বনফুল

বনফুল চাষ বা যত্ন ছাড়া বেড়ে ওঠা সপুষ্পক উদ্ভিদ। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে শনাক্তকৃত এ ধরনের উদ্ভিদের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ।

ধরণ

আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে শনাক্তকৃত এ ধরনের উদ্ভিদের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ, যদিও বহু হাজার প্রজাতির বর্ণনা এখনও হয় নি। এগুলির মধ্যে মাত্র ১,৫০০ প্রজাতির (প্রায় ০.৫%) খাদ্য, পশুখাদ্য, অাঁশ, পানীয়, কাঠ, ঔষধ ও ফুলের জন্য চাষ হয়। বাকি সবই বন্য। বিপুল সংখ্যক বুনো উদ্ভিদ পৃথিবীর পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং প্রয়োজনীয় অক্সিজেন যোগায়। এগুলি অন্যতম ধারক শক্তিও, কিন্তু মানুষ জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে প্রাণের এই নীরব আশ্রয়কে ধ্বংস করে চলেছে। সমৃদ্ধ মৌসুমিবন, বৃক্ষবন, এমনকি বসতবাড়ির গাছগাছালিও মানুষের হাতে আজ বিপন্ন। ধ্বংসের এই হার মারাত্মক প্রতি মিনিটে প্রায় ৪০ হেক্টর। ফলে সম্ভাব্য জীবনরক্ষক অনেক উদ্ভিদ প্রজাতি খুব দ্রুত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। অনেক উদ্ভিদ হূদরোগ, পেপটিক আলসার এবং ফুসফুস, কিডনি ও অন্ডকোষের ক্যানসার চিকিৎসায় এমনকি গর্ভরোধক ঔষধ হিসেবেও ব্যবহূত হয়। এ পর্যন্ত মাত্র ৫,০০০ প্রজাতির গাছগাছড়ার ভেষজগুণ যথাযথভাবে পরীক্ষিত হয়েছে। জ্ঞানের এই বিশাল ভান্ডার ও সম্ভাব্য ওষুধগুলি এখন হুমকির সম্মুখীন। ধারণা করা হয় সবার অলক্ষ্যে বহু প্রজাতির উদ্ভিদ ক্রমে লোপ পাচ্ছে। বাংলাদেশ, পূর্ব-ভারত ও মায়ানমারের এই অঞ্চলটি বনজ উদ্ভিদসমৃদ্ধ। বাংলাদেশ হলো বিখ্যাত রুশ উদ্ভিদবিদ ভ্যাবিলভ কথিত চাষের ফসলের ইন্দো-বার্মা উৎস কেন্দ্র। এখানকার উদ্ভিদ সমীক্ষার ইতিহাস খুবই প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে রচিত চরকসংহিতা ভেষজ উদ্ভিদ ও সংশ্লিষ্ট জ্ঞানের এক অমূল্য আকরগ্রন্থ। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এখানকার উদ্ভিদকুলের বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা শুরু হয়েছিল। এক্ষেত্রে অগ্রগণ্যদের মধ্যে উইলিয়ম রক্সবার্গ, ন্যাথানিয়েল ওয়ালিচ, উইলিয়ম গ্রিফিথ ও জে.ডি হুকার সবিশেষ স্মরণীয়। হুকার লিখিত সাত খন্ডের 'Flora of British India' (১৮৭২-১৮৯৭), ডেভিড প্রেইনের দুই খন্ডের 'Bengal Plants' ও 'Flora of Sundribuns' (১৯০৩) এবং কালীপদ বিশ্বাসের ছয় খন্ডের 'ভারতীয় বনৌষধি' সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সত্তর দশকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম সারাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক উদ্ভিদ নমুনা সংগ্রহ করেছে। বাংলাদেশের শনাক্তকৃত (প্রায় ৫,০০০ সপুষ্পক উদ্ভিদ) ও অচিহ্নিত উদ্ভিদের অধিকাংশই বুনো প্রজাতির। এগুলির ২১০ প্রজাতি বর্তমানে চাষাধীন। বন-উদ্ভিদ আছে প্লাবনভূমি, উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন, পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়, টিলাভূমি ও বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে। বর্ষার বৃষ্টি, অধিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা, বন্যা ও শুষ্ক শীতকাল বনজ উদ্ভিদ বৃদ্ধির প্রধান কারণ। পরিবেশের বৈচিত্র্য বিবর্তনের সহায়ক, যেজন্য এই অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের এমন সমৃদ্ধ সমাবেশ দেখা যায়

