৭০ সালে এর সর্বপ্রথম সম্পাদক ছিলেন দীননাথ সেন।
ইতিহাস
আগস্ট ১৮২৮ সালে হিন্দুধর্ম সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এর দায়িত্ব নেন। নিরাকার এক ঈশ্বরবাদী ব্রাহ্মমত উন্মুক্ত ছিল সব ধর্মের লোকের জন্য। তাদের মূল উদ্দেশ্যে ছিল সমাজ থেকে ধর্মীয় গোঁড়ামি, মাত্রারিতিক্ত অপচয়, পৌত্তলিকতা, যৌতুক প্রথা, বিধবা বিবাহ, নারী শিক্ষা প্রভৃতি দূর করা। নতুন এই মতাদর্শে আকৃষ্ট হয়ে ঢাকার অনেক যুবক এই মতে দীক্ষিত হন। এজন্য অনেকে পরিবার-পরিজন পর্যন্ত তাদের ত্যাগ করেন। যে উৎসাহ উদ্দিপনায় যুবকরা এই ধর্মমতে দীক্ষিত হয় পৌড়ে তারাই আবার ফিরে যান রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে। সার্বজনীন ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা থাকলেও ক্রমেই এটি হিন্দু ধর্মের একটি শাখা হিসেবে পরিণত হয়। ঢাকার শিক্ষা, সংবাদপত্রসহ বহু সমাজসেবামূলক কাজে ব্রাহ্মসমাজের অবদান উল্লেখযোগ্য। ঢাকার পাটুয়াটুলি, আরমানিটোলা ও নিমতলি কুঠির বিধানপল্লীতে ছিল তাদের উপাসনালয়।
মন্দিরের বর্ণণা
চার ফুট উঁচু মঞ্চের উপর পূর্ব-পশ্চিমে আয়তকার মন্দিরটি ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। মন্দির ভবনের ছাদের সামনের অংশে একটি নকশাদ্বার চূড়ায় লেখা আছে ‘ব্রাহ্মসমাজ’। সাদামাটা এ মন্দিরে প্রবেশ করতে হয় পাঁচটি প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়িগুলো উপরের দিকে পাশে ক্রমশ কমে গেছে। সিঁড়ির ঠিক মাঝখানে উন্মুক্ত খিলান প্রবেশপথ। প্রায় ১০০ ফুট দীর্ঘ ও ৫৫ ফুট প্রশস্ত মন্দিরটির চারপাশে ১৫ ফুট প্রশস্ত বারান্দার ঠিক মাঝখানে বিশাল একটি হলঘর। বারান্দার চারকোণের উপরের অংশে আছে চারটি বর্গাকার কক্ষ। পেছন দিকের বারান্দার অংশে ঘরগুলোতে উঠার জন্য দুটি আলাদা সংকীর্ণ সিঁড়ি। উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহৃত মন্দিরের মূল হলঘরটির দৈর্ঘ্য ৫৫ ফুট, প্রশস্ততা ২২ ফুট এবং উচ্চতা ২১ ফুট।[1] চারপাশের বারান্দা থেকে হলঘরে প্রবেশের নির্দিষ্ট দূরত্বে মোট ১৬টি প্রবেশপথ আছে। এরমধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ৫টি করে আর পূর্ব-পশ্চিমে ৩টি করে প্রবেশপথ আছে। বিশালাকার এই প্রবেশপথগুলো সবই খড়খড়ির। হলঘরের উত্তর অংশের ঠিক মাঝখানে চার ফুট উঁচু বেদিতে উঠতে হয় চারটি প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে। এই বেদির উপর বসে সম্পাদক ব্রাহ্মসমাজের মতবাদের কথা বলেন। এই উপাসনালয়ে কোনো প্রার্থনা বা পূজা হয় না। বেদির সামনে বসে শিল্পীরা ব্রাহ্মসমাজের বিভিন্ন গান গেয়ে থাকে। আর চারপাশের ব্যঞ্চে বসে অতিথিরা তা শুনে থাকে। হলঘরটির পূর্ব ও পশ্চিম দিকের উপরের অংশে আছে রেলিং দেয়া আয়তাকার বারান্দা। মন্দির নির্মাণের সময়ই মন্দিরের পেছনের অংশে সমাজের প্রচারকদের জন্য কয়েকটি ভবন নির্মাণ করা হয়।