বিল কুমারী বিল

জলে মাছ, আর উপরে পাখির অবাধ বিচরন। যেন মাছ আর পাখির মিলিত অভয়াশ্রম। এই বিলের একপাশে মাছ ধরে চলে ৫০০ জেলের জীবিকা। আর অন্যপাশে নিরাপদ থাকে মা মাছ। সেখানে খাবার সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে হাজার হাজার পাখি। প্রকৃতি আর জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। স্থানীয় মানুষের প্রত্যক্ষ যাপনসঙ্গীও। রাজশাহীর তানোর উপজেলা সদরের পাশেই বিল কুমারী বিল। শিব নদী আর এই বিল যেন অভিন্ন শরীর। এই নদী বয়ে গেছে এর মাঝখান দিয়ে। আরও দু-তিনটি নদীর নিবিড় প্রেম এই বিল কুমারীর সঙ্গে। সারা বছর বিলজুড়ে দুই ধরনের কর্মযজ্ঞ দেখা যায়- মাছ ধরা আর ধানের চাষ। উল্লাপাড়া, কুঠিপাড়া, মেলান্দি ও গোকুল- এই চার গ্রামের প্রায় পাঁচ শ জেলে নিয়ে গঠিত হয়েছে বিল কুমারী বিল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি। বছরব্যাপী মাছ ধরেই তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে বহু বছর ধরে। বর্ষায় নদী আর বিল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যত দূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। শীতে শুকিয়ে যায় এর অধিকাংশই। এখনকার জেলেদের জীবন ও জীবিকার মূল চালিকাশক্তিই যেন এই বিপুল জলাধার।এর এক পাশে রয়েছে মাছের অভয়ারণ্য। সেখানে মাছ ধরা নিষেধ। এই অভয়ারণ্যে নির্বিঘ্নে মাছ ডিম পাড়ে, বড় হয়ে ওঠে। মাছগুলোর মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা, বোয়াল, আইড়, শোল ইত্যাদি। অভয়ারণ্যের অন্য পাশে সারা বছর মাছ ধরেই চলে জেলেদের দৈনন্দিন জীবন। কিন্তু বছরে এক দিন জেলেরা মাছ ধরতে পারেন এই অভয়ারণ্যে। ওই এক দিন মাছ ধরেই জেলেপ্রতি আয় হয় ১০-২০ হাজার টাকা; এটি তাদের কাছে আশীর্বাদের মতোই।শীতের সময়, বিশেষ করে ডিসেম্বরেই পানি কমতে শুরু করে। জেগে ওঠে বিস্তীর্ণ ধানি জমি। কৃষক কোমরে গামছা বেঁধে কাদায় নেমে পড়েন জমি তৈরির কাজে। প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে গড়ে তোলেন বোরো ধানের বীজতলা। জানুয়ারি মাসের মধ্যেই ১৫-২০ হাজার হেক্টর জমিতে কৃষক বুনে দেন বোরো ধানের চারা। এক মাসের মধ্যেই সমগ্র বিল ঢেকে যায় ধানের সবুজে। যেদিকে চোখ যায়- সবুজ প্রান্তর। তখন মাঠে থাকে না কোনো কাজ। বিলের পাড়ে বসলেই নরম বাতাসের সঙ্গে ধানগাছের খুনসুটি চোখে পড়ে। জুড়িয়ে যায় চোখ। এপ্রিলে ধানে লাগে সোনা রঙ। পাকতে শুরু করে। ক্রমেই পুরো এলাকা ভরে ওঠে সোনার ধানে। কালবৈশাখীর চোখরাঙানি উপেক্ষা করেই তার বেড়ে ওঠা। হঠাৎ বৃষ্টির কারণে কখনো কখনো ঢলের পানি চলে আসে ধান কাটার আগেই। কৃষকের মুখ হয়ে ওঠে মলিন। ডোবা ধান কাটা আরেক সংগ্রাম। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কপালের লিখন ধরে নিয়েই কৃষক লেগে পড়েন ধান কাটতে। কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি কৃষাণীকে করে তোলে ব্যতিব্যস্ত। ধান শুকানো, সেদ্ধ করা, চাল তৈরি- কত কাজ। একসময় গোলায় ওঠে সারা বছরের ধান-চাল। বিল কুমারী বিলের পাখির কথা না বললেই নয়। পানকৌড়ি, বখাচোখী, গাঙচিল, গাঙ শামুখখোলা, বক, নারিকেল হাঁসসহ নানা জাতের পাখির দেখা মেলে। জেলে আর গ্রামবাসীই এদের নিরাপত্তা দেয়। গ্রামবাসীর চলাচল আর গ্রামগুলোর মধ্যে সংযোগ দিতে বিলের বুক চিড়ে দেয়া হয়েছে বিশাল সব বাঁধ। ফলে শুকিয়ে গেছে বিলের অনেকাংশ। জলাভূমি বিশেষজ্ঞ এবং কৃষি-মৎস্যবিজ্ঞানীদের সঙ্গে সমন্বয় করে এই অঞ্চলের উন্নয়ন পরিকল্পনা না করলে বিল কুমারী তার অস্তিত্ব হারাতে পারে। এটি শুধু পানি-মাছ-পাখি-কৃষির জন্য নয়; বরং এই অঞ্চলের মিষ্টি পানি, প্রকৃতি ও মানুষের সুস্থতা এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি হয়ে আছে। পাশাপাশি অত্যন্ত আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবেও গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে বিল কুমারীর।

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.