প্রজাতি

প্লাবনভূমি ও কৃষিক্ষেতের উদ্ভিদকুল

উদ্ভিদকুলের এই আবাসস্থলটি দেশের প্রায় সর্বত্র বিস্তৃত। প্রতিবছর বর্ষাকালে অনেকটা জায়গা ১-৩ মাস পর্যন্ত  প্লাবিত থাকে। এই আবাসস্থলে অবশ্য উঁচু ধানক্ষেতও আছে। বর্ষাকালে এসব জমি প্লাবিত না হলেও জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আর্দ্র থাকে। বছরের বাকি সময় এই অঞ্চলে প্রচুর আর্দ্রতা থাকায় পর্যাপ্ত বুনো গাছগাছড়া গজায়। এখানকার মাটিও যথেষ্ট উর্বর। ফলে, এলাকাটি নানা জাতের মৌসুমি ঘাস ও আগাছার অত্যধিক বৃদ্ধির আদর্শ বাস্ত্তভূমি হয়ে ওঠে। এগুলিরই উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো কুলেকাড়া ছোট মোরগফুল ঢোলপাতা ঝুরঝুরি, কাশ,শেয়ালকাঁটা ইত্যাদি।

পথপাশ ও বাসতবাড়ির আশপাশের উদ্ভিদকুল 

এই আবাসস্থলে আছে উন্মুক্ত, মিশ্র ও সংরক্ষিত বন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বৃহত্তর সিলেটের চা বাগান এলাকা। এখানকার প্রধান উদ্ভিদবর্গ হলো বৃক্ষ, লতা-গুল্ম, উঁচু ঘাস ও ঔষধি। এসব গাছপালা, বিশেষত স্থানীয় বৃক্ষ, মোটাসোটা লতা ও কন্দজ ঔষধি অন্যান্য অঞ্চলের এরূপ প্রজাতি থেকে অনেকটাই পৃথক। ব্যবসায়িক মূল্য না থাকায় এবং দুর্গম অঞ্চলে অবস্থানের দরুন এই প্রজাতিগুলির সিংহভাগই সরাসরি মানুষের হস্তক্ষেপ এড়াতে পারে। তবু নির্বনায়ন ও ভূমিক্ষয়ের ফলে অনেকগুলি প্রজাতিই এখন বিলুপ্তির সম্মুখীন। এর মধ্যে রয়েছে নীল-লতা, নিম-আদা, গাইছা লতা, সাদা কলমি,পাহাড়ি কাশ, লেটকাঁটা, ডেরিশ করই, বনকলা। এছাড়াও এই অঞ্চলে বন ও পাহাড়ি প্রজাতির উল্লেখযোগ্য বনফুল: নীল-লতা বননারাঙ্গা, উয়াং নিওন-গাই , কুকরা, ঢোলসমুদ্র, হলদে ফুল, দাঁতরাঙ্গা/সুটকি, খরখরা জাম, ঘাসফুল, নাগবল্লী, বান্দরহুলা/রামডালু, মাকরি শাল, শাঠি এবং বনআদা।

স্বাদুপানির জলাভূমির উদ্ভিদকুল 

এগুলির বেশির ভাগই অগভীর এবং তাতে বহু জলজ উদ্ভিদ প্রজাতি জন্মে। নদী ও বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট এসব স্থায়ী জলাশয়ের মধ্যে আছে নলখাগড়ার বন, বিল, খাল ও পুকুর। এখানকার জলজ উদ্ভিদকুল অনেক বছর নির্বিঘ্ন ছিল, কিন্তু সম্প্রতি সেচকার্যে পানি ব্যবহার এবং মাছ ও হাঁস চাষের ফলে এসব উদ্ভিদকুলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় ফুল সাদা শাপলাসহ এখন বহু জলজ প্রজাতিই বিপন্ন, যেমন ছোটকুট, হিজল, হেলেঞ্চা, চাঁদমালা, শাপলা, পাটিবেত/মুর্তা, পানিকাপর এবং কচুরিপানা ও ভাসমান জলজ উদ্ভিদের কিছু প্রজাতি। স্বাদুপানিতে আরও আছে কলমি, শোলারক্তকমল, কচুরিপানা, বড়নখা এবং জলধনিয়া।

উপকূলীয় অঞ্চলের উদ্ভিদকুল 

এখানকার উদ্ভিদকুলের অধিকাংশই লবণসহিষ্ণু বা লবণনির্ভর। মোহনার গাছপালার বৈশিষ্ট্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় একান্তভাবে দেশীয়। ডেভিড প্রেইনের মতে এটি পানির লবণাক্ততা ও মাটিতে জোয়ারভাটার প্রভাবেরই ফল। ম্যানগ্রোভ গাছগাছালি ছাড়াও দুটি যূথবদ্ধ পাম প্রজাতি আছে নদীতীর ও জলাভূমির পাশের গোলপাতা এবং অপেক্ষাকৃত শুকনো জায়গায় হেন্তাল । সম্প্রতি এখানেও মানুষের হস্তক্ষেপ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে এবং চিংড়িচাষ ও অন্যান্য বাণিজ্যিক কর্মকান্ড উপকূলীয় উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। নতুন বাসিন্দারা নতুন প্রজাতির গাছপালা লাগাচ্ছে। এখানকার স্বাভাবিক প্রজাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাড়গজা, সমুদ্দুর লাবুনি, পিন্ডারি, পরশপিপুল, বোলা, কেয়া, সাগর নিশিন্দা ও নানা প্রজাতির ম্যানগ্রোভ। কিছু উপকূলীয় প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ছাগলঘুরি, সাগর কলমি ও বন শণ।

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.